রাজশাহী বোর্ডে ইতিহাস দ্বিতীয়পত্রের প্রশ্ন বাতিল, থানায় ট্রাংকের তালা খুলে পরীক্ষার প্রশ্ন দেখলেন আসামি, দুই পুলিশ প্রত্যাহার

আপডেট: জুন ২২, ২০২৫, ১:৫৪ পূর্বাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক ও নওগাঁ প্রতিনিধি:


নারী হাজতে নারী আসামি নেই। রাখা হয়েছিল এক তরুণকে। সেই হাজতেই ছিল এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের ট্রাংক। গভীর রাতে আসামির দিকে যখন কারও নজর নেই, তখন ওই ট্রাংক খুলেছেন আসামি। উল্টেপাল্টে প্রশ্নপত্র দেখেছেন। কয়েকটি ছিঁড়েও ফেলেছেন। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা মিলেছে এই চিত্রের।

মঙ্গলবার (১৭ জুন) দিবাগত রাতে নওগাঁর ধামইরহাট থানায় এ ঘটনা ঘটেছে। প্রশ্নপত্র বাইরে ছড়িয়ে না পড়লেও শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ ওই প্রশ্ন বাতিল করছে। আর দায়িত্বে অবহেলার কারণে একজন উপ-পরিদর্শক (এসআই) ও একজন পুলিশ কনস্টেবলকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন ও জেলা পুলিশ আলাদা দুটি তদন্ত কমিটিও করেছে।
এছাড়া সরকারি সম্পদ বিনষ্টের অভিযোগে ওই আসামির বিরুদ্ধে পুলিশ একটি মামলাও করেছে। যে ট্রাংকটি ওই আসামি খোলেন, তাতে এ বছরের এইচএসসি পরীক্ষার ইতিহাস বিষয়ের প্রশ্নপত্র ছিল। সম্প্রতি ১৭টি ট্রাংকে বিভিন্ন বিষয়ের প্রশ্নপত্র ধামইরহাট থানায় পাঠিয়েছে রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ। এর একটি ট্রাংক খোলা হয়।

নওগাঁর পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ সাফিউল সারোয়ার জানান, ১৭টি ট্রাংক থানার একটি কক্ষে রাখার মতো জায়গা ছিল না। তাই কয়েকটি ট্রাংক থানার নারী হাজতে রাখা হয়েছিল। কারণ, নারী আসামি গ্রেফতার হয় না বললেই চলে। হাজতখানাটি ফাঁকাই পড়ে থাকে।

এসপি জানান, মঙ্গলবার একটি হত্যা মামলার তিনজন আসামিকে গ্রেফতার করে থানা-পুলিশ। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের কৌশল হিসেবে তিনজনকে আলাদা আলাদা রাখার প্রয়োজন ছিল। তাই একজনকে রাখা হয়েছিল নারী হাজতখানায়। ওই হাজতখানায় প্রশ্নের ট্রাংক ছিল। এই ট্রাংকে দুটি তালা থাকলেও চাবি তালার সঙ্গেই রেখে সিলগালা করা ছিল।

এসপি বলেন, আসামির হাতে হ্যান্ডকাপ থাকলেও এক হাত খোলা ছিল। সে কৌতুহলবশত হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক, নখ দিয়ে সিলগালার সিল তুলে চাবি দিয়ে তালা খোলে। এরপর ভেতর থেকে একটি প্রশ্নের প্যাকেট বের করে কাটে। তারপর ভেতর থেকে প্রশ্ন বের করে দেখে। কয়েকটি প্রশ্ন সে আড়াআড়িভাবে ছিঁড়েও ফেলে রাখে হাজতে। পরে সকালে পুলিশ গিয়ে এগুলো দেখতে পায়। পুলিশ প্যাকেটের ৫০টি প্রশ্নই পেয়েছে। কয়েকটি প্রশ্ন ছেঁড়া থাকলেও কোনো অংশ মিসিং ছিল না। প্রশ্ন থানার বাইরে যায়নি, ফাঁসও হয়নি।

তিনি আরও জানান, নারী হাজতে হত্যা মামলার আসামি ওই তরুণকে রাখার কারণে একজন এসআইকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এছাড়া দায়িত্বে অবহেলার কারণে বুধবার একজন কনস্টেবলকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তিনি একটি তদন্ত কমিটিও করেছেন। কমিটির প্রধান করা হয়েছে নওগাঁর পত্নীতলা সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে। এছাড়া ধামইরহাট এমএম সরকারি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষের একজন প্রতিনিধি ও একজন পুলিশ পরিদর্শককে সদস্য রাখা হয়েছে। তিন কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। আর সরকারি সম্পত্তি বিনষ্টের অভিযোগে পুলিশ বাদী হয়ে হত্যা মামলার ওই আসামির বিরুদ্ধে একটি মামলাও দায়ের করেছে। ওই আসামিকে বুধবারই আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তিনি হত্যাকা-ে জড়িত বলে আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।

এদিকে ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসনও আলাদা একটি তদন্ত কমিটি করেছে বলে জানিয়েছেন রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আ.ন.ম মোফাখখারুল ইসলাম। তিনি জানান, বুধবার তিনি জেলা প্রশাসনের এক চিঠির মাধ্যমে কমিটির কথা জানতে পেরেছেন। তদন্ত কমিটির প্রধান নওগাঁর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি)। এছাড়া জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও পত্মীতলা সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে কমিটির সদস্য রাখা হয়েছে। বুধবার জেলা প্রশাসক আব্দুল আউয়াল এ কমিটি করে দেন। দ্রুত সময়ের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান জানান, মঙ্গলবার দিবাগত রাতের এ ঘটনা তিনি প্রথম জানতে পারেন বুধবার রাতে। পরে বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির চিঠি পান। এ দিন তিনি ব্যস্ততার কারণে থানা পরিদর্শনে যেতে পারেননি। ইতোমধ্যে ওই সেটের প্রশ্নপত্র বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। এ প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে সব বিষয়ের প্রশ্নেরই একাধিক সেট থাকে। বিকল্প সেটে পরীক্ষা নেওয়া হবে। আগামী ১৯ জুলাই আলাদা প্রশ্নেই রাজশাহীর ৮ জেলার পরীক্ষা হবে।

তবে এমন ঘটনায় পুলিশের গাফিলতি আছে বলে মনে করেন শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, পরীক্ষার প্রশ্ন নিরাপদে রাখার জন্যই পুলিশকে দেওয়া হয়। সেখানে থানার ভেতরেও যদি প্রশ্ন নিরাপত্তা না পায়, তাহলে গাফিলতি ছাড়া অন্য কিছু নয়। কেন প্রশ্ন রাখা হাজতে আসামি রাখা হলো? এ প্রশ্নেরও তো জবাব আসতে হবে। এসপি নিশ্চয় বিষয়টি দেখবেন।

গাফিলতির অভিযোগ স্বীকার কিংবা অস্বীকার না করে নওগাঁর এসপি মোহাম্মদ সাফিউল সারোয়ার বলেন, এটা তদন্তাধীন। এ বিষয়ে এখনই মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তদন্ত চলছে। তদন্ত কমিটিই সবকিছু বলবে। তাদের নিশ্চয় সুপারিশও থাকবে। দায়িত্বে অবহেলার কারণে ইতোমধ্যে দুজনকে থানা থেকে পুলিশ লাইনসে প্রত্যাহার করা হয়েছে। আর যদি কারও গাফিলতির কথা উঠে আসে তাহলে আমরা প্রয়োজনীয় বিভাগীয় ব্যবস্থা নেব।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ