২০০৯ সালে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা প্রদান করেন হাইকোর্ট। যা হাইকোর্ট ডিরেক্টিভস ২০০৯ নামে পরিচিত। উল্লিখিত ডিরেক্টিভসে প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ ও অভিযোগ কমিটি গঠনের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু সে নির্দেশনা রামেক হাসপাতালে এখনো বাস্তবায়ন হয় নি।
রাজশাহী মেডিকেলে হাসপাতালে কর্মরত নারীরা বলছেন, যৌন হেনস্থা প্রতিরোধের জন্য অভ্যন্তরীণ কমিটি সম্পর্কে তারা কিছুই জানেন না। হাসপাতাল পরিচালকও বলছেন এমন কমিটির বিষয়ে তার জানা নেই।
হাসপাতালে কর্মরত নারীরা বলছেন, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিনিয়তই নারী কর্মীরা বুলিং ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। সুযোগ পেলেই কিছু পুরুষ সহকর্মী নারীদের স্পর্শ করার চেষ্টা করেন। শুধু সহকর্মী নয়; বহিরাগত পুরুষদের দ্বারাও যৌন হয়রানির শিকার হন। নানা কু-প্রস্তাব দেন। বিশেষ করে নারী ইন্টার্ন ডাক্তার ও নারী ইন্টার্ন নার্সরা বেশি যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন এমন নারীরা বলছেন, যৌন হয়রানির পরেও অভিযোগ করতে তারা সাহস করেন না সামাজিকভাবে হেয়পতিপন্ন হওয়ার ভয়ে। আর যারা একটু সাহস করে অভিযোগ করেন তাদেরকে প্রশাসন দ্বিতীয় দফা মানসিক নির্যাতনের মধ্যে ফেলেন। হয়রানিও করা হয়। প্রতিষ্ঠানের দুর্নামের অজুহাতে চুপ থাকতে বাধ্য করা হয়। এই অসহায়ত্বের পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে এখন আর কেউ মুখ খুলতে চান না। নিজের মধ্যেই অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।
সর্বশেষ ২০২১ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (রামেক) একজন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে হাসপাতালের এক নার্সকে যৌন হয়রানির অভিযোগ দেশজুড়ে আলোচনায় এসেছিলো। সে সময় আওয়াজ তুলে সোচ্চার হয়েছিলেন ওই নার্স। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা না পেয়ে আদালতের দ্বারস্থও হয়েছিলেন তিনি। যেখানে পুরো নার্স সমাজ তার পক্ষে ছিলো। কিন্তু তারপরেও ওই নার্সকে বিচার চাইতে গিয়ে নানা হয়রানির শিকার হতে হয়েছিলো বলে অভিযোগ করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশন রাজশাহী বিভাগের সভাপতি শাহাদাতুন নূর লাকি বলেন, রাজশাহী মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে ১ হাজার ২১১টি পদ। এরমধ্যে প্রায় ১ হাজার নারী। নার্সরা সেবার জন্য নিবেদিতপ্রাণ। নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে সেবা দিয়ে রোগীদের সুস্থ করেন। কিন্তু নার্সদের সুরক্ষা খুবই ক্ষীণ। নার্সরা প্রায়শই মানসিক, শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। কিন্তু হাসপাতালগুলোতে নির্যাতন বিরোধী কোনো সেল নেই। এমন কী রাজশাহী মেডিকেলেও কোনো সেল নেই; সেখানে নারী নার্সরা কথা বলতে পারে। তাদের প্রতি কোনো অন্যায় হলে নিজের পরিচয় গোপন রেখে অভিযোগ দিতে পারে। মৌখিক অনেক অভিযোগ আমার কাছে আসে।
কিন্তু সেটার প্রতিবাদ করতে সাহস করে না। কারণ এটা তার পরিবার জানলে সে চাপের মধ্যে পড়বে। একারণে এক নিরব আর্তনাদ নিয়ে অনেক নারী কাজ করে যাচ্ছেন। এ অবস্থার উত্তরণ জরুরি।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে এক ইন্টার্ন নারী নার্স বলেন, গত তিন মাস আগে হাসপাতালের ইমার্জেন্সির সামনে প্রকাশ্যে আমাদের একজনকে যৌন হয়রানি করা হয়। বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হলে, তারা চুপে করে যেতে বলেন। নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করা হয় যেন কোনোভাবেই এ কথা হাসপাতালের বাইরে বের না হয়। এমন বাস্তবতায় কীভাবে মুখ খুলবোÑ এমন প্রশ্ন তার।
২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি ১৫ নম্বর রাজশাহী মেডিকেলের ওয়ার্ডে তৎকালীন ইন্টার্ন চিকিৎসক অর্ণবের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির লিখিত অভিযোগ পরিচালককে দিয়েছিলেন তিন নারী রোগী। এই অভিযোগের পর এখন পর্যন্ত অভিযুক্তদের সঙ্গে কথাও বলেন নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
অভিযোগকারী নারী জাহানারা বেগম বলেন, ওই সময় ওই চিকিৎসক আমাকেসহ আরও দুই নারী রোগীকে বাজেভাবে স্পর্শ করছিলো। প্রথম দিন সবাই মিলে নিষেধ করা হয়। দ্বিতীয় দিন আবারও একই কাজ করেন। একারণে আমরা তিন রোগী অভিযোগ দিয়েছিলাম। ওই অভিযোগ দেয়ার পর এক সাংবাদিক একবার ফোন দিয়েছিলেন। এরপর আর কেউ কখনো যোগাযোগ করেন নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের একটি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান বলেন, এ বিষয়ে কথা বলতে নিষেধ আছে। তবে একটা কার্যকর কমিটি থাকলে খুবই ভালো হয়। অভিযোগ বক্সেরও দরকার আছে।
এ বিষয়ে রাজশাহী মেডিকেলের মেডিসিন বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. খলিলুর রহমান নির্যাতন প্রতিরোধী কমিটি হওয়া দরকার মন্তব্য করে বলেন, ‘আমরা যারা অধ্যাপক আছি, তারা এ বিষয়টি নিয়ে সরাসরি জড়িত না। তবে যে হয়, দু’একটা তা আমাদের কানে এসেছে। হাসপাতাল প্রশাসন এটা হ্যান্ডেল করে। তারা এটা মিট আপ করেন। প্রয়োজন হলে তারা আমাদের ডাকেন, তখন আমরা সহযোগিতা করি।’
রামেক অধ্যক্ষ ডা. নওশাদ আলী বলেন, আমাদের কলেজে কমিটি আছে। প্রতি দু’মাস পরপর আমরা নিয়মিত মিটিং করি। একেবারে অভিযোগ আসে না, এমনটা না। ১ম বর্ষের ছাত্রীদের থেকে কিছু অভিযোগ আসে। তবে আমরা সচেতনতামূলক কার্যক্রম সব সময়ই চালায়। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থাও নিই। আর হাসপাতালে নারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্ব হাসপাতাল প্রশাসনের। তারা সেটা কীভাবে করে তা জানা নেই। তবে নির্যাতন বিরোধী কমিটি থাকা অবশ্যই প্রয়োজনীয়।
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) এর রাজশাহী শাখা সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট সামিনা বেগম বলেন, আইন অনুযায়ী কর্মস্থলে অবশ্যই যৌন নির্যাতন বিরোধী কমিটি থাকতে হবে। এটাকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই।
রাজশাহী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসরিন আক্তার মিতা বলেন, কর্মস্থলে নারীর সুরক্ষা নিশ্চিতে হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী কমিটি থাকতে হবে। অভিযোগ বক্সও থাকতে হবে। কিন্তু রাজশাহী মেডিকেল হাসপাতাল প্রশাসন কেন এ বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছেন না তা জানা নেই। একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে অবশ্যই একটি কার্যকর কমিটির দাবি জানাচ্ছি।
মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের রাজশাহীর উপ-পরিচালক শবনম শিরিন বলেন, নিয়ম অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে ন্যূনতম ৫ সদস্যের নির্যাতন প্রতিরোধী কমিটি থাকতে হবে। যে কমিটির সভাপতি ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান হবেন। এবং কমিটিতে অবশ্যই সংখ্যাগরিষ্ঠ নারী থাকবেন। এ কমিটিতে মানবাধিকার কর্মীও থাকতে হবে। এখন হাসপাতালে তারা কীভাবে কী করছেন তা জানা নেই।
এ বিষয়ে রাজশাহী মেডিকেলের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল শামীম আহমেদ বলেন, এমন কমিটির বিষয়ে আমার জানা নেই। তবে অভিযোগ আমার কাছে সরাসরিই আসে। আর এখন অভিযোগ দেয়ার মতো অনেক পন্থা আছে। সেগুলোও তো ব্যবহার করা যায়। তারপরেও অভিযোগ বক্স স্থাপন করা হবে।