রাজশাহী অঞ্চলে বাজারে পুরোনো নিয়মে চলছে আমের কেনাবেচা

আপডেট: জুন ১৪, ২০২৫, ১২:৫৭ পূর্বাহ্ণ

চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি:


রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে বুধবার (১১ জুন) দিনভর বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, রাজশাহী অঞ্চলে আম বেচাকেনা হবে কেজি দরে। সভায় রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা সম্মত হয়েছিলেন, আমের মণ আর ৪৮ বা ৫২ কেজিতে ধরা হবে না। কেজিতে দেড় টাকা কমিশনে আম বিক্রি হবে। তবে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমের মোকাম ঘুরে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের চিত্র দেখা যায়নি।

রাজশাহীর বড় আমের মোকাম পুঠিয়ার বানেশ্বর বাজারে গিয়ে দেখা যায়, ব্যবসায়ীরা আগের নিয়মেই (ঢলন প্রথায়) বেচাকেনা করছেন। বাজারের কোথাও ৪০ কেজি মণ দরে বা কেজি দরে আম বিক্রির দৃশ্য দেখা যায়নি। স্থানীয় আমচাষি ও ব্যবসায়ী মো. আবুল হোসেন (৪২) বলেন, ৪০ মণ আম বিক্রি করেছেন। ৪৫ কেজিতে মণ দিতে হয়েছে। কেজি দরে আম বিক্রির আইন কেউ মানছেন না।

বানেশ্বরের চাষি ও ব্যবসায়ী আজমল হক (৬২) বলেন, আগের ‘ঢলন প্রথাতেই’ আম বেচাকেনা হচ্ছে। ৪৮ বা ৫২ কেজি—যে যেমন পারছেন, তেমন নিচ্ছেন। কেউ কেজি দরে আম কিনছেন না। বানেশ্বরের নাসিম ফল ভান্ডারে ঢুকে আড়তদারকে পাওয়া গেল না। কয়েকজন কর্মচারী ছিলেন। তারা কেজি দরে আম বেচাকেনার প্রসঙ্গ শুনেই বললেন, ‘আমরা ওসব মানি না।’

বানেশ্বর বণিক সমিতির সভাপতি ওসমান আলী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের সভায় ছিলেন। তিনি বলেন, চাষি ও ব্যবসায়ীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ‘ঢলন প্রথা’ চলবে না। কেজি দরে আম বেচাকেনা করতে হবে। এ জন্য আড়তদারেরা কেজিতে দেড় টাকা কমিশন পাবেন। রাতে বানেশ্বর বাজারে সভা করে সিদ্ধান্ত সবাইকে জানিয়ে দেন। রেজল্যুশনে ব্যবসায়ীদের স্বাক্ষরও নেওয়া হয়েছে। সকালে মাইকিং করা হয়। এরপরও না মানা দুঃখজনক। তিনি বলেন, এখন তাদের আর কী করার আছে। চাপাচাপি করলে তারা আম কেনা বন্ধ করে দেবেন। চাষিদের আম পচে যাবে।
দেশের বৃহত্তম আমের বাজার হিসেবে খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট বাজারেও একই চিত্র দেখা গেছে। বেশির ভাগ বেচাকেনা হয়েছে আগের নিয়মেই। হঠাৎ নতুন নিয়মে অভ্যস্ত হতে পারেননি ক্রেতা-বিক্রেতারা। আড়তদারেরা বলছেন, তাদের কিছুই করার নেই।

কানসাট, ভোলাহাট ও রহনপুরের বাজারে এখনো ৫০-৫২ কেজিকে এক মণ ধরে আম কেনা হচ্ছে। অথচ দাম দেওয়া হচ্ছে ৪০ কেজির হিসাবে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিশ্বনাথপুর গ্রামের আমচাষি মিজানুর রহমান বৃহস্পতিবার (১২ জুন) সকালে ২০০ মণ আম নিয়ে যান কানসাটে। প্রথম দুই ঘণ্টায় কোনো ক্রেতা না পেয়ে পরে এক ব্যাপারী আসেন। তিনি ৫২ কেজিতে মণ ধরে আগের চেয়ে ৫০০ টাকা কম দামে আম কিনতে চান। মিজান নতুন সিদ্ধান্তের কথা বললে ওই ব্যবসায়ী রাগ করে চলে যান। তার অভিযোগ, ‘কিছু মানুষ আমশিল্প ধ্বংসে লেগেছে। আগের মতো ৪৫ কেজিতে মণ ধরলেই ভালো হতো।’
কানসাট বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, ঢলন প্রথা পুরোপুরি বহাল। আড়তের এক কর্মচারী বলেন, এই কেজি দরের নিয়ম আমরা মানি না। ব্যবসায়ী শহিন মিয়াও ফোনে জানান, ‘গোটা ব্যাপারটাই এখন গোঁজামিল হয়ে গেছে। কেউ কোনো নিয়ম মানছে না।’

অনিয়মের এ চিত্র রাজশাহী অঞ্চলে নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরে কেউ ৪২, কেউ ৫২ কেজিকে মণ ধরে এলেও দাম দেওয়া হতো ৪০ কেজির হিসাবে। নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা কার্যকর হয়নি। এবারও সেই ব্যতিক্রম নয়। যদিও সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কেজি দরে বিক্রি ও মণপ্রতি ৬০ টাকা কমিশনের কথা বলা হয়েছে, বাস্তবে দেখা যাচ্ছে অনেক আড়তদার কেজিপ্রতি ৩ টাকা করে কমিশন নিচ্ছেন। এতে করে চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এবং বাজারে নতুন করে জটিলতা তৈরি হয়েছে।

গোমস্তাপুরের আম ব্যবসায়ী আব্দুল হান্নান জানান , নতুন নিয়ম মানতে কিছুটা সময় লাগবে। সবাইকে উদারভাবে ব্যবসা করতে হবে।
অন্যদিকে আড়তদার নেতা নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আড়তের ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল ও কর্মচারীদের বেতন মেটাতে এই নিয়ম মানা কঠিন।’
এদিকে , শিবগঞ্জের ইউএনও আজাহার আলী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ৪০ কেজিতে মণ এবং কেজিপ্রতি দেড় টাকা কমিশনের বাইরে যাওয়া যাবে না। এ নিয়ম বিভাগজুড়ে কার্যকর থাকবে।
নিয়ম থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ না হওয়ায় কৃষক ও ব্যবসায়ী উভয় পক্ষেই অসন্তোষ বাড়ছে। সরকারের পক্ষ থেকে আরও কঠোর নজরদারি ছাড়া এই অনিয়ম বন্ধ হবে না বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কানসাট এলাকার বাগান মালমালিক হুমায়ন কবির বলেন আম পচনশীল এ কারণেই ঢলন প্রথা। একটা আম গাছে ২০ মন আম পাড়লে চার মন ছোট সাইজ কিংবা ক্যাট আম বলা হয়। ঐ আমটা জুস ফ্যাক্টরিতে চলে যায় মুল্য ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা, বাকি বড় ও মাঝারি সাইজ আম আড়তদারগন এর কাছে আমচাষীরা বিক্রি করে থাকেন। কাজেই ঢলন থাকবে এটাই বাস্তবতা।#