রাজশাহীতে বাড়ছে আত্মহনন, এপ্রিলে মারা গেছেন ৩৫ জন

আপডেট: মে ১০, ২০২৫, ১:০৫ পূর্বাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক:


দুর্ঘটনায় প্রবাসী ছেলের দুই পা পুড়ে গেছে। কিস্তি দিতে পারেননি বাবা জহুরুল ইসলাম (৫৫)। বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) দুই ক্রেডিট অফিসার তাই জহুরুলের সদ্য বিবাহিত মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে তাকে অপমান করেন। ডেকে আনেন অফিসে। সেখানে কিস্তি দিতে দুইদিন সময় চেয়েছিলেন জহুরুল। কিন্তু সেই সময় তাকে দেওয়া হয়নি। তখন এনজিও অফিসেই বিষপান করেছেন তিনি। জহুরুল এখন মৃত্যুশয্যায়। তার বাড়ি রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বিড়ালদহ নয়াপাড়া গ্রামে। ২৯ এপ্রিল দুপুরে পুঠিয়ার বানেশ্বর এলাকায় যশোরের বেসরকারি সংস্থা রুরাল রিকনস্ট্রাকশন ফাউন্ডেশনের (আরআরএফ) শাখা কার্যালয়ের ভেতরেই তিনি বিষপান করেন। তিনি এখন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন। চিকিৎসক বলছেন, ঘাষ মারা বিষ পানে মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত। জহুরুলের ক্ষেত্রেও যেকোন সময় যেকোন কিছু ঘটতে পারে। তার শরীরিক অবস্থা ভালো নয়।

রাজশাহী অঞ্চলে বাড়ছে আত্মহননের প্রবণতা। বয়োবৃদ্ধ থেকে শুরু করে কিশোর-কিশোরী কিংবা তরুণ-যুবক-যুবতী কেউই বাদ যাচ্ছে না। এপ্রিলে রাজশাহী অঞ্চলে আত্মহনন করেছেন ৩৫ জন। তবে এর বাইরেও আরও অনেকে আত্মহত্যা করছেন যেগুলো পুলিশের তালিকায় নাই।

চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দাম্পত্য কলহ, সংসারে অভাব-অনটন, পরকীয়া এবং যুবক-যুবতীদের পছন্দমতো বিয়ে না হওয়া, ঋণগ্রস্ত হয়ে যাওয়া, আত্মধারণা বা আত্মবিশ্লেষণের ঘাটতির কারণে বাড়ছে আত্মহত্যার ঘটনা। শুধু ১৫ থেকে ৩৫ বছরই না এর সঙ্গে এখন বয়োজ্যেষ্ঠরাও আত্মহনন করছেন।

আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে বলে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন। পারিবারিক সম্পর্কগুলোর পারস্পরিক অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়েছে। মনোরোগ চিকিৎসাকে পাগলের চিকিৎসা না মনে করে তা স্বাভাবিকভাবে নেয়া এবং পরিবার ও সমাজকে ভুক্তভোগীর পাশে দাঁড়ানো জরুরি। সেই সঙ্গে চিকিৎসার ফলোআপ না করলে এ সংখ্যা আরও বেড়ে যেতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আত্মহত্যা কমাতে নারীর ক্ষমতায়ন, সম্পদে তার অধিকার নিশ্চিত করা, ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধে সহজ শর্ত আরোপ, সকল হাসপাতালে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দ্বারা কাউন্সিলিং চালুর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

গেল মাসের ১৪ এপ্রিল পয়লা বৈশাখের দিন রাজশাহীর নন্দনগাছি স্টেশনে ষাটোর্ধ রুহুল আমিন খুব ঠা-া মাথায় ট্রেনের নিচে পড়ে আত্মহত্যা করেন। সেই ভিডিও ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। পরিবার থেকে জানানো হয়, ঋণের বোঝা সইতে না পেরে তার এমন সিদ্ধান্ত। একইভাবে ২০২৪ সালের জুনে পুঠিয়ার তরুণী রেমীর আত্মহত্যার ভিডিও তখন দেশজুড়ে আলোচনার সৃষ্টি করে।

হাসপাতালের তথ্য ও গণমাধ্যমের খবর বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, রাজশাহীতে চলতি বছর উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে আত্মহত্যার সংখ্যা। এর মধ্যে রয়েছে- ১১ জানুয়ারি রুয়েট শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান, ১১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের এএসআই আমিনুল ইসলাম, ২১ ফেব্রুয়ারি রাবি শিক্ষার্থী সিফাতুল্লাহ, ১ মার্চ দুর্গাপুরে দুজন গৃহবধূ বিষপান করেন। চেষ্টা করেন আরও ৬ জন, ৬ এপ্রিল ৮ তলা ভবন থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেন বুয়েটের সাবেক শিক্ষার্থী ও আমেরিকা প্রবাসী ফারিহা নাজনীন, ২০ এপ্রিল পুলিশের কনস্টেবল মাসুদ রানা।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজের মর্গে প্রায় প্রতিদিনই বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে আত্মহত্যার মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য আসছে। হাসপাতালটির মুখপাত্র বলছেন, শুধু এপ্রিল মাসেই তারা এই ধরণের মরদেহ বা মৃত্যুর ঘটনা পেয়েছেন ৩৫টি। এর বাইরেও রয়েছে আরও বড় সংখ্যক অংশ যারা পুলিশি তদন্তের বাইরে।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল জরুরি বিভাগের ইনচার্জ ডা. শংকর কে বিশ্বাসের বলেন, বর্তমানে দেশে প্রতি লাখে চারজন আত্মহত্যা করছে। যাদের মধ্যে ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সীরাই বেশি। এছাড়াও প্রাপ্তবয়স্করা আত্মহত্যা করছেন ঋণ পরিশোধ না করতে পেরে কিংবা সাংসারিক ঝামেলায়। তবে যারা বেঁচে যাচ্ছেন তারা পরবর্তীতে ফলোআপ চিকিৎসা না করায় ঝুঁকি কাটছে না।
আঁচল ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, ২০২৪ সালে দেশে ৩১০ জন আত্মহত্যা করেছেন। ২০২২ সালে আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল ৫৩২ ও ২০২৩ সালে ৫১৩। ২০২৪ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আত্মহত্যার খবর হয়তো গণমাধ্যমে কম এসেছে বলে তারা ধারণা করছে।

ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২৪ সালে ১৩-১৯ বছর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছে, যা মোট আত্মহত্যার ৬৫ দশমিক ৭ শতাংশ। সবচেয়ে কম আত্মহত্যা করেছে ২৬-৩০ বছর বয়সীরা। আত্মহত্যাকারীদের ৬১ শতাংশ নারী। অর্থাৎ নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। নারী শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যার ঝুঁকিতে বেশি। তাদের মানসিক স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত সহায়তা বেশি প্রয়োজন।
মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আকতার বানুর বলেন, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মানসিক স্বাস্থ্য দেখভাল করার বিষয়টি জরুরি হয়ে পড়েছে। এছাড়াও পারিবারের সদস্যদের সহায়তা, প্রশাসনের সহায়তা এবং মানসিক রোগকে রোগ হিসেবে মেনে নেয়ার প্রবণতা গড়ে তুলতে হবে।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ