মাহাবুল ইসলাম:বাবা-মা ডাকতেন ফারুক হোসেন মন্ডল। আর দাদা-দাদি ডাকতেন আজাদুল ইসলাম মন্ডল। নামের এ ভুল চাকরিজীবনে কোনো প্রভাব পড়ে নি সেনাবাহিনীর সাবেক এ সদস্যের। তবে ২০০৪ সালে অবসর নেয়ার পর এই দুই নামের ‘মণ্ডলই’ কাগজি ভুলই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার মিঠাপুর ইউনিয়নের মিঠাপুর গ্রামের বাসিন্দা মৃত মো. ফারুক হোসেন মন্ডল ওরফে মো. আজাদুল ইসলাম মন্ডলের স্ত্রী বিলকিস নিরু (৪৬)’র জীবনে। আটকে গেছে পেনশনের টাকা। এই নামের ভুল সংশোধনে ২০১৭ সাল থেকে নির্বাচন অফিসের ঘুরে ঘুরে ২০২২ সালে মৃত্যুবরণ করেন মো. ফারুক হোসেন মন্ডল ওরফে মো. আজাদুল ইসলাম মন্ডল। স্বামীর মৃত্যুর পর এখন নির্বাচন অফিসের এ বারান্দা থেকে ওই বারান্দা ঘুরছেন নিরু। ইউপি চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে স্থানীয় সংসদ সদস্য, সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্তাদের সুপারিশসহ যাবতীয় কাগজ থাকলেও এখনও মিলে নি কোনো সমাধানÑ এমন অভিযোগের কন্ঠে এখন যুক্ত হয়েছে অশ্রু!
রোববার (৪ ফেব্রুয়ারি) বেলা ১০ টা থেকে সাড়ে ১২ টা পর্যন্ত রাজশাহী জেলা ও আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসের অবস্থান নিয়ে এমন অনেক ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। যাদের কেউ নামের একটি ‘শব্দ’ পরিবর্তন, আবার কেউ ডাক নামের বিপরীতে জন্মনিবন্ধন ও একাডেমিক সার্টিফিকেট অনুযায়ী নামের সংশোধন ও বয়স সংশোধনের জন্য বছরের পর বছর ধর্ণা দিচ্ছেন নির্বাচন অফিসের বারান্দায়। কিন্তু আদৌ কবে তাদের এই সংশোধন হবে তা জানেন না কেউ!
সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত আরেক সার্জনের স্ত্রী বগুড়া শাহজাহানপুরের বাসিন্দা মোসা. শারমিন আক্তার ওরফে কামরুন্নাহার। ডাক নামের পরিবর্তনে জন্ম নিবন্ধন ও সার্টিফিকেট অনুযায়ী ভোটার আইডি কার্ড সংশোধনের জন্য আবেদন করেছিলেন ৫ বছর আগে। অবসরপ্রাপ্ত স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে তিনিও এদিন আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তার কার্যালয়ের সামনে অপেক্ষা করছিলেন। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কোনো কর্তার দেখা না পেয়ে আবারও ফিরে যান তিনি।
আক্ষেপের সঙ্গে তিনি অভিযোগ করেন, উপজেলার অফিস শেষ করে এখন বিভাগীয় অফিসের বারান্দায় এসে পড়েছি। প্রতিবার যাতায়াতেই খরচ হয় ২ হাজার টাকার বেশি। একেকবার একেক অজুহাতে ঘুরিয়ে দেয়া হয়। কখনো কর্তা থাকে না, আবার কখনো ব্যস্ত। আজও এসে ঘুরে যেতে হচ্ছে। কর্মকর্তারা নাকি সবাই ব্যস্ত। এসব দেখে দেখে হাঁপিয়ে উঠেছি। মাঠ পর্যায়ে তদন্তও করেছে একাধিকবার। তারা যে কাগজপত্র চেয়েছে, সবই উপস্থাপন করেছি। কিন্তু কোনো সুরাহা হচ্ছে না। কর্তারা আমাদের সঙ্গে ভালো করে কথাও বলেন না। এটা কেমন অফিস!
এক বছর আগে আইডি কার্ডের নামে ইংরেজিতে ‘TOJAML’ থেকে ‘TOJAMMEL’ এর সংশোধন চেয়ে আবেদন করেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ শিবগঞ্জের বাসিন্দা মো. তোজামিল। উপজেলা নির্বাচন অফিস হয়ে জেলা অফিসের বারান্দা। জেলা অফিস এবার খোঁজ নিতে পাঠিয়েছে আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসের। সেখানেও কর্তার দেখা না পেয়ে অবশেষে ফিরে যান তোজামিলের ছেলে রাসেল আহম্মেদ।
রাজশাহী নগরীর বাসিন্দা মোসা. মালেকা বেগমের নাম ভুল করে নিবন্ধনের সময় লিখা হয়েছিলো মালেহা বেগম। সেই মালেহার-‘হ’ কেটে মালেকা- ‘ক’ সংযুক্তির সংশোধন চেয়ে আবেদন করেছেন ১ বছর আগে। বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও আবেদনের প্রেক্ষিতে কোনো সাড়া পান নি।
মালেকা বেগমের ছেলে মো. রমজান আলী বলেন, আমার মায়ের নামটির সংশোধন জরুরি। বছর হয়ে গেলো। অনলাইনে পেন্ডিং দেখায়। জেলা নির্বাচন অফিসে গেলে কেউ কোনো কথাও বলতে চায় না। এখন পড়েছি বিপাকে! এদিন নগরীর রাজপাড়া থানার এক এসআই কেউ আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসের বারান্দায় ধর্ণা দিতে দেখা যায় কাগজ নিয়ে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই পুলিশ সদস্য বলেন, আমার খুব কাছের বন্ধু, তার বাবার নামের সংশোধনের জন্য বিগত কয়েক বছর ধরে ঘুরছে। বগুড়া থেকে প্রতিবার যাওয়া আসায় অনেক টাকা খরচ হয়। আমি রাজপাড়া থানায় কাজ করি। আর এ থানার মধ্যেই নির্বাচন অফিস। বন্ধুর অনেক রিকুয়েস্টে আমি নিজেই এসেছি। দুঃখের বিষয় হলো আমি নিজেও তিন মাস ধরে ঘুরছি। কেউ ঠিকঠাক তথ্য দেয় না। আর যখনই আসি, কোনো না কোনো অজুহাত দেখিয়ে ফিরিয়ে দেয়া হয়।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, রাজশাহী জেলা ও আঞ্চলিক নির্বাচন কার্যালয়ে গেলে সঠিক তথ্য খুব কম পাওয়া যায়। নিচে যে হেল্প ডেস্ক আছে, আদৌতে সেখানে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। এক রুম থেকে আরেক রুমে
পাঠায়। কর্মকর্তারাও কথা বলতে চান না। কখনো কখনো দুর্ব্যবহারও করেন। নির্বাচন অফিসের এই দুর্ভোগের অবসান চান ভুক্তভোগীরা।
রোববার (৪ ফেব্রুয়ারি) আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তা অফিসে ছিলেন না। অতিরিক্ত দুই আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার একজন অনলাইন মিটিংয়ে থাকায় কথা বলেন নি। অন্যজন বাসা থেকেই অনলাইনে ট্রেনিং করছেন, তাই অফিসে আসেন নি- এমনটাই জানান কর্মচারীরা। আর জেলা অফিসের সিনিয়র নির্বাচন অফিসার মো. শাহিনুর ইসলাম প্রামানিকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে ব্যস্ততা দেখিয়ে তিনিও এদিন কথা বলেন নি।
তবে সোমবার (৫ ফেব্রুয়ারি) মুঠোফোনে নির্বাচন অফিসের এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে দুর্ভোগের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, সকল কাগজপত্র ঠিক থাকলে কাউকেই ফিরিয়ে দেয়া হয় না। তবে অনেক সময় তদন্তের জন্য কিছু সময় লাগে। সবকিছু যাচাই-বাছাই করেই সংশোধন করে দেয়া হয়।
ভুক্তভোগীদের সকল অভিযোগ অস্বীকার করে আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তা মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, যত আবেদন পাই, সঙ্গে সঙ্গে সাক্ষাতকার ও কাগজপত্র নিয়ে নিষ্পত্তি করে দেয়। কেউ ১৪ বার ঘুরে না। অনেক সময় আবেদনকারীরা অনলাইনে আবেদন করার সময় দোকানদারের নাম্বার দেয়। ওই নাম্বারে ম্যাসেজ যায়। আবার অনেক সময় সার্ভার বা নেটজনিত সমস্যা থাকে। এসব কারণে না বুঝেই ভুল অভিযোগ করে।