নিজস্ব প্রতিবেদক:
রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ রুটে একটি বাসকে যাওয়া ও আসার পথে প্রতিদিন আটটি স্থানে চাঁদা দিতে হয় চালকদের। আগে এই চাঁদার পরিমাণ যা ছিল, কোন কোন পয়েন্টে সম্প্রতি তা দ্বিগুণ হয়ে গেছে। বাস মালিক সমিতি ও সড়ক পরিবহন গ্রুপের নামে এ চাঁদা তোলা হয়। অতিরিক্ত চাঁদা আদায়ের কারণে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাস শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
এদিকে ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর রাজশাহী সড়ক পরিবহন গ্রুপ দখল নিয়ে বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের জেরে কমিটি বিলুপ্ত করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। নিয়োগ করা হয়েছে প্রশাসক। তারপরও বাস মালিক সমিতির নামে মোড়ে মোড়ে টাকা উঠছে। এই টাকা কাউন্টারের মাস্টারদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের কয়েকটি বাসের চালক, হেলপার ও সুপারভাইজারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের চার স্থানে চাঁদা তোলে জেলা বাস মালিক সমিতির নামে। আর রাজশাহীর চারটি স্থানে চাঁদা তুলছে রাজশাহী সড়ক পরিবহন গ্রুপের নামে। গত ৫ আগস্টের পর সব স্থানেই চাঁদার হার বেড়ে গেছে।
শ্রমিকরা জানান, রাজশাহী থেকে কোন বাস বের হওয়ার শুরুতেই শিরোইল বাস টার্মিনালে এখন দিতে হচ্ছে ৯০ টাকা। এরপর রেলগেটে ১২০ টাকা ও বিলশিমলা সিটি বাইপাস মোড়ে ১৩০ টাকা দিতে হয়। আগে বাস টার্মিনালে ৬০ টাকা, রেলগেটে ৭০ টাকা ও সিটি বাইপাসে ৮০ টাকা দিতে হতো।
এছাড়া কাশিয়াডাঙ্গা মোড়েও ৫ আগস্টের পর দ্বিগুণ করে ১২০ টাকা আদায় শুরু হয়েছিল। শ্রমিকদের বিরোধিতার মুখে তা কমিয়ে আগের মতো ৬০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ঢুকতেই হরিপুর এলাকায় বাস মালিক সমিতির কাউন্টারে দিতে হচ্ছে ২০ টাকা। আগে এখানে কোন টাকাই দিতে হতো না। বর্তমানে মহানন্দা বাস স্ট্যান্ডে ১৪০ টাকা, বিশ্বরোড মোড়ে ২০০ টাকা ও সন্ধ্যা হলের মোড়ে ১০০ টাকা দিতে হচ্ছে। আগে সন্ধ্যাহলের মোড়ে ৫০ টাকা, বিশ্বরোডে ১৩০ টাকা ও মহানন্দা বাস স্ট্যান্ডে ১০১ টাকা দিতে হতো। যাওয়া ও আসার পথে দুইবারই এসব কাউন্টারে চাঁদা দিতে হয়।
হিসাব করে দেখা গেছে, আগে এই রুটে একটি বাসকে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় ঢুকতে ৫৯০ টাকা চাঁদা দিতে হতো। আর ফিরতি পথে আবার দিতে হতো ৫৯০ টাকা। এখন দিতে হচ্ছে ৮৬০ টাকা। যাওয়া-আসায় বাসটিকে মোট ১ হাজার ৭২০ টাকা চাঁদা দিতে হচ্ছে।
সোমবার (১১ নভেম্বর) দুপুরে রাজশাহী নগরের রেলগেট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সড়ক পরিবহন গ্রুপের রশিদ দিয়ে প্রতিটি বাস থেকে ১২০ টাকা তোলা হচ্ছে। কাউন্টার মাস্টার আকবর আলী টাকা আদায় করছিলেন। তার সঙ্গে এ.জে ট্রাভেলস নামের একটি বাসের চালককে তর্কবিতর্ক করতে দেখা গেল বাড়তি টাকা আদায় নিয়ে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আকবর আলী বলেন, সড়ক পরিবহন গ্রুপ থেকে তার কাছে চিঠি এসেছে। সে মোতাবেক তিনি টাকা আদায় করছেন। আকবর বলেন, তারা বাসের সিরিয়াল ঠিক রাখেন। যা টাকা উঠে তা কয়েকজন মাস্টার ভাগ করে নেন। তবে টাকার পরিমাণ খুবই সামান্য হয় বলে তিনি দাবি করেন।
রাজশাহী মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম পাখি বলেন, সড়ক পরিহন গ্রুপের পক্ষ থেকে সম্প্রতি বাড়তি টাকা আদায় শুরু করা হয়েছে। এই টাকার একটা পয়সাও আমাদের শ্রমিকেরা পায় না। সব টাকা মালিক সমিতি নেয়। এখন মালিক সমিতির কোন কমিটি নেই। প্রশাসক দায়িত্ব পালন করছেন। বাড়তি টাকা কে তুলতে বলল সেটা আমরা জানি না। তবে আমরা বলেছি যেন বেশি না নেওয়া হয়। আগেরটাই যেন থাকে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল ইসলাম জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জে যে টাকা ওঠে তার মধ্যে প্রতিটি বাস থেকে ৩০ টাকা পায় শ্রমিক ইউনিয়ন। বাকি টাকা মালিক সমিতিই নেয়। মালিক সমিতি কত টাকা তুলছে তা তিনি জানেন না।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শামিম হোসেন বলেন, কত টাকা তুলছে না তুলছে তা এখন বলতে পারব না। সমিতির রেজল্যুশন থাকে। সে অনুযায়ী টাকা তোলা হয়। রেজল্যুশনের বাইরে কেউ অতিরিক্ত টাকা তুললে আমাদের কাছে অভিযোগ করতে পারে।
বাস শ্রমিকেরা জানান, রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সরকার নির্ধারিত ভাড়া ১১৩ টাকা। বাসে নেওয়া হয় ১১০ টাকা। ভাড়ার টাকা অতিরিক্ত না নেওয়া হলেও বেশি টাকা দিতে হচ্ছে মালিক সমিতিকে। ফলে বাসের চালক, হেলপার ও সুপারভাইজারদের লাভ কম থাকছে। এ অবস্থায় ক্ষতি পোষাতে কেউ কেউ বাড়তি ভাড়া আদায় করছেন বলেও তারা জানান।
বাস থেকে এসব চাঁদা আদায়ের বিষয়ে রাজশাহী সড়ক পরিবহন গ্রুপের প্রশাসক ও অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) তরফদার মো. আক্তার জামীল বলেন, আমি সম্প্রতি প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছি। কোথায় কী চাঁদা তোলা হয় সেটা জানি না। আমি বাস মালিক সমিতির সদস্যদের ডেকেছি। তাদের সঙ্গে কথা বলছি। কেন চাঁদা তোলা হয় সেটা জেনে মন্তব্য করব।