রাজশাহীতে কোরবানির জন্য প্রস্তুত সাড়ে তিন লাখ পশু ।। ব্রাহামা নিয়ে বিপাকে খামারিরা

আপডেট: আগস্ট ১২, ২০১৭, ১:২৫ পূর্বাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক


পবার তালিবপুর এলাকয় এক কৃষকের খামারে ব্রাহামা জাতের গরু সোনার দেশ

রাজশাহীতে কোরবানির জন্য প্রস্তুত রয়েছে সাড়ে তিন লাখ পশু। জেলার খামারগুলোতে যে পরিমানে পশু আছে তা কোরবানির চাহিদা পূরণে সক্ষম। এর বাইরেও রয়েছে সাড়ে ৪৩ হাজার উদ্বৃত্ত পশু। তবে ভালো দাম পাওয়া নিয়ে আশঙ্কায় রয়েছেন খামারিরা। ভারতীয় গরু নিয়ে তাদের এ আশঙ্কা বলে জানিয়েছেন খামারিরা।
রাজশাহীর অতিরিক্ত প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা ড. জুলফিকার মো. আখতার হোসেন বলেন, রাজশাহীতে কোরবানির পশুর চাহিদা আছে তিন লাখ ১০ হাজার পশু। আর ছোটবড় মিলে প্রায় ১৭ হাজার খামারে পশু রয়েছে তিন লাখ ৫৩ হাজার ৫০০ পশু। এর মধ্যে গরুর সংখ্যা ৫৬ হাজার ৫১৩, ছাগলের সংখ্যা দুই লাখ ৭৭ হাজার ৪৫০টি, মহিষ এক হাজার ৪৫০টি ও ১৮ হাজার ৫৬৫ ভেড়া মজুদ আছে। চাহিদার তুলনায় পশু বেশি রয়েছে। গতবারের চেয়ে এবার লক্ষ্যমাত্রা বেড়েছে ৫ শতাংশ।
অপরদিকে মাংস উৎপাদনে প্রসিদ্ধ ব্রাহামা জাতের গরু পালনে হিমশিম খাচ্ছেন রাজশাহী অঞ্চলের প্রান্তিক খামারিরা। এ পর্যন্ত জন্ম নেয়া ২৫৬ এঁড়ে এবং ২০৩ বকনা বাছুরের অধিকাংশই চলে গেছে ফড়িয়াদের কব্জায়। খামারিদের ভাষ্য, এ জাতের গরু পালনে বাড়তি খাবার যোগান দিতে গিয়ে বেকায়দায় রয়েছেন তারা। অতিরিক্ত খাবার খেয়ে মোটা হওয়ায় রয়েছে মৃত্যু ঝুঁকিও। ফলে বাধ্য হয়ে বছর পেরুতেই অধিকাংশই খামারি গরু বিক্রি করে দিচ্ছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পাইলট প্রকল্পের অংশ হিসেবে ২০১৪ সালের দিকে রাজশাহী, নওগাঁ ও নাটোর জেলার আট উপজেলায় শুরু হয়েছে ব্রাহামা পালন। এ পর্যন্ত ওই তিন জেলার ৪০০ প্রান্তিক খামারির গোয়ালে এসেছে ২৫৬ এঁড়ে এবং ২০৩ বকনাসহ ৪৫৯টি বাছুর। এর মধ্যে দুই শতাধিক খামারি বিক্রি করে দিয়েছেন গরু।
রাজশাহী কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, শুরু থেকে এ পর্যন্ত কৃত্রিম প্রজনন করা হয়েছে এক হাজার ৪৬০টি গাভী। এর মধ্যে রাজশাহীর পবায় ৮২, পুঠিয়ায় ১৩২, চারঘাটে ৮৪, নাটোর সদরে ১৩৭ ও সিংড়ায় ১৭, নওগাঁ সদরে ৩১০, আত্রাইয়ে ৩১১ এবং রাণীনগরে ৩৮৭টি। গত জুনের পর থেকে নতুন করে প্রজনন করা হয় আরো ৯৫টি। প্রতি উপজেলায় ২০০ জন করে খামারির তালিকা তৈরি করে এ কার্যক্রম শুরু করা হয়। দুটি দেশীয় জাতের গাভী রয়েছে এমন খামারি নেয়া হয়েছে এ তালিকায়। এদের মধ্যে প্রতি উপজেলায় প্রায় ৫০ জন করে খামারির গাভী ব্রাহামা বাছুর প্রসব করেছে। মাংসের ঘাটতি পূরণে পরীক্ষামূলক বিফ ক্যাটল ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প হাতে নেয় সরকার।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২৪ মাস বয়সেই ব্রাহামা জাতের গরু ৮০০ থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার কেজি বা এক টন মাংস উৎপাদনে সক্ষম। এরই মধ্যে উৎপাদনের পদ্ধতি, সফলতা ও জনপ্রিয়তা বিস্তৃত হতে শুরু করেছে। অচিরেই ব্রাহামার বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর সম্ভাবনা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার প্রান্তিক খামারি ইদ্রীস আলীর গোয়ালে রয়েছে ১৬ মাস বয়সি ব্রাহামা জাতের ষাঁড়। সম্প্রতি সেটি পরিদর্শন করে এসেছেন প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা। ওই সময় ষাঁড়টির ওজন ধরা হয় ৩১৬ কেজি। প্রায় সাড়ে ৩০০ কেজি ওজনের আরেকটি ব্রাহামা ষাঁড় রয়েছে জেলার পবা উপজেলার তকিপুর এলাকার খামারি রাশেদুল ইসলামের গোয়ালে। এ দুটি গরু জেলায় কোরবানিযোগ্য বলে মনে করছেন প্রাণিসম্পদ দফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
রাজশাহী বিমানবন্দর সংলগ্ন মহাসড়কের পাশে রাশেদুল ইসলামের খামার। চারটি গাভী রয়েছে তার খামারে। রয়েছে দুই বছর বয়সের একটি এবং ছয় মাস বয়সের আরেকটি ব্রাহামা গরু। পাশেই তার মুদি দোকান। দোকান চালানোর পাশাপাশি ছোট পরিসরে এ খামার গড়ে তুলেছেন তিনি।
রাশেদুল ইসলাম জানিয়েছেন, উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের পরামর্শে তিনি দেশি জাতের একটি গাভীকে কৃত্রিম প্রজনন করান। খামারের দুই বছর বয়সি ব্রাহামা ষাঁড়টি ওই গাভীর প্রসবকৃত। পরে আরেক দফা কৃত্রিম প্রজননে পরের এঁড়ে বাছুরটি প্রসব করে গাভীটি।
রাশেদুল আরো জানান, অন্যান্য গরুর সঙ্গে তিনি ব্রাহামা গরুগুলো লালনপালন করছেন। প্রথমদিকে ঘাস, খড়, ক্ষুদ, ভুসি খাওয়াতেন। কোরবানি সামনে আসায় যোগ করেছেন চিটাগুড় ও মিষ্টি আলু। প্রথম বছর সব মিলিয়ে ওই ষাঁড়ের খাবার বাবদ খরচ হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। শেষ ছয় মাসেই খরচ করেছেন এক লাখের কাছাকাছি। কোরবানি পর্যন্ত নিতে এ গরুর পেছনে তার আরো খরচ হবে আরো অন্ততঃ ৫০ হাজার টাকা। কোরবানির হাটে এ গরুর দাম পড়বে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা। ব্রাহামা পালনে লাভের আশা করছেন তিনি।
তবে দ্রুত বর্ধনশীল এ জাতের গরুর অতিরিক্ত খাবার প্রবণতা রয়েছে বলে জানিয়েছেন ওই এলাকার আরেক প্রান্তিক খামারি আজিমুদ্দিন। বেশি খাবার খেয়ে অতিরিক্ত মোটাতাজা হওয়া তার খামারের এক বছরের একটি ষাঁড় মারা গেছে বলে জানিয়েছেন তিনি। পরে তাকে প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন প্রচণ্ড গরমে হিটস্ট্রোকে মারা গেছে ওই গরু। এতে আতঙ্কিত হয়ে আশেপাশের অনেক খামারি ব্রাহামা গরু বিক্রি করে দিয়েছেন ২৪ মাস পূর্ণ হবার আগেই। উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের সঠিক নজরদারি নেই বলেও অভিযোগ করেন ওই খামারি।
তবে বিষয়টি অস্বীকার করেছেন ওই উপজেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ইসমাইল হক। তথ্য ও পরামর্শ দিয়ে তারা সমসময় খামারিদের পাশে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন ওই কর্মকর্তা।
এদিকে অতিরিক্ত খাবার সরবরাহে হিমশিম খাচ্ছেন নওগাঁর রাণীনগর এলাকার প্রান্তিক খামারিরা। খাবার সরবরাহে ঘাটতি হওয়ায় বাড়তিও কমে যাচ্ছে। ফলে বেশিরভাগ খামারি বছর পেরুনোর আগেই বিক্রি করে দিচ্ছেন ব্রাহামা গরু। এসব গরু কিনে নিয়ে যাচ্ছেন মৌসুমী খামারি ও ফড়িয়ারা। তারা লালনপালন করে তুলছেন বাজারে।
একসময় রাণীনগর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন সেলিম উদ্দিন। এখন তিনি কর্মরত নাটোর সদর প্রাণিসম্পদ দফতরে। তিনি জানিয়েছেন, যারা দেশি গাভী পালন করেন তাদের অধিকাংশই স্বল্প পুঁজির খামারি। ফলে তাদের পক্ষে ব্রাহামা পালন সত্যিই কষ্টসাধ্য। ফলে বাধ্য হয়ে তারা সময়ের আগেই বিক্রি করছেন গরু। শুরুতে এ প্রকল্পে খামারিদের প্রণোদনা দেয়া হতো। এখন সেটি হয় না। তারা দাবি জানিয়ে আসছেন, প্রণোদনা আবারো চালুর।
বিষয়টি স্বীকার করেছেন রাজশাহীর রাজশাহী কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আহমেদ ইকবাল বলেন, খামারিদের তারা কেবলই তালিকাভুক্ত খামারিদের সিমেন সরবরাহ করেন। এরপর থেকে উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর নজরদারিতে রাখে গাভীগুলো।
তিনি আরো বলেন, ব্রাহামা গরু উৎপাদনে দেশীয় সুস্থ সবল একটি গাভীর প্রয়োজন হয়। ওই গাভীর গর্ভাশয়ে সিমেন বা শুক্রাণু প্রবেশ করানো হয়। গাভী থেকে প্রসবকৃত বাছুর ব্রাহামা গরু হিসেবে পরিণত হবে। বিশেষ খাবার ছাড়াই এ বাছুর স্বাভাবিক নিয়মেই বেড়ে উঠবে। বর্তমানে তাদের কাছে দুই হাজারের মত সিমেন মজুদ রয়েছে। চাহিদামত সরবরাহ করছেন তারা।
প্রকল্প শুরুর আগে মাঠ নিরীক্ষা হয়নি বলে স্বীকার করেন আহমেদ ইকবাল। তিনি বলেন, পরীক্ষামূলকভাবে এ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। খামারি নির্বাচনেও নানান প্রতিবন্ধকতা ছিলো। তারপরও তারা কাজ শুরু করেছেন। সফলতা আসছে ধীরে ধীরে। খামারিদের আর্থিক প্রণোদনা দেয়া গেলে ব্রাহামা পালনে গতি আসবে বলে মত দেন তিনি।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ