শনিবার, ২৫ মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১১ চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ ।
প্রফেসর ড. আবদুল খালেক
সমাজে কবি এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিকে বিপরীত দুই মেরুর মানুষ বলে গণ্য করা হয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি তেমন হবার কথা নয়। ভাল মানের কবি এবং ভাল মানের রাজনৈতিক ব্যক্তির মধ্যে গুণগত মিলের অন্ত নেই। একজন কবিকে যেমন মানুষের হৃদয়ের চাওয়া-পাওয়া, আবেগ অনুভূতির কথা ভাবতে হয়, একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিকেও সমাজের সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়া, আবেগ অনুভূতির সাথে মিলতে হয়, মেলাতে হয়। সে বিবেচনায় কবি এবং রাজনৈতিক নেতার মধ্যে খুব বড় রকমের ব্যবধান খুঁজে পাওয়া যাবে না। কাজেই কবি হলে রাজনীতিবিদ হওয়া যাবে না, অন্যদিকে রাজনীতিবিদ হলে কবি হওয়া যাবে না, এমন কথা ভাবা যথার্থ নয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতায় উল্লেখ করেছেন
যে আছে মাটির কাছাকাছি,
সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি।
বাংলাদেশ কবির দেশ, বাংলাদেশ কবিতার দেশÑ এমন আবেগভরা কথা আমরা প্রায়ই বলে থাকি। তবে এ আবেগের মধ্যে সত্যতা যে নেই এমন কথা বলা যাবে না। বাংলার নদী, চরের বালু, কাশের ফুল, মাঠে-ঘাটে শ্যামল-সবুজ গাছপালা, ষড়ঋতুর বিবর্তন, পাখির কলতান, ভ্রমরের গুঞ্জন, আকাশে মেঘের সাথে চাঁদের লুকোচুরি খেলাÑ এদেশের প্রতিটি মানুষকে ভাবুক করেছে, কবি করে তুলেছে। কেউ নীরব কবি, কেউ সরব কবি। হৃদয়ের আবেগ যিনি আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে ভাষায় প্রকাশ করতে পারেন, তিনি সরব কবি, অপরদিকে হৃদয়ের আবেগ যিনি ভাষায় প্রকাশ করতে পারেন না কিন্তু গভীরভাবে অনুভব করেন তিনি নিরব কবি। একজন কবি তখনই সার্থকতা লাভ করেন, যখন তাঁর কবিতার পাঠক মনে করেন কবি তাঁর মনের কথা, হৃদয়ের কথা বলতে পেরেছেন। একজন সার্থক রাজনৈতিক ব্যক্তির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
একজন রাজনৈতিক নেতার ভাষণ শুনে শ্রোতা-সাধারণ উদ্বেলিত হয়, আবেগাচ্ছন্ন হয়ে বলে ওঠে নেতা তার মনের কথা, হৃদয়ের আকাক্সক্ষার কথা প্রকাশ করেছেন, তখন নেতার সাথে কর্মীর কোন রকম ব্যবধান থাকে না। নেতার সুর এবং কর্মীর কণ্ঠস্বর তখন মিশে একাকার হয়ে যায়। প্রসঙ্গক্রমে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণের ব্যাপারে আমাদের দেশের বর্তমান সময়ের শ্রেষ্ঠ কবি নির্মলেন্দু গুণের একটি কবিতার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে আমরা মূলত অসাধারণ রাজনৈতিক নেতা বলেই বিবেচনা করে থাকি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যে ঐতিহাসিক ভাষণ তিনি দিয়েছিলেন, নির্মলেন্দু গুণ সে ভাষণটিকে একটি শ্রেষ্ঠ কবিতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য লক্ষ লক্ষ শ্রোতা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়
একটি কবিতা পড়া হবে, তার জন্য কী ব্যাকুল
প্রতীক্ষা মানুষের : কখন আসবে কবি? …
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি:
“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি ভবিষ্যতে মহাকাব্য হিসেবে বিবেচিত হওয়া অসম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ইতোমধ্যেই উচ্চারিত হয়েছে তিনি প্রকৃত অর্থে একজন ‘রাজনীতির কবি’ (চড়বঃ ড়ভ চড়ষরঃরপং)।
সম্প্রতি রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ কিছুটা চমক লাগানোর মত ঘটনা লক্ষ্য করা গেছে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তাঁর জন্মভূমি টুঙ্গিপাড়ায় রিক্সা-ভ্যানে উঠে পথ পরিক্রমণ করেছেন এবং এলাকার সাধারণ মানুষের সাথে কুশল বিনিময় করেছেন। একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিরাপত্তার কঠিন বলয় থেকে বেরিয়ে এসে সমাজের অতি সাধারণ মানুষের কাছে চলে যাওয়ার কাজটি খুব সহজ ছিল না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেই কঠিন কাজটি অতি সহজেই সম্পন্ন করেছেন। রাজনীতিতে এর একটি সুদূরপ্রসারী ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। প্রভাব যে পড়েছে, তার একটি উদাহরণ এখানে তুলে ধরা যায়। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ সরকারের সেতুমন্ত্রী জনাব ওবায়দুল কাদের বিভাগীয় কর্মী সম্মেলন করতে রাজশাহীতে এসেছিলেন। ১৮ তারিখ ভোরবেলা সরকারি নিরাপত্তার ঘেরাটোপ থেকে বের হয়ে তিনি পদ্মা নদীর পাশ দিয়ে হেঁটে বেড়ান এবং এক পর্যায়ে তিনি রাস্তার পাশের এক কলাই রুটির দোকানে বসে কলাই রুটি দিয়ে সকালের নাস্তা খাওয়ার কাজ সম্পন্ন করেছেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রিক্সা-ভ্যানে পরিভ্রমণ এবং ফুটপাতের এক ক্ষুদ্র দোকানে বসে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাননীয় সেতুমন্ত্রী জনাব ওবায়দুর কাদেরের কলাই রুটি খাওয়ার দৃশ্যটি জনমনে বেশখানিকটা রেখাপাত করেছে।
১৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে রাজশাহীর মাদ্রাসা মাঠে আওয়ামী লীগের যে বিভাগীয় কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সে কর্মী সম্মেলনে ব্যতিক্রমধর্মী কিছু দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়েছে। কর্মী সম্মেলনের উপস্থিতি ছিল ব্যাপক। রাজশাহীর বিশাল মাদ্রাসা ময়দানে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। এ ধরনের অনুষ্ঠানে দলের সাধারণ সম্পাদককে খুশি করবার জন্য পথে-ঘাটে তোরণ নির্মাণ এবং ব্যানার-পোস্টারে অনুষ্ঠানস্থল ছেঁয়ে ফেলবার কথা। কিন্তু দলের সাধারণ সম্পাদক তেমনটি হতে দেন নি। তোষামোদের রাজনীতি থেকে দলকে মুক্ত করবার যে উদ্যোগ সাধারণ সম্পাদক গ্রহণ করেছিলেন, সে কাজে তিনি শতভাগ সাফল্য অর্জন করেছেন।
আত্মশুদ্ধির জন্য প্রয়োজন আত্মসমালোচনা। আত্মসমালোচনা কতটা তীব্র হতে পারে মাননীয় সাধারণ সম্পাদক জনাব ওবায়দুল কাদেরের বক্তৃতা শুনে তা স্পষ্ট অনুধাবন করা গেছে। আওয়ামী লীগের হবু নেতাদেরকে তিনি ঘুম থেকে সকালে উঠতে বলেছেন, সমাজের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের প্রতি ভাল আচরণ করার জন্য নেতা-কর্মীদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। শুধু তাই নয় তিনি দলের নেতা-কর্মীদেরকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেনÑ ‘সাধারণ মানুষের মনের ভাষা যারা বুঝতে অক্ষম, তারা কখনও রাজনীতিতে সফলতা অর্জন করতে পারবে না।’ কথাগুলো হয়তো পুরাতন। কিন্তু সত্য কথা কখনও পুরাতন হয় না। আমাদের রাজনীতিকে মাটির মানুষের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া ছাড়া কোন বিকল্প পথ নেই। কাজেই রবীন্দ্রনাথের কবিতার সাথে নতুন একটি শব্দ সংযোজন করে বলা যেতে পারে
যে আছে মাটির কাছাকাছি
সে নেতার বাণী লাগি কান পেতে আছি।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চিরজীবন মাটির কাছাকাছি মানুষদেরকে নিয়ে রাজনীতি করে গেছেন। এটিই আওয়ামীলীগের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এই রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে মর্মে ধারণ করে আওয়ামীলীগ সভানেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এবং আওয়ামীলীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী জনাব ওবায়দুল কাদের যেভাবে মাটির কাছের মানুষদের সংস্পর্শে যেতে শুরু করেছেনÑ এটি দেশ ও জাতির জন্যে পরম সুসংবাদ।
জয় হোক তাঁরÑ ‘যে আছে মাটির কাছাকাছি’।
লেখক : উপাচার্য, নর্থবেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী