রাজশাহী-২ জোটের প্রার্থীকে ছাড় দিতে চায় না স্বতন্ত্র ও জাসদ

আপডেট: ডিসেম্বর ৩০, ২০২৩, ১২:০৫ পূর্বাহ্ণ


মাহী ইলাহি:


রাজশাহী-২ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা। তিনি টানা ১৪ দলের প্রার্থী হয়ে তিনবারের এই আসনের এমপি। ২০০৮ সালে বিএনপির প্রার্থী মিজানুর রহমান মিনুকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে প্রার্থী না থাকায় তিনি আবারও নির্বাচিত হন। সবশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে মিনুর সাথে ১৫ হাজার ভোটের ব্যবধানে তিনি জয়ী হন। কিন্তু এবার আর ছাড়তে চাচ্ছেন না অন্য প্রার্থীরা। ১৪ দলের নেতৃত্বাধীন জাসদেরও প্রার্থী আছে এই আসনে। এছাড়াও স্বতন্ত্র প্রার্থী জাতীয় পার্টি, বিএনএম, বাংলাদেশ কংগ্রেস ও সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের প্রার্থী আছে।

ফজলে হোসেন বাদশা বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ভোট করছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী। ফজলে হোসেন বাদশা পাশে পাচ্ছেন না আওয়ামী লীগসহ জোটের অন্যান্য দলের নেতাকর্মীদের। এবার অনেকটা তিনি ‘একা’ হয়ে গেছেন। নিজ দলের কর্মী ও সমর্থক নিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন।
ফজলে হোসেন বাদশার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী শফিকুর রহমান বাদশা। শক্ত অবস্থানে আছেন জাসদ প্রার্থী আবদুল্লাহ আল মাসুদ শিবলী। এই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য সাইফুল ইসলাম স্বপন, বিএনএম প্রার্থী কামরুল হাসান, বাংলাদেশ কংগ্রেসের প্রার্থী মারুফ শাহরিয়ার ও মুক্তিজোটের প্রার্থী ইয়াসির আলিফ বিন হাবিব। এই আসনে তিন প্রার্থী বাদে অন্য কারও প্রচারণা নেই। পুরো নির্বাচনে প্রচারণায় এগিয়ে আছে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাঁচি, ১৪ দলের প্রার্থীর নৌকা ও জাসদের মশাল প্রতীক।

এই নির্বাচনে ৮ ঘাট বেঁধে স্বতন্ত্র প্রার্থীকে জেতাতে মাঠে নেমেছেন আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কর্মীরা। স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন ছাত্রলীগ ও যুবলীগ। আওয়ামী লীগ নেতাদের ভাষ্য, ফজলে হোসেন বাদশা টানা তিনবারের এমপি হয়েও জোটের কারও সাথে সম্পর্ক রাখেননি। তিনি কোনো খোঁজখবরও রাখেননি। তিনি আমাদের কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে কথাও বলেছেন। আওয়ামী লীগ সম্পর্কে মন্তব্যও করেছেন। তাই এবার তার পক্ষে কাজ করছেন না কেউ।

নাম প্রকাশ করার না শর্তে মহানগর আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, আমরা কেউ নৌকার বিরুদ্ধে না। আমরা ব্যক্তি ফজলে হোসেন বাদশার বিরুদ্ধে ভোট করছি। তিনি টানা ১৫ বছরের এমপি ছিলেন। আমাদের একটি বারও ফোন দেননি। আর নৌকা নিয়ে আবেগের কথাবার্তা বললেও হবে না। স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার সুযোগ থাকায় আমরা শফিকুর রহমান বাদশাকে সমর্থন দিচ্ছি।

রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ২১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নিযাম উল আজিম নিযামের সাথে ভালো সম্পর্ক ছিল ফজলে হোসেন বাদশার। কাউন্সিলর নিযাম ফজলে হোসেন বাদশাকে ‘বড়ভাই’ বলে সম্বোধন করতেন। ফজলে হোসেন বাদশার দূর সম্পর্কের আত্মীয়ও তিনি। ২০১৮ সালে ২১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নিযাম ফজলে হোসেন বাদশার পক্ষে কাজ করেছিলেন। দুটি বিশাল শোডাউনও দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এবার তিনি পাশে নেই।

কাউন্সিলর নিযাম উল আজিম নিযাম বলেন, এবার আমরা পরিবর্তন চাই। তাই কাঁচি প্রতিকের পক্ষ নিয়েছি। বাদশা ভাইয়ের সাথে এক সময়ে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল। সর্ম্পক সবসময় এক রকম থাকে না, পরিবর্তনও হয়। আর আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যে কোনো কারও পক্ষে কাজ করা যাবে। তাই আমরা কাঁচি প্রতিকের পক্ষে আছি।
রাজশাহীতে ১৪ দলের মধ্যে পাঁচটি দলের কার্যক্রম আছে। এর মধ্যে নয়টি দলই নেই। আওয়ামী লীগ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ বাদে আছে দিলীপ বড়ুয়ায় সাম্যবাদী দল ও মোজাফ্ফর আহমেদের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। তবে সাম্যবাদী দল ও ন্যাপের শুধু কমিটিই আছে। তাদের কার্যক্রম নেই। তবে এই দুটি দলের নেতারাও জোট প্রার্থীর সাথে নেই।

ন্যাপের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান খান আলম এবার সমর্থন দিয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী শফিকুর রহমান বাদশাকে। তিনি বলেন, রাজশাহী-২ আসনে পরিবর্তন দরকার। শফিকুর রহমান বাদশার গণযোগাযোগও অনেক ভালো। তাকে সবসময় পাশে পাওয়া যাবে। এছাড়াও তিনি আমার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা। আমরা একসাথে মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলাম। তাই আমি তাকে এবার সমর্থন দিয়েছি। কারণ এবার কোনো বাধা দেখছি না।

জাসদের নেতৃবৃন্দ বলছেন, ফজলে হোসেন বাদশা এমপি থাকা অবস্থায় বিছিন্ন হয়ে গেছেন। এবার তারা মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে স্বতন্ত্র প্রার্থী শফিকুর রহমান বাদশার সাথে। দলটির কেন্দ্রীয় নেতা ও মহানগরের সভাপতি প্রার্থী হয়েছেন। তরুণ প্রজন্মের ভোট টানতে মাঠে কাজ করছেন তারা। তবে দলটির ধারণা, জাসদ এই নির্বাচনে ভালো অবস্থানে আছে। মাঠ পর্যায়ে ভালো সাড়াও পাওয়া যাচ্ছে।

জাসদের মহানগর সহসভাপতি শাহরিয়ার রহমান সন্দেশ বলেন, প্রচারণার শুরু থেকে আমরা ভালো সর্মথন পাচ্ছি। মানুষজনও পরিবর্তন চাচ্ছে। আমরাও ভোটে লড়াই করতে চাচ্ছি। এখানে চারজন প্রার্থীর সাথে প্রতিযোগিতা হতে পারে। আমরা কোনো দলকে ছোট করে দেখতে চাচ্ছি না। সাধারণ মানুষ সিদ্ধান্ত নেবে তারা কাকে মেনে নিচ্ছে।

ভোটের মাঠে লড়ছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থীর সাইফুল ইসলাম স্বপন। তিনি এর আগে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিলেন। এবার তিনি জয়ের বিষয়ে আশাবাদী। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আমার সফট কর্নার ছিল। আওয়ামী লীগের প্রার্থী এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন আমার ভাতিজা হয়। সেজন্য আমারও জেতার ইচ্ছা ছিল না। তবে এবার আমি মাঠ ছাড়বো না। জয়ী হয়ে আসবো।

এই আসনের আরেক প্রার্থী কামরুল হাসান। তিনি বিএনএম থেকে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। তিনি বলেন, প্রচারণা চালাচ্ছি। মানুষজনও সাড়া দিচ্ছে। কিন্তু তারা কতটুকু ভোট দেবে তা দেখার বিষয়। তিনি আরও বলেন, এই আসনে নৌকা ও কাঁচি নিয়ে একটি সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। এই সমস্যা নিরসন না হলে আমার জিতে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

জাসদ প্রার্থী আবদুল্লাহ আল মাসুদ শিবলী বলেন, মহানগরীর মানুষ পরিবর্তন চাচ্ছে। আমরাও পরিবর্তনের লক্ষ্যে প্রচারণা চালাচ্ছি। ভোটাররা আমারে সমর্থন দিচ্ছেন। অন্য প্রার্থীরা প্রচারণা চালাচ্ছেন। তবে আমারে প্রচারণায় ভিন্নতা এনেছি। আমাদের টার্গেট তরুণ ভোটাররা। তরুণরা আমাদের ভোট দিলে জয়ী হবো।

নৌকাকে সমর্থন না করলে আওয়ামী লীগ আত্মহননের পথে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন ওয়ার্কার্স পার্টির মহানগর সভাপতি লিয়াকত আলী লিকু। তিনি বলেন, ফজলে হোসেন বাদশাকে নৌকা প্রতীক দিয়েছেন ১৪ দলের নেত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু এখানকার নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সমর্থন দিচ্ছেন। তারা স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে তাকে জেতানো হবে আওয়ামী লীগের জন্য আত্মহনন। ফজলে হোসেন বাদশাকে হারানো মানে শেখ হাসিনাকে পরাজিত করা। নৌকাকে হারানো মানে স্বাধীনতাকে পরাজয় করানো। এতে শেখ হাসিনাও হারবে। ফজলে হোসেন বাদশা একা হারবে না। যারা স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সমর্থন করছে তারা কেউই আওয়ামী লীগের আদর্শ ধারণ করছে না।

স্বতন্ত্র প্রার্থী শফিকুর রহমান বাদশা বলেন, যিনি এমপি আছেন তিনি জনবিচ্ছিন্ন। জোটগত বাদে সাধারণ মানুষের সাথে তার কোনো যোগাযোগ নেই। আর এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে কোনো বাধা নেই তাই প্রার্থী হয়েছি। আমার নিজস্ব কিছু কর্মী আছে তারা আমাকে সহযোগিতা করছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষে নমনীয় কেন্দ্র। তিনি টানা তিনবারের এমপি থেকেও নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষদের মূল্যায়ন করেননি। আমি এই নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হবো।

টানা তিনবারের এমপি ফজলে হোসেন বাদশা কোনো ‘চ্যালেঞ্জ’ দেখছেন না। তিনি বলেন, বাংলাদেশে যত উন্নয়ন সব আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের। আর জোটগত সিদ্ধান্ত হওয়ায় এই নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছি। আমাকে প্রধানমন্ত্রী নিজে এই প্রতীক দিয়েছেন। মানুষ অচেনা কোনো প্রতীকে ভোট দেবে না। তারা অচেনা কোনো প্রতীকও চেনে না। নৌকা উন্নয়নের প্রতীক নৌকা মার্কায় ভোট দেবে।

উল্লেখ্য, রাজশাহী-২ (সদর) আসনটি সিটি করপোরেশনের ৩০টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত। এই আসনে মোট ভোটার আছে ৩ লাখ ৫২ ৭৮৩। পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৭১ হাজার ৪১৩। নারী ভোটার ১ লাখ ৮১ হাজার ৩৬৪। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার তিনজন।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ