নিজস্ব প্রতিবেদক
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া গভীর নিম্নচাপে রাজশাহীতে গেল দুইদিন থেকে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। ২৪ ঘণ্টায় ২৫ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। একটানা বৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন নিম্নআয়ের খেটে খাওয়া মানুষ। কখনও গুঁড়ি গুঁড়ি আবার কখনও মুষলধারে বৃষ্টিতে নগরীর নিম্ন এলাকাগুলোতে জলবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। এতে সাময়িক দুর্ভোগের মুখে পড়তে হয়েছে নগরবাসীকে।
রাজশাহীর বেশ কিছু এলাকায় ফসলের ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ক্ষতি বলতে নারাজ। কৃষি দফতর বলছে, বৃষ্টিতে সব রকম ফসলের উপকার হয়েছে। ঝড়ো বাতাসে খুব একটা ক্ষতি হয়নি।
পবা উপজেলার দর্শনপাড়া ইউনিয়নের কৃষক ফজর মিয়া (৪৮) বলেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় চলতি মৌসুমে রোপা আমন ধানের বাম্পার ফলন ভালো আশা করছিলাম। কিন্তু হঠাৎ অবিরত বৃষ্টি ও বাতাসে ধান খেত নুয়ে গেছে।
আরেক কৃষক আব্দুল মতিন জানান, তিনি ছয় একর জমিতে আমন ধান চাষ করেছিল। দুই একরে চিনিগুড়া ও চার একরে রঞ্জিত জাত। বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এবার অনেক ভালো ফলন হয়। কিন্তু দুই দিনের বৃষ্টির কারণে কাক্সিক্ষত ফসল ঘরে তোলা নিয়ে তিনি চিন্তিত।
আবহাওয়ার পূর্বাভাসে সোমবার (১৬ সেপ্টেম্বর) রংপুর, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের অনেক জায়গায় এবং ঢাকা, ময়মনসিংহ, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় বৃষ্টির সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। তবে ওইদিন সারাদেশে দিন এবং রাতের তাপমাত্রা ১-৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। বৃষ্টির মাত্রা কিছুটা কমবে মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর)। ওই দিন বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও খুলনা বিভাগের দু-এক জায়গায় বৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া সারাদেশে দিন এবং রাতের তাপমাত্রা ১-২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেতে পারে।
রাজশাহী নগরীর রিকশাচালক আব্দুর রশিদ বলেন, বৃষ্টিতে রাস্তায় রিকশা কম, যাত্রীও কম। তবে ভাড়া তুলনামূলক ভালো হচ্ছে। যাত্রীরা ১০ থেকে ১৫ টাকা বেশি ভাড়া দিচ্ছে বৃষ্টির কারণে। সবমিলে বিকেলে সাড়ে ৩ টা পর্যন্ত তার ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা উপার্জন হয়েছে।
রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষক আনোয়ার বেগম বলেন, রাজশাহীতে গত ২৪ ঘণ্টা অর্থাৎ শনিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) বিকেল চারটা থেকে রোববার (১৫ সেপ্টেম্বরর) একই সময় পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়েছে ২৫ দশমিক ৬ মিলিমিটার। আর রোববার সকাল ৬টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত বৃৃষ্টিপাত হয়েছে ১১ দশমিক ৮ মিলিমিটার। এছাড়া শনিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) বৃষ্টিপাত হয়েছিল ৫ দশমিক ২ মিলিমিটার। এছাড়া শুক্রবার (১৩ সেপ্টেম্বর) বৃষ্টিপাত হয়েছিল ৭২ দশমিক ২ মিলিমিটার।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক উম্মে সালমা বলেন, এই বৃষ্টি ফসলের জন্য উপকারি। ঝড়ো বাতাসেও খুব একটা ক্ষতি হয়নি। এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব।
দুর্গাপুর প্রতিনিধি জানান, দুর্গাপুর উপজেলায় গত দুই দিনের ঝড়ো হাওয়া, গুড়ি গুড়ি ও ভারী বৃষ্টিতে কাঁচা ঘরবাড়ি, গাছপালা রাস্তা-ঘাট, পানবরজ, সবজি খেতসহ বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। শনিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) ও রোববার (১৫ সেপ্টেম্বর) গুড়ি গুড়ি ও থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে আলোর মুখ দেখা যায়নি। ঘর থেকে বের হতে পারেনি মানুষজন।তবে প্রয়োজনে বৃষ্টি উপেক্ষা করেও ঘর থেকে অনেকেই বের হতে দেখা যায়।
রোববার (১৫ সেপ্টেম্বর) দুর্গাপুর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, টানা বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়ায় পানবরজ ভেঙে পড়ে, রাস্তার পার্শ্ব ঘেষে রোপনকৃত সরকারি বড় বড় গাছ উপড়ে পড়ে, চলাচলের রাস্তা ভেঙে গিয়ে, শীতকালের আগাম সব্জি খেতে পানি বেঁধে প্রায় ৫কোটি টাকার ওপরে ক্ষতি হয়েছে বলে ধারনা করছেন কৃষকরা।
উপজেলার দেলুয়াবাড়ী ইউনিয়নের কিশোরপুর পশ্চিমপাড়ার আবুল কালামের পানবরজ গত রোববার ভোররাতের ঝড়ো হাওয়ায় ভেঙে পড়ে গিয়েছে, এতে তার প্রায় ৯ লক্ষ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানান ভূক্তভোগী আবুল কালাম।
জয়নগর ইউনিয়নের হরিরামপুর দক্ষিনপাড়ার মকছেদ আলীর তিনকক্ষ বিশিষ্ট টিনের ছাঁউনির কাঁচা ঘর বৃষ্টিতে ঢসে পড়ে ভেঙে গেছে, একই ইউনিয়নে পারিলা পূর্বপাড়া হয়ে মাড়িয়া যাওয়ার রাস্তায় বাচ্চু, ভোলার বাড়ির পার্শ্বে পাকা রাস্তার ধারের শতবর্ষী কড়াই গাছটি রোববার সকাল ৮ টার দিকে পার্শ্বের পানবরজের ওপর উপড়ে পড়েছে। এতে পানবরজ ও প্রায় পুরো রাস্তা ভেঙ্গে গিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সব্জিখ্যাত জয়নগর ইউনিয়নের চুনিয়াপাড়া, বড়গাছি, বেড়া, গগনবাড়ীয়া, বাজুখলশী, কিশোরপুর এলাকার সবজি চাষিরা শীতকালীন ফুলকপি, বাঁধাকপি, সিম, লাউ সহ আগাম শাকসবজি চাষ করেছেন। গত দুই দিনের টানা বৃষ্টিতে প্রতিটির জমিতে পানি বেঁধে যাওয়ায় এবং পানি নিষ্কাশনের পথ না পাওয়ায় গাছগুলো প্রায় মরতে বসেছে। এতে ধরাশায়ী হয়ে গেছেন ওই এলাকার শতশত সব্জিচাষী। এতে এলাকার কৃষকদের প্রায় ২কোটি টাকার ওপরে ক্ষতি হয়েছে বলে জানান চুনিয়া পাড়া গ্রামের সব্জি চাষি নয়ন আলী।
পৌর এলাকার সিংগা গ্রামের কৃষক আরিফুল ইসলাম বলেন, দেড় বিঘা জমিতে আগাম পেঁয়াজ রোপনের জন্য জমি তৈরি করেছি এবং ১০ কাঠা জমিতে রোপন করেছি। গত দুইদিনের টানা বৃষ্টিতে তৈরিকৃত জমি নষ্ট হয়ে গেছে, এই জমিতে আগামী ১৫ দিনেও পেঁয়াজ রোপনের উপযোগী হবে না। আর রোপনকৃত পেঁয়াজের জমিতে বৃষ্টির পানি বেঁধে থাকার কারণে তা পঁচে নষ্ট হয়ে যাবে। এতে আমার প্রায় লক্ষ টাকার ক্ষতি হলো। শুধু আমি নয়, অর্ধ্বশত চাষীর একই অবস্থা।
পলাশবাড়ী গ্রামের মরিচচাষি বেশারত আলী বলেন, আমি প্রতিবছরের নেই এবারও অন্যের জমি লিজ নিয়ে দেড় বিঘা জমিতে মরিচ চাষ করেছি। জমির লিজ মূল্য, চাষ, সার, ঔষধ, চারা, সেচ ও পরিচর্যায় এই পর্যন্ত আমার পৌনে দুই লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছে। বাজারে দাম ভালো থাকলে জমি থেকে ৮ থেকে ১০ টাকার মরিজ বিক্রি করার আশা ছিলো। দুই সপ্তাহ থেকে মরিচ বাজারে বিক্রিও শুরু করেছি। কিন্তু হঠাৎ করে দুই দিনের গুঁড়ি গুঁড়ি ও ভারী বর্ষণে মরিচের খেতে পানি জমেছে।
এদিকে টানা দুইদিনের বৃষ্টিতে ঘর থেকে বের হতে না পেরে চরম বিপাকে পড়েছেন খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষগুলো।
মাড়িয়া গ্রামের দিনমজুর আকছেদ আলী জানান, পরিবারে ৪জন সদস্যের একমাত্র উপার্জনকারী তিনি। প্রতিদিন ভোরে ফজরের নামাজ পড়ার পর সাইকেলে কোদাল ও ডালি বেঁধে নিয়ে শহরে যান দিনমজুরি করতে, দিন এনে দিন খাওয়া পরিবার আমার, দুইদিন থেকে কাজে যেতে না পারায় অতিকষ্টে পরিবার পরিজন নিয়ে দিন কাঁটছে।
দুর্গাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কুন্তলা ঘোষ বলেন, দুই দিনের গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে উঠতি ফসলে কিছু সাময়িক সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে আজ কালের মধ্যে আবহাওয়া ভালো হয়ে গেলে ফসলের তেমন কোনো ক্ষতি হবে না।