সোমবার, ২৭ মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৩ চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ ।
নিজস্ব প্রতিবেদক
আড়াই বছরের শিশু। যে এখনো পৃথিবীর কিছুই বুঝতে শিখে নি। এই অবুঝ শিশুকে ধষর্ণের চেষ্টা চালানো হয়েছে। পাশবিক নির্যাতন করা হয়েছে তার ওপর। গতকাল শনিবার নগরীর মতিহার থানার অক্ট্রোর মোড় এলাকায় এ ঘটনা ঘঠে। গত পাঁচ দিনে রাজশাহীতে এই শিশুটিসহ চারজনকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। হঠাৎ করে এভাবে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় জনমনে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। এর থেকে উত্তোরণে দৃষ্টিভঙ্গি ও সামাজিক দায়বদ্ধতা বাড়ানোর পাশাপাশি ধর্ষকদের দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত জরুরি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
গতকালের পাশবিক নির্যাতনের শিকার ওই শিশুটিকে সন্ধ্যায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করা হয়েছে। এদিকে ঘটনার পর অভিযুক্ত বখাটেকে আটক করতে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। তবে তাকে বাড়িতে পাওয়া যায় নি। এসময় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অভিযুক্ত বখাটের মা’কে থানায় নিয়ে আসা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মতিহার থানার ওসি (তদন্ত) মাহবুব হোসেন।
তিনি জানান, অভিযুক্ত বখাটের নাম মামুনুর রশীদ ওরফে শান্ত। প্রায় ১৫ বছর বয়স তার। শান্ত তার পরিবারের সাথে অক্ট্রোয় মোড় এলাকায় টিনশেড একটি বাড়িতে ভাড়া থাকে। তাদের গ্রামের বাড়ি জেলার তানোর উপজেলায়। শান্তর পরিবার যে বাড়িতে ভাড়া থাকেন, সে বাড়িতে কয়েকদিন আগে নির্যাতিত ওই শিশুর পরিবারও ভাড়া আসেন। শনিবার বিকেলে ঘরে একা পেয়ে শান্ত ওই শিশুটিকে ধর্ষণের চেষ্টা চালায়। এসময় শিশুটির চিৎকারে পরিবারের লোকজন ছুটে গেলে শান্ত পালিয়ে যায়। পরে নির্যাতনের শিকার শিশুটিকে হাসপাতালে নেয়া হয়।
এর একদিন আগে গত শুক্রবার পুঠিয়ায় তালাকপ্রাপ্ত এক নারীকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করে ভিডিওচিত্র ধারণ ও সেই ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগে আল মামুন (২৪) নামে এক কলেজছাত্রকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গত বুধবার রাত ১০টার দিকে ভুক্তভোগী নারী পুঠিয়া থানায় হাজির হয়ে আল মামুনকে আসামি করে থানায় মামলা দায়ের করেন। আল মামুন পুঠিয়া উপজেলার জিউপাড়া ইউনিয়নের সৈয়দপুর ওয়ার্ড আ’লীগের সাবেক সভাপতি সমশের আলীর ছেলে। সে নাটোর নবাব সিরাজউদ্দৌলা সরকারি (এনএস) কলেজের ডিগ্রি প্রথম বর্ষের ছাত্র। পুঠিয়া থানার ওসি সায়েদুর রহমান ভূঁইয়া জানান, মামলা দায়েরের পর থেকে আল মামুন এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পেরে শুক্রবার ভোর ৪টার দিকে নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলার খারাসাক্ষা গ্রামে আল মামুনের আত্মীয়ের বাড়ি থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আল মামুন তার অপরাধ স্বীকার করেছে। বিকেলে তাকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়েছে বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।
গত বুধবার (১ আগষ্ট) জেলার বাঘায় ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রীকে তুলে নিয়ে গিয়ে দুই বন্ধু ধর্ষণ করে ফেলে রেখে যাওয়ার অভিযোগ উঠে। তাকে উদ্ধার করে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বাঘা থানায় নিয়ে যাওয়া হলে পরীক্ষার জন্য রামেক হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) প্রেরণ করা হয়। ভুক্তভোগী ছাত্রী বাঘা উপজেলার আড়ানী ইউনিয়নের হরিপুর উচ্চবিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। অপরদিকে ধর্ষণে অভিযুক্তরা হলেন- উপজেলার বাউসা ইউনিয়নের খাগড়বাড়িয়া গ্রামের মোহাম্মদ আলীর ছেলে জাকির হোসেন (২০) ও একই গ্রামের সমজান আলীর ছেলে নাজমুল হোসেন (২২)। তবে ঘটনার পর থেকেই তারা দুইজনই পলাতক রয়েছে। বাঘা থানার ওসি আলী মাহমুদ বলেন, এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। সন্ধ্যায় ভুক্তভোগীকে পরীক্ষার জন্য রামেক হাসপাতালের ওসিসি’তে পাঠানো হয়।
গত সোমবার (৩১ জুলাই) প্রায় ২৫ বছর বয়সি এক ছাত্রীকে নগরীর নওদাপাড়া এলাকার গ্রিন গার্ডেন নামের একটি রেস্ট হাউসে ধর্ষণ করা হয় বলে তিনি নিজেই অভিযোগ করেছেন। তরুণীর বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার নামোশংকরবাটি এলাকায়। তাকে ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত দুইজন হলেন- ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সের (ইউআইটিএস) রাজশাহী শাখার সাবেক শিক্ষক সামশুল আলম বাদশা (৩৫) ও রাজশাহীর গোরহাঙ্গা এলাকার ইজিটাস কম্পিউটার দোকানের মালিক আবু ফায়েজ নাহিদ (৩০)। এদের মধ্যে বাদশার বাড়ি বাগমারা উপজেলার মচমইল গ্রামে। আর নাহিদের বাড়ি একই উপজেলার হাসনিপুর গ্রামে। তারা দুজনেই নগরীর বোয়ালিয়া থানার সাগরপাড়া এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, সাবেক শিক্ষক বাদশার সঙ্গে ওই তরুণীর ফেসবুকে পরিচয় হয়। এরপর তাদের মধ্যে ফোনেও কথা হয়। পরবর্তীতে বাদশার বন্ধু নাহিদের সঙ্গেও ওই তরুণীর ফেসবুকে বন্ধুত্ব হয়। চিকিৎসার জন্য ওই ছাত্রী গত সোমবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে রাজশাহীতে আসেন। পরে ওই তরুণী থানায় গিয়ে মামলা করলে বাদশা ও নাহিদকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে তাদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। এছাড়া রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ওই তরুণীর ডাক্তারি পরীক্ষা করা হয়। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ওই তরুণীকে ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে কি না তা প্রাথমিকভাবে জানান নি চিকিৎসকরা। কয়েকদিনের মধ্যে তারা পুলিশকে লিখিত প্রতিবেদন দেবেন। আদালতে ওই তরুণীরও জবানবন্দি রেকর্ড করা হবে। আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে ওই তরুণী এখন নিজের জিম্মায় আছেন।
স্বেচ্ছসেবী মহিলা সমাজ কল্যাণ সমিতির (এসবিএমএসএস) নির্বাহী পরিচালক নূর-এ-জান্নাত বলেন, সবার আগে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও সামাজিক সচেতনাতা দরকার। সাধারণত ধর্ষণের ঘটনার মামলাগুলো অনেক দেরি হয় রায় হতে। অনেক সময় ধর্ষকরা বিভিন্নভাবে ম্যেনেজ করে ফেলে। তাই এসব ঘটনায় দ্রুত বিচারের আওতায় নিয়ে আনা দরকার।
সাম্প্রতিক ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবা কানিজ কেয়া। এসব ঘটনার পেছনে বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা, ক্ষমতার অপপ্রয়োগ ও সামাজিক সমস্যাকে দায়ী করেন তিনি। তিনি বলেন, ধষর্ণের ঘটনা বেড়ে যাওয়া নারী সমাজ তথা দেশের শৃঙ্খলাবোধ হুমকির মুখে। তাই আমাদের সামাজিক ও মনোজাগতিক পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়েছে। নারী মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা থেকে বেরিয়ে এসে ধর্ষকদের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে পারলেই এ ধরনের জঘন্নতম অপরাধ সমাজ থেকে বিতাড়িত করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।