রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৪ ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ।
রাবি প্রতিবেদক:যথাযোগ্য মর্যাদায় রাজশাহীতে শহিদ ড. সৈয়দ মুহম্মদ শামসুজ্জোহা দিবস পালন হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) দিনটি মহান শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। এ দিবসকে জাতীয়করণের দাবি করা হয়েছে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে।
১৯৬৯ সালের এই দিনে রাবির রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সৈয়দ মুহম্মদ শামসুজ্জোহা প্রক্টরের দায়িত্ব পালনকালে পাকিস্তানী সেনাদের গুলিতে নিহত হন। দেশের প্রথম শহীদ এই বুদ্ধিজীবীর স্মরণে ১৮ ফেব্রুয়ারি শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করে থাকে রাবি।
দিবসের কর্মসূচিতে ভোরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রশাসন ভবন, উপাচার্যভবনসহ অন্যান্য ভবনে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। সকাল ৯টায় উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. সুলতান-উল-ইসলাম, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মো. হুমায়ুন কবীর, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. অবায়দুর রহমান প্রামানিকসহ প্রশাসনের ঊর্ধতন কর্মকর্তাগণ শহীদ ড. শামসুজ্জোহার সমাধি ও জোহা স্মৃতিফলকে পুস্পার্ঘ্য অর্পণ করে ১ মিনিট নীরবতা পালন ও মোনাজাত করেন।
এরপর রসায়ন বিভাগ ও শহীদ শামসুজ্জোহা হলসহ অন্যান্য আবাসিক হল, বিভাগ, রাবি স্কুল ও শেখ রাসেল মডেল স্কুল, শিক্ষক সমিতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ, ছাত্র সংগঠন, অফিসার সমিতিসহ অন্যান্য পেশাজীবী সমিতি ও ইউনিয়ন শহীদ জোহার সমাধি ও স্মৃতিফলকে পুস্পার্ঘ্য অর্পণ করে।
সকাল ১০ টাই শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সিনেট ভবনে অনুষ্ঠিত হয়েছে জোহা স্মারক বক্তৃতা। এতে ‘আমাদের শিক্ষা ভাবনা’ শীর্ষক বক্তৃতা দেন সাবেক শিক্ষা সচিব ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরের কিউরেটর মো. নজরুল ইসলাম-খান। এ আয়োজনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির-সাত্তার।
বিশেষ অতিথি ছিলেন উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক সুলতান-উল- ইসলাম, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক হুমায়ুন কবীর, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক অবায়দুর রহমান প্রামানিক। রসায়ন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক চৌধুরী জাকারিয়া এতে সভাপতিত্ব করেন। সেখানে অন্যদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মো. আবদুল খালেকও বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তাসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
স্মারক বক্তৃতায় মো. নজরুল ইসলাম খান বলেন, পাবালিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসন সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ লক্ষ ৩৮ হাজার ৩২৩টি এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংখ্যা ১১ লক্ষ ৩০ হাজার ৩২টি যা মোট প্রায় ১৪ লক্ষ। লক্ষ্যণীয় বিশ্ববিদ্যালয়-গুলোতে আসন সংখ্যা চাহিদার তুলনায় বেশি কিন্তু বৃহত্তম অংশের শিক্ষাদানের পরিবেশ এবং মান নিয়ে যথেষ্ট অসন্তুষ্টি রয়েছে। উচ্চশিক্ষায় নতুন নতুন বিষয়ের চাহিদা থাকলেও পুরাতন বিভাগ বন্ধ করা কিংবা শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমিয়ে দেয়ার উদ্যোগ দেখা যায় না। অপরপক্ষে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী নতুন নতুন বিভাগ খোলা হয় না বা যায় না।
ভোগবিলাস কমানোর আহ্বান করে তিনি বলেন, আমরা যত বেশি শিক্ষিত হই, তত বেশি ভোগ করি। পুরানো দিনের সেই প্রবাদ, ‘লেখাপড়া করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে’। একজন কৃষক চিংড়ি খেয়ে সন্তুষ্ট হলেও আমরা উচ্চশিক্ষিতরা ম্যানগ্রোভের কাকড়া থেকে সমুদ্রের হাঙ্গরের পাখনার স্যুপ খাওয়ার আকাঙ্ক্ষা করি। যারা রাষ্ট্রনায়ক এবং গণতান্ত্রিক চর্চায় বিশ্বাসী, তারা জনগণকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে প্রকৃতিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে কিনা। আমাদের এই পারস্পারিক দ্বন্দ্বকে একত্র করে কীভাবে পৃথিবীতে টেকসই উন্নয়ন করা যায়, সেটি হচ্ছে আজকের শিক্ষার সবচেয়ে বড় ভাবনা। এই ভাবনায় নতুন নতুন গবেষণা করা দরকার, এই ভাবনায় ভোগ বিলাসকে কমানো ও পুনঃব্যবহার করার কথা বলা হয়ে থাকে। সেটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গ্রহণ করার জন্য শিক্ষার ডিজাইন কীভাবে করতে হয় সেটিই আমাদের শিক্ষা ভাবনা।
অনুষ্ঠানে উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, বিশ্বে শিক্ষার ধারণা ব্যাপক ও বিস্তৃত। জ্ঞান ও ধারণা সদা প্রবহমান ও বিকাশশীল। শিক্ষা মেধাকে শানিত করে, মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ : রোববার (১৮ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ যথাযোগ্য মর্যাদায় শহিদ জোহা দিবস পালনকল্পে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচী গ্রহণ করে। সকাল ৯.৩০ মিনিটে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় চত্ত্বরে ১৯৬৯ গণআন্দোলনে ১৮ ফেব্রুয়ারি মিছিলের অগ্রভাগে পাকিস্তানী সেনা বাহিনী কর্তৃক গুলিবিদ্ধ হয়ে শাহাদৎ বরণকারী শিক্ষক ডঃ শামসুজ্জোহার সমাধীতে পুষ্পস্তবক অর্পন, দোয়া খায়ের ও আমচত্ত্বরে সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভা।
এ সকল কর্মসূচীতে মুক্তিযোদ্ধা নামীয় সংগঠন সমূহের নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ঃ সচিবালয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার উপ-সচিব (অবঃ) বীরমুক্তিযোদ্ধা নাজিমুদ্দীন, জেলা ইউনিটে সাবেক ডেপুটি কমান্ডার বীরমুক্তিযোদ্ধা কে.এম.এম. ইয়াছিন আলী মোল্লা, সাবেক সহকারী কমান্ডার বীরমুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার, সদস্য বীরমুক্তিযোদ্ধা সাদিকুল ইসলাম, মহানগর ইউনিটের সাবেক কমান্ডার বীরমুক্তিযোদ্ধা ডাঃ আব্দুল মান্নান, সাবেক ডেপুটি কমান্ডার বীরমুক্তিযোদ্ধা রবিউল ইসলাম, সাবেক সহকারী কমান্ডারগণ যথা- বীরমুক্তিযোদ্ধা আবুল বাশার, বীরমুক্তিযোদ্ধা বজলুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন মঞ্চের নেতা বীরমুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ, জেলা মুক্তিযোদ্ধা বহুমুখী সমবায় সমিতির চেয়ারম্যান বীরমুক্তিযোদ্ধা চৌধুরী মনিরুল ইসলাম জোহা,
সেক্রেটারী বীরমুক্তিযোদ্ধা আয়ূবুর রহমান, বীরমুক্তিযোদ্ধা আঃ সালাম কোরবান, বীরমুক্তিযোদ্ধা এবাদুল্লাহ, মুক্তিসংগ্রাম পরিষদ-মুক্তিযুদ্ধ’৭১ নেতা বীরমুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম, বোয়ালিয়া থানা সাবেক কমান্ডার বীরমুক্তিযোদ্ধা মোতাহার হোসেন ও সাংবাদিক নেতা বীরমুক্তিযোদ্ধা তৈয়বুর রহমান প্রমুখ। এছাড়াও এসময় বিশ^বিদ্যালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা কর্মচারীগণও উপস্থিত ছিলেন।
নর্থবেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি : ১৯৬৯’র গণ আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের রক্ষা করতে গিয়ে জীবন উৎসর্গ কারী প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর শহীদ ড. শামসুজ্জোহার স্মৃতির প্রতি নর্থবেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করা হয়েছে। রোববার (১৮ ফেব্রুয়ারি) সকালে রাবির ড. জোহার সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য এবং বর্তমানে উপদেষ্টা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. আবদুল খালেক, উপাচার্য প্রফেসর ড. বিধান চন্দ্র-দাস, ট্রেজারার-প্রফেসর আনসার উদ্দিন, রেজিস্ট্রার, প্রক্টর, টিএসসির পরিচালক, ছাত্র উপদেষ্টা, সকল বিভাগীয় প্রধানসহ উর্ধতন কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন। এসময় ড. জোহার অবদান স্মরণ করে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
রাবি সাংস্কৃতিক জোট : দিবসটি উপলক্ষে জোটভুক্ত সংগঠনের কর্মীরা শহিদ জোহার সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন ও সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভা করেন।
এসময় জোটের সভাপতি রায়হান ইসলাম বলেন, শহিদ জোহা বাঙালি জাতির অনুপ্রেরণার উৎস। স্বাধিকার আন্দোলনের প্রথম শহিদ বুদ্ধিজীবী। যার আত্মাহুতি বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রামকে তরান্বিত করেছিল। গর্জে ওঠেছিল পাকশাসক বিরোধী আন্দোলন। পতন হয়েছিল আইয়ুব খানের। শিক্ষক হিসেবে শহিদ জোহার আত্মোৎস্বর্গের এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। অথচ তার শাহাদাতের অর্ধশত বছর অতিবাহিত হলেও দিনটি জাতীয় মর্যাদার স্বীকৃতি পায় নি। যা আমাদের ব্যথিত করেছে। প্রতিবছর দাবি জানানো হলেও আশ্বাসেই কাটে বছর। তাই অবিলম্বে দিবসটি জাতীয়করণের দাবি জানাই।
জোটের সাধারণ সম্পাদক তোফায়েল আহমদ তোফার সঞ্চালনায় সভায় উপস্থিত ছিলেন নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক আতাউর রহমান, কবি মুহাম্মদ কামাল, আবৃত্তির সংগঠন স্বননের আহ্বায়ক মিজান শেখ সহ জোটের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
রাবি রিপোর্টার্স ইউনিটি : শহীদ ড. শামসুজ্জোহার মৃত্যুবার্ষিকী ও শিক্ষক দিবস পালন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার্স ইউনিটি (রুরু)। রোববার (১৮ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১০:৩০ টায় ড. শামসুজ্জোহার সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন সংগঠনটির সংবাদকর্মীরা। এরপর জোহা চত্বরে এক মিনিটি নিরবতা পালন এবং এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন তারা। এসময় রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক মারুফ হাসান মিলু’র সঞ্চালনায় বক্তব্য দেন সভাপতি লাবু হক। সভাপতি লাবু হক বলেন, আজ ১৮ ফেব্রুয়ারি। ১৯৬৯ সালের এই দিনে তৎকালীন আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ও তৎকালীন প্রক্টর শহীদ ড. সৈয়দ মুহাম্মদ শামসুজ্জোহা স্যার ছাত্রদের রক্ষা করতে গিয়ে জীবন দেন। ড. জোহা স্যারের আত্মত্যাগের মাধ্যমেই তৎকালীন আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন বেগবান হয়েছিল।
তিনি বাংলাদেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী। কিন্তু এটি ৫৫ বছরেও জাতীয় স্বীকৃতি পায় নি, এটা দুঃখজনক। তিনি আরো বলেন, আমরা সাংবাদিকতা করি। আমাদের দায়িত্ব থাকবে নিজেদের বলিষ্ঠ লেখনীর মাধ্যমে এই দিবসটি যেন আগামীতে জাতীয় শিক্ষক দিবসের স্বীকৃতি পায় সে লক্ষ্যে কাজ করা। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মী হিসেবে ড. জোহার প্রতি সম্মান অটুট রেখে ছাত্রদের জন্য তার আত্মত্যাগ সবার কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার আহবান জানান তিনি। কর্মসূচিতে অন্যদের মধ্যে রাবি রিপোর্টার্স ইউনিটির যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক রায়হান ইসলাম, পরিকল্পনা ও কর্মসূচি বিষয়ক সম্পাদক স্বজন রায়, সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুব বিল্লাহ, অভ্যর্থনা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক আছিয়া খাতুন, দপ্তর সম্পাদক আলজাবের আহমেদ, কার্যনির্বাহী সদস্য আলিম খান ফারহানসহ সংগঠনের অন্যান্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
প্রসঙ্গত, দিবসের কর্মসূচিতে আরো ছিলো বাদ জোহর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে কোরআনখানি ও বিশেষ মোনাজাত, বিকেল ৪টায় শহীদ শামসুজ্জোহা হলে দোয়া মাহফিল, সন্ধ্যা সোয়া ছয়টায় শহীদ শামসুজ্জোহা হলের স্ফুলিঙ্গ চত্বরে প্রদীপ প্রজ্বলন ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনী। এ দিন শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত দর্শকদের জন্য খোলা ছিলো।