রাজশাহীতে আবারও মৃদ্যু শৈত্যপ্রবাহ II একদিনে তাপমাত্রা কমলো চার ডিগ্রি

আপডেট: জানুয়ারি ২০, ২০২৪, ৮:৩২ অপরাহ্ণ


নিজস্ব প্রতিবেদক:


উত্তরের হিমেল হাওয়ায় রাজশাহীতে একদিনে তাপমাত্রা কমেছে চার ডিগ্রি সেলসিয়াস। শুক্রবার আকাশে সূর্যের দেখা পাওয়া গেলেও শনিবার (২০ জানুয়ারি) থেকে আবারও আগের রূপে ফিরেছে। শুক্রবার (১৯ জানুয়ারি) রাজশাহীতে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগের দিন বৃহস্পতিবার (১৮ জানুয়ারি) তাপমাত্রা ছিল ১০ দশমিক ৬ ডিগ্রি। শনিবার (২০ জানুয়ারি) সকাল ৯টায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ভোর ছয়টায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

সকাল আটটার দিকে রোদের মুখ দেখা গেলেও তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। কুয়াশা আবারও চারিদিকে ঘিরে ফেলে। ঘন কুয়াশা না থাকলেও বইছে হিমেল বাতাস। বেলা ১১টা পর্যন্ত সূর্য দেখা যায়নি। ফলে বেড়েছে শীতের তীব্রতা।

শীতের প্রকোপ বাড়তে থাকায় এ অঞ্চলের জনজীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। এর আগে, মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল গত ৪ জানুয়ারি ১০ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর গত ৩ জানুয়ারি রাজশাহীতে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিলো ১০ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ১৩ জানুয়ারি রাজশাহী মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল। সেদিন ৯ দশমিক ৬ ডিগ্রি রেকর্ড করা হয়েছে।

এদিকে রাজশাহীতে চলতি বছর শীত নেমেছে দেরি করে। এই জানুয়ারি মাসের আগেও তেমন শীতের দাপট ছিল না। আগে জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ জুড়েই মাঝারি থেকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহের কবলে থাকতো রাজশাহী। কিন্তু গেল প্রায় ৩-৪ বছর থেকে সেই অর্থে শীত পড়েনি। চলতি বছর তাও ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে তাপমাত্রা নামল এই দু-দিন (১৩ ও ২০ জানুয়ারি)। এছাড়া দিনের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা গড়ে ১০ ডিগ্রি থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যেই ওঠানামা করছে।

তবে এই শীতেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে রাজশাহীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। ‘সর্বনিম্ন’ তাপমাত্রা খুব নিচে না নামলেও রোদ না ওঠায় কম থাকছে ‘সর্বোচ্চ’ তাপমাত্রা। আর সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার ব্যবধান কমে আসায় হাড় কাঁপানো শীত অনুভূত হচ্ছে। প্রায় দুই সপ্তাহ থেকে বিকেলের আগে সূর্যের মুখ দেখা যাচ্ছে না। আর রোদ ওঠার কিছুক্ষণ পরই মেঘ বা কুয়াশায় তা ঢেকে যাচ্ছে। মেঘ এবং ঘন কুয়াশার মধ্যেই বইছে উত্তরের হিমেল হাওয়া।

এতে শীতার্ত মানুষগুলো যারপরনাই দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। বিশেষ করে বস্তি এলাকা, রেলওয়ে স্টেশন ও বিভিন্ন ফুটপাতের ওপর খোলা আকাশের নিচে থাকা ভাসমান মানুষগুলোর জীবন অসহনীয় এবং অবর্ণনীয় হয়ে উঠেছে। একদিকে শীতের কষ্ট; আরেক দিকে ক্ষুধার। কনকনে শীতের এই একেকটি দিন তাদের কাছে পাহাড়ের মতো হয়ে উঠেছে। শীতের হাত থেকে বাঁচতে পথের ধরে খড়কুটো, প্লাস্টিক, টায়ার ইত্যাদি জ্বালিয়ে তারা শীতের কামড় থেকে বাঁচার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে রাজশাহী জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঘুরে ঘুরে কম্বল বিতরণ করা হচ্ছে।

রাজশাহী জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ প্রায় দিনই নিজে ঘুরে ঘুরে ছিন্নমূল শীতার্ত মানুষগুলোর মধ্যে কম্বল বিতরণ করছেন। এখনও কম্বল বিতরণ কর্মসূচি অব্যাহত আছে। এরই মধ্যে রাজশাহী জেলায় ৬৪ হাজার কম্বল বিতরণ করা হয়েছে বলেও জানান, রাজশাহী জেলা প্রশাসক।

অন্যদিকে শীত বাড়ায় রাজশাহীতে ঠাণ্ডাজনিত নানান রোগের প্রাদুর্ভাবও বেড়েছে। আর আক্রান্তদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধদের সংখ্যাই বেশি। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে বর্তমানে নিউমোনিয়া, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট ও ডায়রিয়াসহ শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বছরের স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় দুই-তিনগুণ বেড়েছে। প্রতিদিন সকাল থেকেই রামেক হাসপাতাল, উপজেলা হাসপাতাল ও বেসরকারি ক্লিনিকে রোগীরা চিকিৎসার জন্য ভিড় করছেন।

শীত-জনিত রোগী দিন দিন বাড়ছে উল্লেখ করে রামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক (ইএমও) মো. বিল্লাল হোসেন বলেন, তীব্র শীতের কারণে এখন শিশুরাই বেশি ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়া বয়স্কদের পাশাপাশি বিভিন্ন বয়সীরাও আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের ইনডোর ও আউটডোরে আসছেন। আক্রান্তদের বেশিরভাগই ডায়রিয়া, জ্বর-সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্ট এবং হৃদ্রোগে ভুগছেন।

তাই শীত বাড়ায় শিশু ও বয়স্কদের প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের না করার পরামর্শ দিয়ে ডা. বিল্লাল হোসেন বলেন, এ সময়ে যে কেউ ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। এসব রোগ থেকে রেহাই পেতে গরম কাপড় ব্যবহার, যতটা সম্ভব ঠাণ্ডা পরিবেশ এড়িয়ে চলা জরুরি। শিশুদের ঠাণ্ডা বাতাস থেকে দূরে রাখা, সেইসঙ্গে ধুলোবালি থেকে যতটা সম্ভব দূরে রাখতে হবে। শৈত্যপ্রবাহ চলাকালে শিশুদের ঘর থেকে কম বের করতে হবে। ঘরের মধ্যে ঠাণ্ডা বাতাস যেন না ঢোকে, সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে অভিভাবকদের।

রাজশাহী জেলা সিভিল সার্জন ডা. আবু সাইদ মোহাম্মদ ফারুক বলেন, রাজশাহীর উপজেলা পর্যায়ে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। আর ভর্তি রোগীর চেয়ে বহির্বিভাগে রোগীর সংখ্যাই এখন বেশি। তবে পরিস্থিতি যে খুব খারাপ, এমনটা নয়। প্রতি বছরই শীতের সময় রোগী বাড়ে। তাই তাদের সেরকম ব্যবস্থাপনাও থাকে, এবারও আছে।

রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক আব্দুস সালাম বলেন, বৃহস্পতিবার (১৮ জানুয়ারি) সকাল ৯টায় রাজশাহীর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ১০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরপর শুক্রবার (১৯ জানুয়ারি) রেকর্ড করা হয় ১৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর আজ শনিবার (২০ জানুয়ারি) সকাল ৯টায় রেকর্ড করা হয়েছে ৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

অর্থাৎ হঠাৎ করেই আজ ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা নেমে গেছে। এছাড়া আজকের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হতে পারে বেলা ৩টায়। তবে শুক্রবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ২১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ইনচার্জ) রহিদুল ইসলাম বলেন, জানুয়ারি মাস শুরুর পর থেকে প্রায় বেশিরভাগ সময়ই দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য কম থাকছে। আকাশে রোদ না ওঠায় মেঘমেদুর ও কুয়াশাচ্ছন্নই থাকছে রাজশাহীর আবহাওয়া। আর এর কারণে শৈত্যপ্রবাহ না থাকলেও দীর্ঘসময় ধরে তীব্র শীত অনুভূত হচ্ছে। তবে আজ ফের মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে রাজশাহী অঞ্চলের ওপর দিয়ে।

এছাড়া আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে- শনিবার থেকে রাজশাহীসহ দেশের কিছু অঞ্চলে নতুন করে শৈত্যপ্রবাহ দেখা দিতে পারে। এর ফলে সারা দেশে আজ থেকে আরও বাড়তে পারে শীতের তীব্রতা। আজ মধ্যরাত থেকে আগামীকাল রোববার (২১ জানুয়ারি) সকাল পর্যন্ত দেশের নদী অববাহিকায় মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা থাকতে পারে।

রাজশাহী ছাড়া দেশের অন্য অঞ্চলেও হালকা থেকে মাঝারি মাত্রায় কুয়াশা পড়তে পারে। ইতোমধ্যে দেশের কিছু কিছু অঞ্চলে সামান্য বৃষ্টিপাত হয়েছে। তাই আর বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। মেঘ কেটে যাওয়ায় এখন তাপমাত্রা কমবে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। ফলে সারা দেশেই শীতের অনুভূতি বাড়বে।

রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষক আবদুস সালাম বলেন, শুক্রবার তাপমাত্রা বাড়লেও শনিবারে তা হঠাৎ করে কমতে থাকে। হিমেল বাতাসের কারণে এমনটা হচ্ছে। বাতাসের আর্দ্রতা আছে শতভাগ। গতিবেগ আছে ৪ নটিক্যাল মাইল। দুয়েকদিনের মধ্যে তাপমাত্রা আবারও স্বাভাবিক হয়ে আসবে। তবে এখন এটাকে মৃদ্যু শৈত্যপ্রবাহ বলা যায়।

তাপমাত্রা আট থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয় তবে সেটাকে ধরা হয় মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। তাপমাত্রা এরচেয়ে কমে ছয় থেকে আট ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামলে হয় মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ আর চার থেকে ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে সেটাকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ ধরা হয়। তাপমাত্রা চার ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে সেটা হয় অতি তীব্র শৈত্যপ্রবাহ।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ