মাহী ইলাহি ও মোস্তফা কামাল
পবা ও মোহনপুর নিয়ে গঠিত রাজশাহী-৩ আসন। ২০০৮ সালে এই আসনটি পুর্নগঠিত হয়। এর আগে বাগমারা-মোহনপুর ও বোয়ালিয়া-পবা নিয়ে পৃথক দুটি আসন ছিল। এই আসন থেকে ২০০৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা মেরাজ উদ্দিন মোল্লা। এরপর ২০১৪ সালে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আয়েন উদ্দিন। তিনি এই আসনে পরপর দুইবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নানা বিতর্কের কারণে এবার এই আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন সাবেক ছাত্র ও যুবনেতা এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ। তবে এই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী না থাকলে আসাদের সহজপথে বাধা হয়েছেন বিএনএম প্রার্থী অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান মন্টু। এই আসনে সাবেক দুই ছাত্রনেতার লড়াই হবে বলে মনে করছেন ভোটাররা।
এই আসনে এই দুই প্রার্থী বাদে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, জাতীয় পার্টির প্রার্থী আবদুস সালাম, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের প্রার্থী এনামুল হক, এনপিপি প্রার্থী সইবুর রহমান ও বিএনএফ প্রার্থী বজলুর রহমান। তবে এরাও নিজের এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হবে আশাবাদী। তবে এই আসনে নেই কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থী। এমপি আয়েন উদ্দিন স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। মনোনয়নও জমা দিয়েছিলেন তবে তিনি তা প্রত্যাহার করে নেন।
রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ছিলেন আসাদুজ্জামান আসাদ। তিনি ৮০ ও ৯০ দশকের ছাত্রনেতা। এছাড়াও দায়িত্ব পালন করেছেন জেলা যুবলীগের। যুবলীগ ছাড়ার পর সরাসরি আসেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে। এরপর হন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। আওয়ামী লীগের এই ত্যাগি নেতা বেশ কয়েকবার মনোনয়ন চেয়েও পাননি। অবশেষে রাজশাহী-৩ আসন থেকে আয়েন উদ্দিনকে হটিয়ে তাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। তবে রাজশাহী-৩ থেকে অনেক আগে নির্বাচন করার ইচ্ছা ছিল আসাদের। তিনি এই আসনের বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রচার করে বেড়িয়েছেন। তবে এই আসনে তার পথ অনেক সহজ হয়ে আছে বলে মনে করছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
এক সময়ের তুখোড় ছাত্রদল নেতা ছিলেন মতিউর রহমান মন্টু। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছিলেন সামনের সারিতে। বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াও তাকে খুব স্নেহ করতেন। রাজশাহী এলে যেতেন মন্টুর বাড়িতে। মন্টু দায়িত্ব পালন করেছেন জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও। ছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটিরও সদস্য। সেই মন্টু বিএনপি ছেড়ে যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে (বিএনএম)। পেয়েছেন কেন্দ্র্রীয় কমিটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যপদ। এই নির্বাচনে তিনি নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নির্বাচন প্রচারণার কৌশল অনুসরণ করছেন বিএনপির প্রভাবশালী নেতা প্রয়াত কবির হোসেনকে। নীরবে বিভিন্ন এলাকায় প্রচারণা চালাচ্ছেন তিনি।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বলছেন, আসাদুজ্জামান আসাদ আওয়ামী লীগের পরীক্ষিত সৈনিক। এবার তার প্রতি সুবিচার করা হয়েছে। এই আসনে আয়েন এমপি থাকা অবস্থায় তিনি নিজের বিশাল সম্পদ গড়ে তুলেছিলেন। দলীয় নেতাকর্মীদের উপরে চালিয়েছিলেন অত্যাচার। পারিবারিক রাজনীতি শুরু করেছিলেন। আওয়ামী লীগের ত্যাগি ও পরীক্ষিত নেতাদের মাইনাস করেছিলেন। এখন আবার ত্যাগি নেতারা ফিরে আসছেন। সকলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নৌকার পক্ষে কাজ করছেন।
দলীয় নেতাকর্মীরা মনে করছেন, এই নির্বাচনে আসাদ বিপুল ভোটে জয়লাভ করবে। তবে বাধা হতে পারেন এমপি আয়েন উদ্দিন ও তার কর্মীরা। কারণ হিসেবে তারা জানিয়েছেন, এমপি আয়েন এবার দলীয় মনোনয়ন চেয়ে পাননি। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন মনোনয়ন জমা দিয়েও প্রত্যাহার করে নেন। তবে তিনি মুখে নৌকা প্রতীককে সমর্থন দিলেও এখন পর্যন্ত মাঠে নামেননি। তার দুলাভাই মোহনপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুস সালামকেও দেখা যায়নি। তারা ভোটকেন্দ্র ভোটারদের যেতে বাধা দিবেন বলে ধারণা করছেন নেতাকর্মীরা।
কেশরহাট পৌরভার সাবেক কাউন্সিলর রুস্তম আলী প্রামাণিক বলেন, এমপি আয়েন উদ্দিন এলাকায় অনেক উন্নয়ন করেছেন। অনেক মানুষ নিষ্পেষিতও হয়েছেন। আমি আসলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে গড়া আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি। ১৯৮৬ সাল হতে নৌকার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির দায়িত্ব পালন করেছি। নৌকা প্রতীক যিনি পেয়েছেন তারই হয়ে ভোটের মাঠে কাজ করেছি। এবারে আসাদুজ্জামান আসাদকে নৌকা প্রতীককে বিজয়ী করতে নিরলস ভোট প্রার্থনা করছি।
মোহনপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেবুব হাসান রাসেল বলেন, নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আসাদুজ্জামানের প্রচারণায় জনসমর্থন দিন দিন বেড়েই চলেছে। নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে বিজয়ী হবেন।
এই আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আয়েন উদ্দিন বলেন, আমি ও আমার পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। নৌকার বিপক্ষে গিয়ে ভোট করতে পারবো না। আমার রাজনৈতিক জীবনও অনেক সংগ্রামের। জামায়াত-বিএনপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় আমি রাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেয়। সেখানে অত্যাচারের শিকার হয়েছি। আমাকে জননেত্রী শেখ হাসিনা এই আসনে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। এবার তিনি আমাকে দেননি। দিয়েছেন আসাদ ভাইকে। আসাদ ভাই আওয়ামী লীগের একজন ত্যাগি নেতা। আমি নৌকার বিপক্ষে যেতে পারবো না। আসাদ ভাইকে আমি সমর্থন দেবো।
স্থানীয়দের ভাষ্য, বিএনএম সমর্থিত প্রার্থী মতিউর রহমান মন্টু কৌশলী প্রচারণার মাধ্যমে দিন দিন তার সমর্থক বাড়িয়ে চলেছেন। তিনি বিএনপির প্রভাবশালী নেতা কবীর হোসেনকে অনুসরণ করে ভোট প্রচারণা চালাচ্ছেন। তার মোহনপুরে কর্মী-সমর্থকও অনেক আছে। তবে বিএনপির বেশকিছু নেতাকর্মী তার পক্ষে কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
বিএনএম প্রার্থী মতিউর রহমান মন্টু বলেন, এক সময়ে বিএনপির রাজনীতি করার কারণে আমার এলাকায় বেশ নামডাক আছে। বিএনপি ছেড়ে বিএনএমে যোগ দিলেও আমার সমর্থকরা আমার সাথে আছে। এখানকার বিএনপি নেতারা আমার পক্ষে কাজ করছে। আমি খুব সকালে বের হয়ে প্রচারণা করছি রাত পর্যন্ত। তবে এই নির্বাচনে আমার সাথে আসাদ ভাইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। আসাদ ভাইও একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। নির্বাচনী প্রচারণায় তার সাথে আমার দেখা হয়েছিল। আমরা দুজন কুশল বিনিময় করেছি। তবে এই আসন থেকে আমরা যেই জয়ী হয় না কেন এলাকার মানুষের জন্য কাজ করবো।
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক ভূমি প্রতিমন্ত্রী কবীর হোসেনের নির্বাচনি প্রচারণা কৌশল তিনি অনুসরণ করছেন বলে স্বীকারও করেন। তিনি বলেন, কবীর হোসেন ছিলেন আমাদের রাজনৈতিক গুরু। আমরা তার আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলাম। তিনি সাধারণ মানুষের রাজনীতি করেছেন। আমিও তাই করছি। বিএনপির বেশকিছু নেতা আমার সাথে আছেন। তবে সবাই তো ভোট দিতে আসবেন না। কিছু নেতাকর্মী ভোট দেবেন আবার কিছু নেতাকর্মী ভোটকেন্দ্রের ধারে কাছেও আসবেন না। অনেকে বোঝার চেষ্টাও করছেন। তবে ভোটের আগে অনেক কিছুই বোঝা যাবে।
আওয়ামী লীগ মনোনিত প্রার্থী আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, পবা-মোহনপুরে আমি দীর্ঘদিন থেকে কাজ করছি। সরকারে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরে মানুষের কাছে গিয়েছি। এলাকার ভোটাররাও আমাকে সমর্থন দিচ্ছেন। আমি নির্বাচনে জয়ের বিষয়ে আশাবাদী। প্রতিদ্বন্দ্বী মতিউর রহমান মন্টুর সাথে আমার প্রতিযোগিতা হবে। মন্টু এই আসনে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী।
তিনি আরও বলেন, আমি নির্বাচিত হলে এই আসনের মাটি ও মানুষের পাশে থাকবো সবসময়। এই এলাকার মানুষের শ্রদ্ধা, সম্মান প্রাপ্য সেটা আমি নিশ্চিত করব। আমি এমপি হয়ে কতদূর কী করতে পারবো জানি না, কিন্তু আমি এমন কিছু করতে চাই যাতে মৃত্যুর পরেও আপনারা আমাকে নিয়ে খারাপ কিছু বলার সুযোগ না পান। যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নিজেকে আমি বলি না, বলি আমরা। আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। আপনাদের ভোটে এমপি হলে আপনাদের প্রত্যাশা পূরণের চেষ্টা করবো।