নিজস্ব প্রতিবেদক:
রাজশাহীতে গেল ৫ বছরের অন্তত দেড় হাজার ধর্ষণ মামলা হয়েছে। তবে মামলাগুলোর বিচার কার্যক্রম চলছে ধীরগতিতে। ধীরগতির অন্যতম কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন- ডিএনএ ও ডাক্তারি পরীক্ষার প্রতিবেদন সহজে না পাওয়া। ফলে তদন্ত শেষ করলেও আদালতে চার্জশিট দাখিল করতে পাওে নি পুলিশ। এছাড়া প্রতিবেদন নিয়ে জটিলতা, বাদি-বিবাদির আপস, মীমাংসা, সাক্ষী গড়হাজিরসহ নানা কারণে পার পেয়ে যাচ্ছে ধর্ষণ মামলার এসব আসামিরা।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, রাজশাহীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ১ ও ২ এ বর্তমানে অন্তত সাড়ে ৩ হাজার মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এরমধ্যে ধর্ষণের মামলা রয়েছে দেড় হাজার।
জানা গেছে- ২০২২ সালে নগরীর কাশিয়াডাঙ্গা থানায় পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়। ওই মামলার বাদির অভিযোগ, শুরুতে থানা পুলিশ তদন্ত শুরু করে। শুরু থেকেই তদন্ত প্রক্রিয়া চলতে থাকে ধীরগতিতে। পরে তদন্ত কর্মকর্তার আচরণ রহস্যজনক মনে হলে তিনি আদালতে তদন্তকারী সংস্থা পরিবর্তনের জন্য আবেদন করেন। এতে তদন্তে দায়িত্ব পান পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
বাদি জানান, তদন্ত শেষে দুজনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট জমা দেয় পিবিআই। চার্জশিটে উল্লেখ করে, ঘটনার ৮ মাস পর ডিএনএ পরীক্ষা করায় ভুক্তভোগী ছাত্রীর সাথে ধর্ষণ প্রমাণিত হয়েছে। তবে দীর্ঘসময় অতিবাহিত হওয়ায় ওই ছাত্রীর জামা, ওড়না ও পায়জামা পরীক্ষা করেও আসামিদের ডিএনএ পাওয়া যায়নি। আলামত নিয়ে গড়িমসি করায় এখন বিচার নিয়ে শঙ্কায় ওই ছাত্রীর অভিভাবকরা।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর অধীনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদ- এবং ডিএনএ পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করে তৎকালীন সরকার। এরপর থেকে গেল ৫ বছরে রাজশাহী বিভাগীয় স্ক্রিনিং ল্যাবরেটরির মাধ্যমে ১ হাজার ২৫৮টি ধর্ষণ মামলার নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকায় পাঠানো হয়। ঢাকার ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরিতে (এনএফডিপিএল) নমুনা পরীক্ষা হয়। সারাদেশের নমুনা একটি স্থানে পরীক্ষাসহ নানা প্রতিবন্ধকতায় ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে জট ও জটিলতা।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গেল ৫ বছরে ১ হাজার ২২৪টি ধর্ষণ মামলার নমুনা ডিএনএ টেস্টের জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়। এরমধ্যে ২০২০ সালে ২৫৬টি ধর্ষণ মামলা, ২০২১ সালে ২৩০টি ধর্ষণ মামলা, ২০২২ সালে ২৭২টি ধর্ষণ মামলা, ২০২৩ সালে ২০৫টি ধর্ষণ মামলা, ২০২৪ সালে ২৬১টি ধর্ষণ মামলা। আর সর্বশেষ ২০২৫ সালে চলতি মার্চ পর্যন্ত ৩৪টি ধর্ষণ মামলার নমুনা ডিএনএ টেস্টের জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মুখপাত্র ডা. শংকর কে বিশ্বাস বলেন, বিভাগীয় স্ক্রিনিং ল্যাবরেটরিতে শুধুমাত্র নমুনা সংগ্রহ করা হয়। একমাত্র ঢাকায় প্রোফাইলিং হয়। অন্যদিকে ধর্ষণের একটি মামলাতেই নমুনা থাকে অনেকগুলো। ভুক্তভোগীর পোশাক, ঘটনাস্থলের যেকোনো জিনিস ইত্যাদি। নমুনা বেশি হওয়ায় পরীক্ষায় বেশি সময় লাগে।
রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার ও মিডিয়া মুখপাত্র সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন পেতে এক বছর থেকে দেড় বছর পর্যন্ত কখনও কখনও অপেক্ষা করতে হয়। অন্যদিকে মামলার আলামত সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করা, দ্রুত ডাক্তারি পরীক্ষা ও ডিএনএ প্রতিবেদন না পাওয়ায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আটকে থাকছে তদন্ত। তদন্ত স্থবির হয়ে থাকায় নষ্ট হচ্ছে আলামত, দীর্ঘ সূত্রিতার সুযোগ নিচ্ছে আসামিরা।
অসচ্ছল মানুষদের বিনামূল্যে আইন সহায়তা দেয়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) রাজশাহী জেলার সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট সামিনা বেগম বলেন, ধর্ষণের মামলাগুলো দীর্ঘায়িত হওয়ার অন্যতম কারণ ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন সহজে না পাওয়া। এছাড়াও বাদি-আসামিপক্ষের আপস মীমাংসা, বিচারের ধীরগতি, তদন্তে গাফিলতি, মিথ্যা সাক্ষ্য, সাক্ষীর গড়হাজিরসহ নানা কারণে আসামিরা খালাস পাচ্ছেন।
রাজশাহীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ পিপি অ্যাডভোকেট শামসাদ বেগম মিতালী বলেন, ধর্ষণের মামলাগুলো তালিকা স্পেশাল গুরুত্ব বিবেচনা করলে দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া শেষ হবে। ডিএনএ এবং ডাক্তারি পরীক্ষার প্রতিবেদন দ্রুত দেয়ার জন্য সরকারের বিশেষ উদ্যোগ প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।