নিজস্ব প্রতিবেদক :
রাজশাহীতে আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত ১৪ বছরের উন্নয়ন কর্মকান্ডের চিত্র তুলে ধরে লাখো মানুষের জনসমুদ্রে ‘নৌকা মার্কায়’ ভোটের ওয়াদা নিলেন দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা ও সুশাসন নিশ্চিতে নৌকা প্রতীকে ভোট চেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি কথাই কথায় বলে, ‘আওয়ামী লীগ পালাবার জায়গা পাবে না। পালাই কে? আমি বাঁধা অতিক্রম করেই দেশে ফিরে আসি। আওয়ামী লীগ কখনো পালায় না। পিছু হটে না। ওই জিয়াউর রহমান বাধা দিয়েছিল দেশে আসতে দেবে না। ২০০৭ সালে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসে, তখনো আমাকে দেশে ফিরতে দেবে না। আমি জোর করে দেশে ফিরে এসেছিলাম। আমার বিরুদ্ধে মার্ডার কেস দেওয়া হয়েছিল। আমি বলেছিলাম, আমি যাব এই কেস মোকাবিলা করব। আমি দেশে ফিরে এসেছি শুধুমাত্র এই বাংলার মানুষের কথা চিন্তা করে। আগামী নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়ে এদেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে আবারও এদেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের সুযোগ করে দিবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন সরকার প্রধান।
রোববার (২৯ জানুয়ারি) দুপুর ৩ টায় রাজশাহীর মাদ্রাসা মাঠে জনসভায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী রাজশাহী জেলার ২৬টি সমাপ্ত উন্নয়ন প্রকল্প কাজের উদ্বোধন ও ৬টি উন্নয়ন প্রকল্প কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এরআগে সকালে চারঘাট উপজেলার সারদা পুলিশ একাডেমিতে ৩৮তম বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডারের শিক্ষানবিশ সহকারী পুলিশ সুপারদের প্রশিক্ষণ সমাপনীতে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী।
আওয়ামী লীগের বিভাগীয় সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শেখ হাসিনা আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশকে ক্ষুধামুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তা করে যেতে পারেন নি। কারণ তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমি কৃতজ্ঞতা জানাই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতি। আমার অবর্তমানে আমাকে সভাপতি নির্বাচিত করে। আমি এই দেশে ফিরে আসি এমন একটি দেশে, যেখানে আমার কোনো বিচার চাওয়ার অধিকার ছিল না। জাতির পিতার খুনিদেরকে ইন্ডেমনিটি দিয়ে বিচারের হাত থেকে রেহাই দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমতায় বসানো হয়। সেই অবস্থায় আমি দেশে ফিরে আসি শুধু বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য ফেরানোর লক্ষ্য নিয়ে। সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে, যেভাবে আমার বাবা জাতির পিতা চেয়েছিলেন এই বাংলাদেশকে গড়তে।
শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি আজকে বলে, পালানোর সুযোগ পাবে না আওয়ামী লীগ। আমি তাদের বলতে চাই আওয়ামী লীগ পালায় না, পালায় আপনাদের নেতারা। বিএনপির নেতারা কে? বিএনপি নাকি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করবে। কাকে নিয়ে? দুর্নীতিতে সাজাপ্রাপ্ত তাদের, এখন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, যে নাকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে স্ট্যাম্প কাগজে মুচলেকা দিয়েছিল, আর কখনো রাজনীতি করবে না বলে। দেশ থেকে ভেগে গিয়েছিল, সেই কথা কি আমাদের বিএনপি নেতাদের মনে নেই। দুর্নীতিতে সাজাপ্রাপ্ত খালেদা-তারেক। খালেদা জিয়া তারেক-কোকোর মাধ্যমে যে টাকা পাচার করেছিল মানি লন্ডারিং করে। তার ৪০ কোটি টাকা আমরা বাংলাদেশে ফেরত নিয়ে এসেছি। এর জবাব কি তারা দিতে পারবে? আওয়ামী লীগ কখনো পালায় না, আওয়ামী লীগ জনগণকে নিয়ে কাজ করে। এই সংগঠন জাতির পিতার হাতে গড়া সংগঠন। এই সংগঠন যখনই ক্ষমতায় এসেছে, দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, আজকে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। ৪০ ভাগ দারিদ্র্যসীমা আমরা ২০ ভাগে নামিয়েছি। বয়স্কভাতা, বিধবাভাতা, দুস্থ মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, সমস্ত ভাতা দিয়ে যাচ্ছি। মা-বোনদের মাতৃত্বকালীন ভাতা আমরা দেই। আমাদের এই দেশের একটা মানুষও গৃহহীন-ভূমিহীন থাকবে না। প্রত্যেকটা মানুষকে বিনা পয়সায় দুই কাঠা জমিসহ ঘর করে দিচ্ছি, যারা বাকি আছে তাদেরও করে দেব। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দেশে কোনো মানুষ গৃহহীন থাকবে না। কোনো মানুষ না খেয়ে থাকবে না। এই লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী রাজশাহীতে বর্তমান সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডের চিত্র তুলে ধরে বলেন, সেই ২০০১ সালের কথা চিন্তা করেন। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায়। প্রতিনিয়ত রাজশাহীতে খুন, হত্যা, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, নারী ধর্ষণ, নির্যাতন। এই রাজশাহীতে ফাহিমা, মহিমা, নাজুফা কীভাবে তাদের ওপর পাশবিক অত্যাচার করেছে ওই বিএনপি ক্যাডার বাহিনী এবং জামায়াত জোট। একটা বাচ্চা মেয়ে, গ্যাং রেপ করা হলো। তার বাবা মা নৌকায় ভোট দিয়েছিল সেই কারণে। আরে নৌকায় ভোট না দিলে দেশ স্বাধীন হতো না। দেশ স্বাধীন না হলে ওদের নেতা জিয়াউর রহমান মেজর থেকে মেজর জেনারেলের প্রমোশন পেত না। এটা তারা ভুলে যায়। দেশ স্বাধীন না হলে কোনো দিন ক্ষমতায় আসতে পারত না খালেদা জিয়া। প্রধানমন্ত্রী হতে পারত না। নৌকার ওপর এত রাগ কেন? নৌকায় ভোট দিয়ে মানুষ কি পায়? আজকে খাদ্যের নিরাপত্তা পাচ্ছে। পড়ালেখার নিশ্চয়তা পাচ্ছে। রোগে চিকিৎসা পাচ্ছে। কমিউনিটি ক্লিনিক করে দিয়েছি বাড়ির কাছে। মা-বোন হেঁটে গিয়ে চিকিৎসা পেতে পারেন। সেই ব্যবস্থা আওয়ামী লীগ সরকার করে দিয়েছে। বিনা পয়সায় ৩০ প্রকার ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। আগামীতে সেখানে যেন ডায়াবেটিস পরীক্ষা হয়, প্রেশার পরীক্ষা করা যায়, আমরা ইনসুলিন দেওয়ারও ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। সেইভাবেই আমরা মানুষের সেবা করি। নৌকায় ভোট দিয়েছেন বলেই দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। আর রাস্তাঘাট, একই দিনে ১০০ সেতু, একই দিনে ১০০ সড়ক কোন সরকার করতে পেরেছে? কোনো সরকার না। আওয়ামী লীগ সরকার, নৌকা মার্কার সরকার করে দেখিয়েছে।
করোনাকালে সরকারের নেয়া নানা পদক্ষেপ তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, করোনাকালীন সময় যখন সবকিছু বন্ধ। আমরা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিলাম বলে, বিনা পয়সায় করোনা টেস্ট করার ব্যবস্থা, বিনা পয়সায় ভ্যাকসিন দিয়েছি। পৃথিবীর ধনী দেশও তো দেয় নাই। এই আওয়ামী লীগ সরকার দিয়েছে। কোনো পরিবার যেন কষ্টে না থাকে সেদিকে বিবেচনা করেছি। এখন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ও করোনার কারণে বিশ্বব্যাপি মুদ্রাস্ফীতি। যে জিনিস ছয় ডলারে কিনতাম, তা কিনছি ৬৮ ডলারে। যে জিনিস ২০০ ডলারে কিনতাম, তা কিনছি ৬০০ ডলারে। তারপরও আমরা থেমে থাকি নি। আমরা এক কোটি মানুষের জন্য টিসিবির কার্ড করে দিয়েছি। মাত্র ৩০ টাকা কেজিতে চাল কিনতে পারবেন। যারা নিম্নবিত্ত, তারা ১৫ টাকা কেজিতে চাল নিতে পারবেন। যারা একেবারে হতদরিদ্র তাদের বিনা পয়সায় ভিজিডি-ভিজিএফের মাধ্যমে বিনা পয়সায় ৩০ কেজি করে চাল দিয়ে যাচ্ছি। চাল, ডাল, তেল, চিনি প্রত্যেকটা জিনিস অতিরিক্ত দাম দিয়ে কিনে আনলেও আমরা কমমূল্যে সাধারণ মানুষকে দিচ্ছি যেন মানুষের কষ্ট না হয়।
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, আমরা প্রত্যেকটা মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। এমনকি প্রথমবার সরকারে এসে আমরা খাদ্য নিরাপত্তা থেকে শুরু করে কমিউনিটি ক্লিনিক, আমার বাড়ি আমার খামার করে দিয়েছি। ক্ষুদ্র সঞ্চয় ব্যবস্থা করে দিয়েছি। পল্লি সঞ্চয় ব্যাংক করে দিয়েছি। সেই সঙ্গে সঙ্গে মসজিদ-ভিত্তিক শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। মসজিদ-মন্দির যেন প্রাথমিক শিক্ষা দিতে পারে ধর্মীয় শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে। ইমাম-মোয়াজ্জিনদের জন্য কল্যাণ ট্রাস্ট করে দিয়েছি। আমরা ডিজিটাল কোরআন শরীফ করে দিয়েছি, যেখানে আরবীতে লেখা থাকবে, বাংলায় উচ্চারণ তর্জমাসহ সেটি আওয়ামী লীগ সরকার করে দিয়েছে। ৫৬০টা মডেল মসজিদ করে দিচ্ছি। কোন সরকার করেছে? বিএনপি ছিল, খালেদা জিয়া-জিয়া এসব কেউ করেছে? কেউ করেনি। করেছে শুধু আওয়ামী লীগ।
শেখ হাসিনা বলেন, করোনাকালীন সময়ে ইমাম-মোয়াজ্জিনদের জন্য নগদ অর্থ সহায়তা করেছি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিশেষ তহবিল থেকে। সাধারণ মানুষকেও আমরা অর্থ সহায়তা দিয়েছি। আওয়ামী লীগ জনগণকে দিতে আসে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে জনগণ পায়। এটা হলো বাস্তব কথা। আমরা চাই এই দেশ এগিয়ে যাক। দেশকে উন্নত করতে চাই। আমরা মানুষের জন্য কাজ করি। আর বিএনপি ওরা কি করে? মানুষ খুন করা, অগ্নি সন্ত্রাস ছাড়া। ৩ হাজার ৮০০ বাস, ২৯টা ট্রেন, লঞ্চ, প্রায় ৭০টা সরকারি অফিস, ছয়টা ভূমি অফিস তারা আন্দোলনের নামে পুড়িয়েছে। আমি জানি না, আপনারাই বিবেচনা করেন, কোন মানুষ জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারতে পারে? এই বিএনপি জামায়াত কীভাবে জীবন্ত মানুষগুলিকে পুড়িয়ে মেরেছে। শুধু সাধারণ মানুষ না। পুলিশকে মাটিতে ফেলে এই রাজশাহীতে পিটিয়েছে! অমানবিক চরিত্র তাদের। তারা মানুষ চেনে না। তারা মানুষের জন্য কিছু করে না। তাদের কাজ খালি নিজে লুটেপুটে খাবে।
বিএনপির সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, অনেকে আপনারা জানেন না, জিয়াউর রহমান যখন মারা গেল, তখন দেখা গেল কি? কিছু রেখে যায় নাই। একটা ভাঙা স্যুটকেস আর ছেঁড়া গেঞ্জি ছাড়া। পরে দেখা গেল, সে ভাঙা স্যুটকেস কোথায়! খালেদা জিয়ার মূল্যবান শাড়ি ফ্রান্স থেকে কিনে আনে। এত টাকা চুরি করে বিদেশে পাচার করেছে যে, এখন যান আপনারা দেখবেন কীভাবে আয়েশি জীবনযাপন করেছে আর আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি সেই ডিজিটাল মাধ্যমে আমাদের গীবত গায়, আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়। আর মানুষকে উসকানি দেয়, এটাই তাদের কাজ। বাংলাদেশের মানুষের কোনো ভালো তারা সহ্য করতে পারে না।
এটা হলো বাস্তবতা। এরা অপকর্ম-লুটপাট করতে পারে। বাংলা ভাই সৃষ্টি করে এই রাজশাহীতে অস্ত্রসহ প্রকাশ্যে দিবালোকে তারা মিছিল করে, আর পুলিশ দেয় তাদের পাহারা। অবৈধ অস্ত্র নিয়ে মিছিল করে পুলিশ পাহারা দেয়। এই তো খালেদা জিয়া। তাদের দুর্নীতি-অনিয়ম, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, যার ফলে বাংলাদেশে ইমার্জেন্সি ডিক্লেয়ার হয়। তাছাড়া কোনো কারণ ছিল না। তাদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কারণেই এটা হয়েছে। তারা সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ ছাড়া কিছু বোঝে না। আওয়ামী লীগ সরকার থাকলে মানুষের শান্তি থাকে। দেশের উন্নতি হয়। আমরা যে ওয়াদা দেই, তা রক্ষা করি।
রাজশাহী মহানগর ও জেলা আওয়ামী লীগের আয়োজনে সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন, মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোহাম্মদ আলী কামাল। জনসভায় বক্তব্য রাখেন, পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রহমান, প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন ও জাহাঙ্গীর কবির নানক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এমপি, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন এমপি, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নুরুল ইসলাম ঠান্ডু, বেগম আখতার জাহান, সাবেক প্রতিমন্ত্রী বেগম আখতার জাহান প্রমুখ।