রাজশাহীতে বাঁধভাঙা আনন্দ ও উচ্ছ্বাসে ঋতুরাজ বসন্তের বরণ

আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২৪, ১১:০৩ অপরাহ্ণ


নিজস্ব প্রতিবেদক ও রাবি প্রতিবেদক:বাঁধভাঙা আনন্দ ও উচ্ছ্বাসে রাজশাহীতে ঋতুরাজ বসন্তকে বরণ করে নেওয়া হয়েছে। বুধবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) পহেলা ফাল্গুনের সকাল থেকেই বসন্তবরণ উৎসবে মুখরিত হয়ে উঠে রাজশাহী মহানগরী। পাশাপাশি ছিল ভালোবাসা দিবস এবং সরস্বতী পূজাও।

বুধবার সকাল বাঁধভাঙা থেকে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষ ভিন্ন আবহে প্রাণ উজাড় করে যোগ দিয়েছেন বসন্তবরণ উৎসবে। ঐতিহ্যবাহী ও তিনবারের দেশসেরা রাজশাহী কলেজে বাসন্তী রঙের বর্ণিল শোভাযাত্রা, কবিতাপাঠ, নাচ আর গানের ছন্দে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে চলে ফাল্গুনী উৎসব।

পহেলা ফাল্গুন উপলক্ষে সকালে রাজশাহী কলেজ থেকে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করা হয়। এতে কলেজের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। বাদ্য-বাজনার ছন্দে ছাত্রীদের হলুদ শাড়ি আর ছাত্রদের হলদে পাঞ্জাবি বরণে শোভাযাত্রাটি পুরো শহরে জানান দেয় বসন্তের প্রথম দিন। শোভাযাত্রাটি মহানগরীর বিভিন্ন প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে আবারো কলেজে গিয়ে শেষ হয়। এখানে দিনভর নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

এছাড়া মহানগরীর বিভিন্ন বিনোদন স্পটে তরুণ-তরণীসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষের ঢল নামে। মেয়েদের পরনে হলুদ রঙের শাড়ি, খোপায় গাঁদা ফুল, আবার কারও কারও খোপায় রঙিন ফুলের রিং। ছেলেদের পরনে ছিল হলুদ অথবা সফেদ রঙের পাঞ্জাবি। বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে ঘুরতে গিয়ে মোবাইল ফোন দিয়েই অনেকে ফটোসেশনে অংশ নেন। বন্ধুদের নিয়ে জটলা করে ফোনের ক্যামেরায় সেলফি তুলেও তা স্মৃতিবন্দি করেছেন অনেকে।
বুধবার সকাল থেকে নগরীর শহিদ এএইচএম কামরুজ্জামান উদ্যান, শহীদ জিয়া পার্ক, বড়কুঠি পদ্মাপাড়ে, টি-বাঁধ, পদ্মা গার্ডেনসহ অন্যান্য বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়। সকালেই কেউ বন্ধু-বান্ধবীকে নিয়ে, কেউ প্রিয়তম, কেউ আবার পরিবার-পরিজন নিয়ে বিভিন্ন বাহনে ঘুরে বেড়ান শহরের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে।

এদিকে শীতের শেষে প্রকৃতি সাজে আপন মহিমায়। পলাশ, শিমুলসহ বর্ণিল ফুলে রঙিন হয়ে ওঠে চারপাশ। সেই রঙের পরশ ছড়িয়ে পড়ে প্রকৃতিপ্রেমীদের মনে। সেই টানে হলুদ, বাসন্তী রঙের শাড়ি, নজরকাড়া পাঞ্জাবি পরে এবং রঙিন ফুলে নিজেদের সাজিয়ে নানা বয়সের মানুষ হাজির হয়েছিলেন রাবি ক্যাম্পাসে। গানের তালে তালে চলে নৃত্য পরিবেশনা। সেইসঙ্গে আবৃত্তি, লোকগান মাতিয়ে রাখে সবাইকে। রাবিতে মূল আয়োজন ছিল চারুকলা অনুষদ প্রাঙ্গণে। এছাড়াও বিভিন্ন বিভাগের পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয়েছিল বসন্ত উৎসবের। ফলিত রসায়ন ও রসায়ন প্রকৌশল বিভাগ এবং মার্কেটিং বিভাগের পক্ষ থেকে র্যালি বের করা হয়। আয়োজন ছিল গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগেও।

চারকলা প্রাঙ্গণে বুধবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকেই মূলত শুরু হয় বসন্তের এ অনুষ্ঠান। তবে, আনুষ্ঠানিকভাবে দুপুর ১টায় আলোচনা সভার মধ্য দিয়ে শুরু হয় এর আনুষ্ঠানিকতা। এরপর ২টার দিকে একটি র‌্যালি ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে। পর্যায়ক্রমে পিঠা বিলি ও কাথা পোড়ানোর মধ্য দিয়ে শীতকে বিদায় জানানো হয়। এরপর রঙ খেলায় মেতে ওঠেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। বিকেল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। গান আর নৃত্যের তালে তালে বসন্তকে অভিবাদন জানানো হয়।

বসন্ত উৎসবে আসা শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষ, সবার পোশাকেও ছিল বাসন্তী সাজ। রাবি ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়িয়েছেন তারা। চারুকলা প্রাঙ্গণ, টিএসসিসি, ইবলিশ চত্বর, প্যারিস রোড, পরিবহন মার্কেট ও শহীদ মিনারসহ পুরো এলাকায় বাসন্তী সাজে দেখা যায় অধিকাংশকে। ‘বাতাসে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিল নেশা, কারা যে ডাকিল পিছে, বসন্ত এসে গেছে’- এই সুরের সঙ্গে ফাগুনের প্রথম দিনে মেতে ওঠেন সবাই।
বাসন্তী সাজে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে দেখা যায় ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী খালেদ মোশাররফকে। কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ক্যাম্পাসে আসার পর এটাই আমার প্রথম বসন্ত বরণ। নতুন ক্যাম্পাসে, নতুন বন্ধুদের সঙ্গে বসন্ত বরণ। অন্য রকম অনুভূতি। যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।

নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ফারুক আহমেদ বলেন, প্রত্যেক বছরের মতো এবারও বসন্তকে রাবি নিজের মতো করে বরণ করে নিচ্ছে। এতো রঙিন বসন্ত দেখা আমাদের জন্য আসলে একটা বিরাট উপহার। আমাদের মনে বসন্ত থাকুক আজীবন। ফুল ফুটেছে তাই আজ বসন্ত। দুপুর ১টায় চারুকলা প্রাঙ্গণে আয়োজন করা হয় বসন্ত উৎসবের আলোচনা সভা। অনুষদের অধিকর্তা অধ্যাপক মোহাম্মদ আলীর সভাপতিত্বে এই আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. সুলতান-উল-ইসলাম ও উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মো. হুমায়ুন কবীর।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপাচার্য বলেন, ষড় ঋতুর বৈচিত্র্যকে আমরা আগে অনুধাবন করতাম। কিন্তু অনেক ঋতুই এখন হারিয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। তার মধ্যেও ফাগুন মানেই আমাদের সহস্র বছরের সংস্কৃতির অংশ। এটাই বসন্ত। উৎসবের মূল বার্তা হলো, এ অঞ্চলের মানুষ একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতির আবহে যুক্ত। আমাদের ভাষা, ধর্ম, লোকায়ত ঐতিহ্য মিলেই আমাদের সংস্কৃতি। জাতীয়তাবাদের বিষয়টিও আমাদের সংস্কৃতিজাত। সংস্কৃতি মানুষকে মানুষের কাছে টানে।

উপাচার্য আরো বলেন, আমাদের মূলধারার সবধর্মেই সৃষ্টির মাঝে স্রষ্টাকে খুঁজে পাই। একারণেই আমরা যেন বাঙালিয়ানার ঐতিহ্য হারিয়ে না ফেলি। আমরা যেন প্রতিদিনই বসন্ত অনুভব করি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সাম্যবাদী সমাজের যে চিন্তা করে গিয়েছিলেন, এসব ঐতিহ্য বজায় রাখার মাধ্যমে আমরা যেন সেটা ধরে রাখতে পারি।