রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সমাচার

আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৭, ১২:০১ পূর্বাহ্ণ

সুজিত সরকার


২০১৫ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ বনাম রাজনীতিক নেতাদের নীতিনির্ধারদের সঙ্গে মতের অনৈক্যের ফলশ্রুতিতে উভয়ের মধ্যে বেশ ক্ষমতার প্রতিযোগিতা এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে কথা, অপকথা চালাচালি শুরু হয়। ফলে দেশের সংবাদপত্রে সে তথ্য যথাবিধি যথাসময়ে প্রকাশিত হয়েছে। এতে রাজনীতির সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়েরও পরিবেশ কলুষিত হয়েছে বলে অভিজ্ঞমহল মনে করেন। তারপরে নানা ঘটনা ঘটে। নিয়োগ বাণিজ্য, ভিন্ন মতাবলম্বী আর নিজ জেলার কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বিশেষ সুবিধা দেয়া, নিজের পরিপার্শ্বে রাখা ইত্যাদি নানা কথা হয়েছে। একই সঙ্গে বর্তমান উপাচার্য ও উপ-উপাচর্যের দায়িত্বকাল শেষ হওয়ার পথে বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের ওই দুটো পদ দখলে নেয়ার লক্ষ্যে উপর মহলে চলছে জোর তদ্বির ও তৎপরতা। শোনা যাচ্ছে, তদ্বির-তৎপরের সংখ্যা ৮০ ছাড়িয়ে গেছে। আবার বর্তমান প্রশাসকেরাও চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। এই প্রতিযোগিতা সচেতন ব্যক্তিমাত্রই বেশ মজা করে উপভোগ করছেন। কারণ যারা সম্ভাব্য প্রার্থী তাদের মধ্যে কেউ কেউ এক সময় বর্তমান প্রশাসদের ভীষণ প্রিয় ও আস্থাভাজন ছিলেন। এখন তারা পদের আশায় প্রশাসন থেকে অনেকটা দূরত্ব রক্ষা করে চলছেন। পাছে তার সম্ভাবনাটাও নষ্ট হয়ে যায়! কারণ ঢাকায় অতিথি ভবন কেনা নিয়ে যে অভিযোগ দেশের সংবাদপত্রগুলো প্রচার করেছে, তার দায়ভাগ যদি নিতে হয় আশাবাদী কাউকে, তাহলে তো গুড়ে বালি। তাই এই দূরত্ব রক্ষা এবং আতঙ্ক। আশাবাদীরা ভুগছেন পদ দখলের রোগে। অন্যদিকে বর্তমান প্রশাসনের আস্থাভাজন হওয়া সত্ত্বেও নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে যারা জোরালো ভূমিকা  রেখেছিলেন, তারা কেউ কেউ চলনে-বলনে নগ্ন পক্ষপাতিত্বও করছেন। সন্ধিক্ষণে এমন হয়। অবশ্য সংকটেই চেনা যায় বন্ধুর পরিচয়। তারপরও প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে এই প্রতিযোগিতার একটি অসুস্থ ধারা বলে জ্ঞানীরা বলে সতর্ক করেন। সরকারের ভূমিকা ও সিদ্ধান্তে কার শিকে ছিঁড়বে, আগামী দিনই তার সাক্ষ্য দেবে। তবে এই সুবাদে আগামীদিনের বিজয়ীদের আগাম অভিনন্দন। না হলে চাকরি রাখা দায় হবে। কেনো না, বর্তমান প্রশাসন ইতোমধ্যেই অনেককে চাকরিচ্যুত এবং সাময়িক বরখাস্ত আর শো কজ নোটিশ দিয়ে ভবিষ্যতের কত্তাদের পথ নির্মাণ করে দিয়েছেন। সুতরাং আগে-ভাগে অভিনন্দন জানিয়ে সন্তুষ্ট রেখে চাকরি রক্ষা করা বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হয়।
দেশবাসী জানে, উপাচার্য, উপ-উপাচার্য পদ এখন রাজনীতিক। মেধা, যোগ্যতা আর নিষ্ঠাবান, অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ারকে কোনো সরকারই যথাযোগ্য বিবেচনায় নেন নি। সরকারের দলের সমর্থক কিংবা নেতা-কর্মীদেরই তারা দুই পদে নিয়োগ পান। কিন্তু তারপরও সরকারের কী এক বিভ্রান্তিজনিত কারণে প্রকৃত রাজনীতিকরা কিংবা চেতনায় সমৃদ্ধরা বা সত্যিকার অ্যাকাডেমিশিয়ান কাউকে এ সব পদে উপযুক্ত করেননি। হয়তো সবার উপরের নীতিনির্ধারকেরা একটু তোষামুদের ওপর বেশি আস্থাশীল। সব সময়ই কিছু কিছু তোষামুদে এবং মোসাহেবরাই এ পদে আসীন হওয়ার সুযোগ কেনো পান, তারাই ভালো জানেন? নাকি এটা ক্ষমতাধরদের চরিত্র? সরকারের উচ্চ পদগুলোতেও এমন ব্যক্তির অনুপ্রবেশ ঘটে থাকে হয় কোনো রাজনীতিকের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সুপারিশের ভিত্তিতে, নয় ক্ষমতাধর কাউকে উৎকোচের বিনিময়ে তার পক্ষে ওকালতি করিয়ে পদাসীন হন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এবার কীভাবে এবং কোন্ যুক্তিতে এই পদে দু’জনকে আসীন করানো হয়েছে, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শে অবিচল তারা কেউ জানেন না। কারণ এদের প্রথম জন আওয়ামী বা ১৪ দলের রাজনীতির সঙ্গে মোটেই যুক্ত ছিলেন না। বরং সামরিক ছাত্রচ্ছায় পরিচালিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গজিয়ে ওঠা পার্টির সদস্যপদ পাওয়ার লক্ষ্যে তিনি ২০০৮ সালে সারা দেশের বন্দি শিক্ষকদের বিরুদ্ধে বিবৃতিতে স্বাক্ষরদাতাদের একজন। অর্থাৎ পাকিস্তানি এবং জিয়া-এরশাদের কায়দায় গড়ে তোলা দলের সদস্য হয়ে তিনি উপাচার্য হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রবল গণ-আন্দোলনের তোড়ে যখন সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভেসে গেলো, তখন তিনি ভোল পাল্টিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী শিক্ষক সমাজ-এর পতাকাতলে উপস্থিত হন। তার আগেও ছিলেন। দলে ফিরে এসে তিনি সফলও হয়েছেন। অথচ স্পষ্ট বক্তা কেউ কেউ বলেন, বাংলাদেশ ও বাঙালি বিরোধী চার দলীয় জোটের মনোনীত উপাচার্যের তিনি ছিলেন ‘স্লিপিং উপদেষ্টা’। এ কথা রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ উত্থাপন করেন দেড় বছর আগে। শিক্ষকদের যখন গ্রেফতার করা হয়, তখন সে সময়ের উপাচার্যের পাকিস্তানি হানাদারদের কায়দায় ‘শান্তি কমিটি’র আদলে রাবি’র ‘শান্তি কমিটি’র গঠন করেন। সে কমিটির তিনি অন্যতম বিশ্বস্ত সদস্য ছিলেন। পরে অবশ্য অবস্থার পরিবর্তন দেখে ভীত হয়ে ‘আম ও ছালা’ দুই-ই হারানোর আতঙ্কে তিনি ওই ‘শান্তি কমিটি’র সভায় দ্বিতীয় দফায় যোগ দেননি। পদত্যাগ করেছিলেন। অপরজনের বড়ো ভাই চৌধুরী খোরশেদ বিন্ আলম ছিলেন ছাত্র লীগের একজন ত্যাগী ও সাহসী নেতা। প্রয়াত এই অকৃতদার নেতার ত্যাগ এবং রাজনীতিক ধারণা স্পষ্ট এবং নিখাদ ছিলো। একজন সৎ রাজনীতিক ছিলেন তিনি।  মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি রাজশাহী কলেজের নির্বাচিত ভিপিও ছিলেন। তার পরিচয়ে তিনি মহানগর ও জেলা নেতাদের সংস্পর্শে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। এ ছাড়া ২০০৮ সালের গ্রেফতার হওয়া শিক্ষকদের মধ্যে তিনিও একজন ছিলেন। সে সুবাদে তিনি স্থানীয় আওয়ামী রাজনীতিকদের সমর্থন লাভ করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘দ্বিতীয় কত্তা’র পদটি লাভ করেন। তবে তিনি দায়িত্ব পেয়ে কতোটা দলীয় চেতনা ও আদর্শ বিকাশের উদ্যোগ-আয়োজন করেছেন, তা নিয়ে যে নেতৃবৃন্দ তাকে সমর্থন করে পদাসীন করেছিলেন, তারাই পরে তাকে অভিযুক্ত করে শ্লীল-অশ্লীল ভাষায় প্রতিটা সভায় গালাগালি করেন। উল্লেখ্য যে, এই দুই শীর্ষ প্রশাসক কেউই বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজে’র সমর্থন ও প্রস্তাবে পদলাভ করেননি। দলের মতামত না নিয়ে সরকার তাদের পদাসীন করেছিলেন। মানি সরকারের সে ক্ষমতা ও শক্তি রয়েছে। কিন্তু পদলাভকারীরা কতোটা সরকারের মতাদর্শ বাস্তবায়ন করেছেন, এখন সেটাই সবার প্রশ্ন। সরকারের মনোনীত বলে তারা দলের (প্রগতিশীল শিক্ষক দল, রাবি) কাছে দায়বদ্ধ নন এবং দলের পরামর্শে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করেননি। বরং দলকে বাইপাস করেই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করছেন এবং তাতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দলের নেতাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। অর্থাৎ নেতাদের বেকার ও ত্যাগী কর্মীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, তাদের যথাবিধি আদর-আপ্যায়ন কোনোটাই পূরণ হয়নি। তখন তারা বলেছেন, শিক্ষকসহ যারাই নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের মধ্যে মোটা অঙ্কের জামাত-বিএনপি’র সমর্থক এবং কেউ কেউ এই সাম্প্রদায়িক চেতনার প্রথম সারির নেতাও। এতে আরো ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন রাজনীতিক নেতৃবৃন্দ।
দেশবাসীর জানে, একুশ বছর পর আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনায় নির্বাচিত হয়ে দলের মতামতের আলোকে এই দুটি পদে যোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়েছে। অন্ততঃ প্রফেসর আবদুল খালেক, প্রফেসর আব্দুস সোবহান তো সে ভাবেই পদাসীন হয়েছিলেন। প্রফেসর আবদুল খালেক উপ-উপাচার্য থেকে উপাচার্যের দায়িত্বে আসীন হন। আর প্রফেসর সাইদুর রহমান খান সিনেট নির্বাচনের মাধ্যমে উপাচার্য প্যানেলে প্রার্থী হয়েছিলেন দলের মনোনয়ন নিয়ে। তিনজন নির্বাচিত হয়েছিলেন। নির্বাচনে প্রফেসর খান খালেক সাহেবের থেকে ২ ভোট ভোট বেশি পেয়ে এগিয়ে থাকায় মহামান্য আচার্য তাকেই উপাচার্যের পদে নিয়োগ দান করেন। কিন্তু প্রফেসর মুহাম্মদ মিজান উদ্দিন এবং প্রফেসর চৌধুরী সারওয়ার জাহান এ সব কোনো প্রক্রিয়ায় পদাসীন হননি। সরাসরি সরকারের ইচ্ছেয় হয়েছেন। ফলে তাদের একটা সুবিধে হয়েছে। দলীয় মনোনয়নে নির্বাচিত হলে কিংবা পদাসীন হলে তাদের দলের প্রতি আনুগত্য থাকতো এবং দলের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রেখে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতেন। বরং শুরুর দিকে দলই মনে হয় তাদের ‘কেপ্ট’ ছিলো। দলের পরামর্শে প্রশাসন পরিচালনা করলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হতো কি না সেটা বলা মুস্কিল। কিন্তু যে দলের সদস্য হিসেবে তারা পরিচয় দেন, সেটা তো আরো শক্ত বাঁধনে আটকা পড়তেন। ইতোপূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে যখনই সংকট-সমস্যা দেখা দিয়েছে, তখনই সহযোগিতার জন্যে দলকে কাছে ডেকেছেন উপাচার্য। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। কিন্তু মাঝের সময়টা তারা দলকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেননি, এটা রহস্যজনক। তবে দলের কোনো কোনো নেতা তাদের অন্ধ সমর্থক তা তাদের সঙ্গে কথা বললেই অনুমান করা যায়। আজো সেই তারাই কত্তার ইচ্ছেয় কর্ম সম্পাদন করছেন। কেউ কেউ এতো অনুগত যে, প্রায় প্রত্যেক প্রশাসনেই অফিস বেনিফিট নিয়ে দলের অন্যদের করুণার দৃষ্টিতে দেখছেন। কাউকে পাত্তাই দিচ্ছেন না। এতে প্রশাসকদের বিবেচনাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। দলের সদস্য নন, এমন শিক্ষককেও এই প্রশাসনিক পদে অধিষ্ঠিত করেছেন। তার কারণে স্মার্ট কার্ডের মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে বলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলেন। অনেকে আগামী দিনের পদের স্বপ্নে আগের মতো সহযোগিতার হাত প্রসারিত করছেন না। তারা এখন বলছেন, এই প্রশাসন ক্রিমিনাল মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামিও নাকি চাকরি দিয়েছেন। এ তথ্য কতোটা সত্য তা তারাই ভালো জানেন।
পদের লোভে সেই সুবিধাভোগীরা সরকারি দলের নেতাদের সমর্থনের প্রত্যাশায় অধিকাংশ সময়ই তাদের পিছু পিছু ঘুরছেন। শ্রেণিকক্ষে পাঠদান পর্যন্ত কেউ কেউ সিঁকেয় তুলে রেখেছেন। মিটিং মিছিলে যাদের দেখা যেতো না, পরিবার বিএনপি কিংবা জামাত ঘেঁষা এবং আজকের ইসলামি মূল্যবোধের পরিষদে নির্বাচন পর্যন্ত করেছেন, তারাও এখন নেতার ছায়ায় বসে সভামঞ্চ আলোকিত করছেন। সভার ব্যয়ও বহন করেন তারাই। তাদের পক্ষে রাবি’র প্রগতিশীল দলের কতোটা সমর্থন রয়েছে, সেটাকে তারা থোরাই কেয়ার করছেন। তারা মরিয়া হয়ে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। যদি মওকা মেলে তাহলে আর পায় কে তাদের! বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া আর বড়ো কত্তা হওয়া স্বতন্ত্র যোগ্যতা বলে মনে হয়। যাদের যোগ্যতা প্রশ্নাতীত নয়, তারাও যদি ভিসি-প্রোভিসি হওয়ার স্বপ্ন দেখন, তাহলে প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তির অবশিষ্টটুকু কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? ইতোপূর্বে তাদের অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে ছিলেন, তারা নিয়োগ এবং অন্যান্য কর্মকা-ে বিতর্কিতও হয়েছেন। তারা দায়িত্ব বড়ো কত্তার পদের লক্ষ্যে সরকারের গোপনীয় শাখার সদস্যদেরও অর্থ-কড়ি দিয়ে তাদের পক্ষে ভালো রিপোর্ট দেয়ার তদ্বির করছেন। এই গোপনীয় শাখার সদস্যরাও বেশ মজায় আছেন। নগদ পাচ্ছেন, চা-বিড়ি খাচ্ছেন। এই তারা এখন বর্তমান প্রশাসনের বিরুদ্ধে বেশ সোচ্চার।
তাদের পক্ষে গোপনীয় শাখার এবং রাজনীতিক নেতাদের প্রস্তাব এবং সহযোগিতাকে কখনো সরকার আমলে নিয়েছেন কি না সেটা তারাই ভালো জানেন। মানুষ মনে করে, নেন নি। কারণ তাহলে দলের ত্যাগী বেকার কর্মীদের একটা কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করতেন। অধিকাংশ শিক্ষকের বক্তব্য সরকারও তোষামোদকারী-মোসাহেব ব্যতীত বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের যোগ্যদের এই পদে খুব কম নির্বাচন করেছেন। এটা শিক্ষা ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানের জন্যে শুভ ও সুখকর নয়। দেখা গেছে, একই অভিযোগে একজন চাকরিচ্যুত হচ্ছেন, অপরজন পদ-পদবি আর অফিস বেনিফিটের সুযোগ পাচ্ছেন। অভিযোগ শোনা যাচ্ছে, দলের নেতা-কর্মীদের থেকে বাংলাদেশের কনসেপ্ট বিরোধীরা তাদের নীরব সহযোগিতা ও সহানুভূতি পান। এমনটি বোধ করি, নেতারা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দল এবং শিক্ষক সমিতিও আশা করেননি। তারপরও তারা তাদের বিশ্বস্ত লোকদের নিয়ে স্মার্ট কার্ড, পদোন্নতি এবং কারো কারো তিন/চার বছরের অভিজ্ঞতা যোগ না করা আবার একই স্থানে পছন্দের কারো অভিজ্ঞতা যোগ করে পদোন্নতি দিয়েছেন। সুযোগ বঞ্চিত ও চাকরিচ্যুত শিক্ষক-কর্মচারীরা এই প্রশাসনের ওপর সে কারণে অসন্তুষ্ট। তারা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেসরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা যুক্ত করে পদোন্নতি নিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ একই কর্মদক্ষতা ও অভিজ্ঞতার পর তাকে বঞ্চিত করেছেন বলে তারা মনে করেন। এটা এক চোখে নদীর স্রোত দেখা, আরেক চোখে ¯্রােতে ভাসা কচুরিপানা দেখার মতো একটি পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণজ্জযা প্রশানিক আচরণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিবহির্ভুত বলে অনেকে মনে করেন। বিশ্ববিদ্যালয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এখানের পদোন্নতি-নিয়োগ সবই যোগ্যতার আলোকে হওয়া প্রত্যাশিত। বর্তমান প্রশাসন স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মীদের দ্বারা তারা বেশ কয়েকবার ঘেরাও হয়েছেন। ঢাকায় অতিথি ভবন ক্রয়ের দুর্নীতির তথ্য সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলে শেষবার প্রতিবাদের মুখে পড়েন তারা। কাউকে ছোট করার জন্যে না বা কারো মনে আঘাত করা উদ্দেশ্য না এ লেখা নয়। বাজারে চলতি কথাও নয়। সত্যাসত্য বিচার ভুক্তভোগী এবং কত্তারাই করবেন। তারা মনে করলে অতিথি ভবন কেনা নিয়ে যে অভিযোগ সংবাদপত্র উত্থাপন করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদককে দিয়ে মামলা তদন্ত করাতে পারেন। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক-কর্মকর্তা থাকবেন না।
রাজনীতিক নেতারা বলেছেন, এই প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিরা যে অ্যাকাডেমিক যোগ্যতায় স্বজনদের শিক্ষক পদে চাকরি দিয়েছেন, তাদের চাকরি নিশ্চিত করার পর অন্য কারো ছেলে বা মেয়েকে যেনো সে যোগ্যতায় শিক্ষক পদে চাকরির জন্যে আবেদন করতে না পারেন সে সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন। কর্মচারী-কর্মকর্তা নিয়োগে ৩০ বছর বয়স নির্ধারণ করেছেন, শিক্ষক নিয়োগে করেননি। একই প্রতিষ্ঠানে এমন দুই ধরনের নিয়ম কি যথার্থজ্জএ প্রশ্ন এখন সবার। এটাও নাকি পাকিস্তানি এবং জিয়া-খালেদা-এরশাদের স্বৈরশাসনের মতো একটি হিংস্র অপকৌশলের দৃষ্টান্ত। সে কথাও রাজনীতিকেরা উচ্চারণ করেছেন। তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে অভিমত ব্যক্ত করেছেন কিছু তরুণজ্জযারা শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারী পদের জন্যে অভিলাষী।
এবংবিধ কারণে গত ১১ ফেব্রুয়ারি প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমান প্রশাসকদের সমর্থক ও প্রশাসন বিরোধীদের মধ্যে বেশ বাক-বিত-া হয় সেখানে। সে সভায় সাধারণ শিক্ষকেরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ১২ ফেব্রুয়ারি উপাচার্যের কার্যালয়ে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অনিয়ম-পক্ষপাতিত্ব এবং ঢাকায় অতিথিভবন ক্রয়ের বিষয়ে তাদের মতামত জানিয়ে এ বিষয়ে দুদককে দিয়ে একটি তদন্ত কমিটি করার দাবি জানানো। দ্বিতীয়তঃ সংবাদপত্র যদি অতিথিভবন ক্রয় নিয়ে মিথ্যে তথ্য প্রচার করে থাকে, তাদের বিরুদ্ধে আইসিটি আইনে মামলা করা এবং তৃতীয়তঃ প্রশাসন এ সব কিছু না করলে প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ সংবাদ সম্মেলন করে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করবেন। সে ক্ষেত্রে প্রশাসন যদি খড়গহস্ত হন তাহলে শিক্ষক সমাজ আত্মরক্ষার বিষয়টিও বিবেচনায় রাখবেন। শিক্ষক সমিতিও অতিথি ভবন ক্রয় সংক্রান্ত সংবাদের স্পষ্ট ব্যাখ্যা দাবি করেছেন। যদি সত্যিকারেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে সংবাদপত্রগুলো মিথ্যে তথ্য প্রচার করে কারো ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া জরুরি বলে মনে হয়। সংবাদ প্রচারের পর সপ্তাহ অতিক্রম করেছে। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি সংবাদ সম্মেলন এবং সংবাদপত্রে তাদের অবস্থানের ব্যাখ্যা ব্যতিত উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা পালন করেননি। কারণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, পর্যায়ক্রমে তারা যথাবিধি পদক্ষেপ নেবেন। কিন্তু ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি যথষ্ট ক্ষুণœ হয়েছে, তা পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নেয়া প্রত্যাশিত। সেটা কতোদিনে হবে কিংবা আদৌ হবে কি না কেউ জানে না। কিন্তু যাদের দিকে অভিযোগের আঙুল সংবাদপত্র তুলেছে, তাদের সঙ্গে পুনরায় আলোচনা করে কী সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া যাবে? সমগ্র বিষয়টি কালক্ষেপণের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদী কণ্ঠকে দমিয়ে রাখার একটি কৌশলও হতে পারে। কেনো না, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ সংক্রান্ত বিষয় দেখভাল করবেন কোষাধ্যক্ষ-হিসাব পরিচালক। তারাই যদি ক্রয় কমিটির সদস্য হন, তাহলে অর্থ অপচয় কিংবা অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি কে ধরবেন? ঢাকায় মাটি কেনা হয়েছে খুব ভালো। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিভাগকে দিয়ে ভবন নির্মাণ করানো যেতো। তা হয়নি। বরং হয়েছে ভাবমূর্তি ক্ষুণœ। তারাই সংবাদপত্রের ভাষায় অভিযুক্ত। সেই তাদের উদ্ধারের জন্যে আলোচনার চেয়ে দুদককে দিয়ে তদন্ত করানো এবং সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে মামলা করাই অন্যতম পথ বলে মনে করেন অনেকেই। কিন্তু তাদের সঙ্গে আলোচনা করে কোনো সদুত্তোর পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। আইন উপদেষ্টা এই জমি কেনার বিপক্ষে লিখিত মতামত ব্যক্ত করার পরও কেনো অসুস্থ ও অস্বাভাবিক পরিবেশে তড়িঘড়ি জমি কেনা হলো? প্রশ্ন জমির দলিলের সঙ্গে উপ-উপাচার্যের বক্তব্যের মিল অনুপস্থিত। সুতরাং বিষয়টি পরিষ্কার করতে দুদককে দিয়ে তদন্ত করানো যথাবিধি বলে নেতৃবৃন্দ বলেছেন।
সত্য হোক, আর মিথ্যে হোক এ ধরনের প্রচার সরকারের অনেক সাফল্যকে ম্লান করে। দেশের ভাবমূর্তিকেও খর্ব করে। বিশ্ব ব্যাংকের মতো শক্তিধর সংস্থা যখন মিথ্যেচারের জন্যে আদালত কর্তৃক নিন্দিত হয়েছে। তবুও দেশে উন্নয়ন কর্মসূচি বন্ধ থাকেনি। বর্তমান সরকার বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ করে পদ্মাসেতুর মতো বিশাল প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে সম্পন্ন করছে। এ ভাবেই বাংলাদেশ স্বাবলম্বী হবে। দেশকে এগিয়ে নেয়ার শক্তিও অর্জন করবে। অনেক কষ্টে উন্নতির পথে পা পা করে এগোচ্ছে, তখন দিনে দুপুরে এমন পুকুরচুরির প্রচার আমাদের এগিয়ে যাওয়ায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। একই সঙ্গে বলা যায়, দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যখন সত্যি হোক বা না হোক এমন অভিযোগ উত্থাপিত হয়, তখন তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকেই তার দায় বহন করতে হয়। দু’চারজনের দুষ্কর্মের জন্যে লজ্জাটা সবাইকে পেতে হয়। যেমন অনেকেই বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পুকুরে মাছ চাষের জন্যে কোনো এক ‘ভাগিনা’কে বাজার মূল্যের চেয়ে কমে লিজ দেয়া হয়েছে। এ তথ্য কতোটা সত্য, তা যারা স্বজনপ্রীতি করেছেন বলে অভিযুক্ত তারাই ভালো বলতে পারবেন। অন্যদিকে গাড়ি কেনা এবং শহিদ জোহার কবরস্থানসহ অন্যান্য স্থাপনা ও নির্মাণেও নাকি ব্যাপক অনিয়ম ঘটেছে। টেন্ডার ছাড়াই পছন্দমতো ঠিকাদার কাজ করছেন, যে কাজগুলো নি¤œমানের। স্মার্ট কার্ড নামে যেটা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারকে দেয়া হয়েছে চারশো টাকায় সেটা নাকি বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি নেয়া হয়েছে। ফেসবুকে এ নিয়ে কমেন্ট করায় একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। তার চাকরি যায় যায় অবস্থায়। সে সূত্র ধরে স্মার্ট কার্ডের তথ্য এখানে পরিবেশিত হলো। সত্যোৎচ্চারণের জন্যে যদি কাউকে অপরাধী ভেবে অভিযুক্ত করে ভোগান্তির শিকার হতে হয়, তাহলে একজন শিক্ষিত-দক্ষ এবং রাজনীতিক সচেতন ব্যক্তির কাছে আর কিছু প্রত্যাশিত নয়। তিনি আর যা-ই হোন না কেনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি কখনো অক্ষুণœ রাখতে সক্ষম নন।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তি তিনিই যিনি নিজের দায়িত্ব সদ্ভাবে পালন ও পরিচালনা করেন। জবাবদিহিতায় উন্নতশিরে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা দায়িত্বে আসীন ছিলেন তারা কোনো অপরাধ করেছেন কিনা কিংবা অর্থ তছরুপ অথবা আত্মসাৎ করেছেন কি না সে কথার জবাব তারা দিয়েছেন সংবাদ সম্মেলনে এবং বিজ্ঞাপন দিয়ে। দেশবাসী সে ব্যাখ্যা কতো গ্রহণ করেছে তা পথে চলতেই শোনা যায়। তারা বলছেন, ‘যা রটে তা বটেও’। জনগণই সকল শক্তির উৎস। সে উৎসের বিপরীতে অবস্থান নেয়া হয় বোকামি নয়, কৌশল। যা-ই হোক না কেনো, সংবাদপত্রে এমন তথ্য প্রচার অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষক সমাজের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণœ করেছে। এটা অপ্রত্যাশিত। তারা যে চ্যালেঞ্জ নিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন, সেখান থেকে কতোটা ডেভিয়েশন হলে এমন তথ্য বিশ্বময় প্রচারিত হতে পারে সে কথা কি তারা একবার ভেবেছেন। তাদের নৈতিক শক্তি থাকলে এতোদিনে প্রচারিত সংবাদের বিরুদ্ধে আইসিটি আইনে মামলা করতে পারতেন। পারতেন পদত্যাগ করে মানহানির মামলা রজ্জু করতে। কোনোটাই তারা না করায় শিক্ষক সমাজ বিস্মিত। গত ১১ ফেব্রুয়ারির দলের সাধারণ সভায় শিক্ষকেরা সে বক্তব্যই উত্থাপন করেছেন। আশাকরি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল ও সমুন্নত রাখতে বর্তমান ও আগামী দিনের প্রশাসন যতœবান হবেন এবং দেশের মর্যাদা আর দলের চেতনা আরো শাণিত করতে সাহসী ভূমিকা পালন করবেন। আমরা যারা অতি সাধারণ, তারা এর বেশি প্রত্যাশা করি না। করতে সাহসও রাখি না। কারণ চাকরি যাবে… খাবো কি!