মাহী ইলাহি ও রাশেদুল হক ফিরোজ:
বাগমারা উপজেলা নিয়ে গঠিত রাজশাহী-৪ আসন। এই আসনটি পুনর্গঠিত হয় ২০০৮ সালে। এর আগে মোহনপুর-বাগমারা নিয়ে ছিল রাজশাহী-৩ আসন। এই আসন থেকে জাতীয় পার্টির মন্ত্রীও ছিল। পরে আওয়ামী লীগ থেকেও এই আসনের এমপি মন্ত্রিত্ব পায়। ২০০৮ সালে বিএনপি প্রার্থী আবদুল গফুরকে পরাজিত করে জয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী এনামুল হক। এরপর ২০১৪ সালে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে বিএনপি প্রার্থী আবু হেনাকে পরাজিত করে আবারও জয়লাভ করেন এনামুল হক।
এবার দলের মনোনয়ন পাননি বাগমারা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এনামুল হক। তিনি এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নৌকা প্রতিকের বিপরীতে কাঁচি প্রতিক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজশাহী-৪ বাগমারা আসনে ছয়জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ মনোনিত নৌকা প্রতিকের প্রার্থী অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে কাঁচি প্রতীকের এনামুল হক, স্বতন্ত্র প্রার্থী মাথল প্রতিকের বাবুল হোসেন, জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকের আবু তালেব প্রামাণিক, বিএনএমের নোঙ্গর প্রতিকের সাইফুল ইসলাম রায়হান ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) মনোনিত ও গণতন্ত্র বিকাশ মঞ্চ সমর্থিত প্রার্থী আম প্রতিকের জিন্নাতুল ইসলাম জিন্না।
রাজশাহীর ৯টি উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত বাগমারা। এই উপজেলা থেকে বিএনপি- জামাত জোট সরকার আমলে জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আল মুজাহিদীন (জেএমবি) উত্থান ঘটে। তারা পুরো বাগমারাজুড়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। বিএনপি নেতাদের সহযোগিতায় চলে হত্যাযজ্ঞ। বাগমারা থেকেই কুখ্যাত সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে ‘বাংলা ভাই’ এর উত্থান ঘটে। বিএনপির নেতা. এমপি ও মন্ত্রিদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বাংলা ভাই রাজশাহীতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। যা দেশবাসীকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তোলে।
সর্বহারা নিধনের নামে বিরোধী রাজনৈতিক দলকে দমাতে তৈরি করা হয় জেএমবি। যদিও পরে এই সংগঠনটি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। মাঝে মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চায় জেএমবি। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে। ফলে জঙ্গিরা আর মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারছে না।
বাগমারা উপজেলাকে ‘রক্তাক্ত জনপদ’ বলা হতো। এখন এই এলাকায় শান্তির সুবাতাস বইছে। এখন ‘সর্বহারা পার্টি’ এবং জঙ্গিদের কোনো তৎপরতা নেই। এ ক্ষেত্রে কৃতিত্ব দািিব করে আসছেন বর্তমান সংসদ সদস্য প্রকৌশলী এনামুল হক।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে প্রচারে সমানে সমান যাচ্ছে আওয়ামী লীগ মনোনিত নৌকার প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী কাঁচি প্রতিকের ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। তবে ভোটাররা বলছেন, লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি। এলাকায় দুই প্রার্থীরই প্রভাব আছে। উপজেলা আওয়ামী লীগ ও জেলা আওয়ামী লীগ কাজ করছে নৌকা প্রতীকের পক্ষে। নিজস্ব সমর্থকদের নিয়ে জোর নির্বাচনি প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী এনামুল হক। তবে কালামের পক্ষে একাট্টা আওয়ামী লীগ। এই দুই প্রার্থীর সমর্থকরা প্রায়ই জড়িয়ে পড়ছেন সংঘর্ষে।
ঘটছে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা। এসব ঘটনা নিয়ে এলাকায় ছড়াচ্ছে আতঙ্ক।
স্থানীয় ভোটাররা বলছেন, এনামুল হক উন্নয়ন করলেও তার কিছু বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ছিল। তিনি এলাকার মানুষদের সাথে মিশতেন না। সবসময় চলাফেরা করতেন গাড়িতে। সাথে থাকতো তার নিজস্ব প্রটোকল। কালাম তার ঠিক উল্টো। তাহেরপুর পৌর মেয়র থাকা অবস্থায় তিনি এলাকার মানুষদের সাথে মিশেছেন। তবে যে প্রার্থী এবার জিতুক ভোটারদের আশা তারা মানুষের সাথে থেকে, মানুষদের নিয়ে মানুষের কল্যাণে কাজ করবে।
বাগমারা উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ বাজার হাটগাঙ্গোপাড়া। এই বাজার থেকে তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বাড়িগ্রাম। পেশায় ভ্যালচালক এখানকার ভোটার আফজাল হোসেন বলেন, বর্তমান সরকারের সময় উন্নয়ন ভালো হয়েছে। রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ নির্মাণও হয়েছে। এছাড়াও এই উপজেলায় বিদ্যুতও আছে। ১০ বছর আগেও সবার ঘরে ঘরে ছিল না বিদ্যুত। যে প্রার্থী জিতুক না কেন উন্নয়ন যেন অব্যাহত থাকে আশা এই ভোটারের।
বাগমারা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের চায়ের দোকান কিংবা বাজারে নির্বাচন নিয়ে আলোচনামুখর স্থানীয়রা। কে জিতবে ভোটে তা নিয়ে চলছে তর্ক-বিতর্ক। তবে এই উপজেলার প্রধান কাজই হচ্ছে কৃষি। চায়ের দোকানের আড্ডায় মানুষরা বলছেন, এবার কৃষিখাতকে গুরুত্ব দিলে আরও ভালো হবে। সেই সাথে ভাঙতে হবে বাজার সিন্ডিকেট। এই আসন থেকে কে জিতবে তা নিয়ে মাথা ব্যথা নেই ভোটারদের। তবে তাদের প্রত্যাশা সরকার যেন এবার কৃষিখাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়। যেই জিতুক কৃষকদের পাশে থাকে যেন এখানকার সংসদ সদস্য।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা জানান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কয়েক দিন আগে উপজেলা আওয়ামী লীগ এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। সংসদ সদস্য এনামুল হকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শিকদারীর সালেহা-ইমারত কোল্ড স্টোরেজে এই সভার আয়োজন করা হয়েছিল। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন এনামুল হক। প্রধান অতিথি ছিলেন রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অনিল কুমার সরকার।
সভায় নৌকার প্রার্থীকে বিজয়ী করার জন্য একসঙ্গে মাঠে কাজ করার অঙ্গীকার করেন দলীয় নেতাকর্মীরা। সভা শেষে সংসদ সদস্য এনামুল হক মুষ্টিবদ্ধ হাতে নেতাকর্মীদের শপথবাক্য পাঠ করান। যেখানে তিনি দলের নেতা-কর্মীদের নৌকার বিজয় না হওয়া পর্যন্ত ঘরে না ফেরার অঙ্গীকার করেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। ৫৩ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে দেখা যায়, সংসদ সদস্য এনামুল হক মুষ্টি হাতে নেতা-কর্মীদের শপথবাক্য পাঠ করান। তার সামনে থাকা দলের বিভিন্ন স্তরের দুই শতাধিক নেতা-কর্মী একই ভঙ্গিতে শপথ করেন। ওই ভিডিওতে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি শপথ করিতেছি যে, দলের নেতা হিসেবে, আমার ওপর যে কোনো দায়িত্ব অর্পিত হবে, তা সুষ্ঠু ভাবে পালন করিবো। এর কোনো ব্যত্যয় হবে না, আগামী জাতীয় নির্বাচনে দলের নৌকা প্রতীক বিজয় না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরবো না।’
নির্বাচনে এনামুল হক দলীয় মনোনয়ন পাননি। এখানে মনোনয়ন পেয়েছেন তাহেরপুর পৌরসভার মেয়র ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপ-কমিটির বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ। তবে এনামুল হক স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। প্রতীক বরাদ্দের পর গত ১৯ ডিসেম্বর এনামুল হক তার অনুসারীদের নিয়ে উপজেলা সদর ভবানীগঞ্জ নিউমার্কেট এলাকায় পথসভা করেন। সেখানে তিনি কাঁচি মার্কায় ভোট চান। ওই দিনই তিনি প্রথম নৌকার বদলে কাঁচিতে ভোট চেয়েছেন।
এনামুল হকের কয়েকজন সমর্থক ও উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সংসদ সদস্য এনামুল হকের ওই শপথের কারণে তারা বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন। ভোটারদের কাছে গেলে পাল্টা কথা শুনতে হচ্ছে। কারণ তিনি আমাদের নৌকা প্রতীকে থাকার জন্য শপথ করিয়েছিলেন। আমরা সেই শপথ ভাঙতে পারছি না।
সংসদ সদস্যের সঙ্গে শপথ নেওয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম সারওয়ার আবুল বলেন, তিনিসহ দলের মূলধারার নেতারা শপথ রক্ষা করে চলেছেন। নেতারা ঐক্যবদ্ধ ভাবে শপথ রক্ষা করে নৌকার পক্ষে কাজ করছেন। সংসদ সদস্য এনামুল হকের শপথ অনুসারে নৌকার বিজয় নিয়েই তারা ঘরে ফিরবেন।
শপথবাক্য পাঠ করা এনামুল হকের অনুসারী উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আসাদুল ইসলাম বলেন, সংসদ সদস্য তাদের যে শপথ পাঠ করেছেন, তা ভাঙার উপায় নেই, তাই নৌকার পক্ষেই কাজ করছেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও বাগমারা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জাকিরুল ইসলাম সান্টু বলেন, সংসদ সদস্য এনামুল হকের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ আছে। তিনি নারী কেলেঙ্কারিতে বেশ কয়েকবার জড়িয়ে ছিলেন। এছাড়াও ত্যাগি নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন না করে জেএমবি ও সর্বহারার ক্যাডারদের দলে নিয়ে এসে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
আমরা এবার বেশ কয়েকজন দলীয় মনোনয়নের আশায় ছিলাম। অবশেষে অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। তিনি জিতলে এই এলাকার আরও পরিবর্তন হবে।
তবে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য সংসদ সদস্য এনামুল হককে কল দিলে তিনি রিসিভ করেননি। তার বক্তব্য নেয়ার জন্য এনামুল হকের মিডিয়া কর্মকর্তা শামীম রেজাকে ফোন দিলে তিনি বলেন, ‘স্যার প্রচারণায় ব্যস্ত আছেন তিনি এই সময় বক্তব্য দিতে পারবেন না। আপনার জরুরি হলে যেখানে তিনি প্রচারণা চালাচ্ছেন সেখান থেকে নিতে হবে। নাহলে কাউকে পাঠিয়ে বক্তব্য নেওয়ান।’
এই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আরও চার প্রার্থী। এই আসনে বিএনএম থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন সাংবাদিক সাইফুল ইসলাম রায়হান। তিনি বলেন, প্রচারণা চালাতে গিয়ে ভালো সাড়া পাচ্ছি। মানুষজন আমাকে ভালো সমর্থন দিচ্ছেন। অন্য প্রার্থীদের থেকে এগিয়ে আছি।
এই আসন থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন এনপিপির ভাইস চেয়ারম্যান জিন্নাতুল ইসলাম জিন্না। তিনি বলেন, হয়তো ভোটে জিততে পারবো না। তবে আমার পজিশন খুব ভালো আছে। মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে ভোটপ্রার্থনা করছি। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি তাই এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছি। আমাদের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিরাও এসে নির্বাচন প্রচারণায় অংশ নিচ্ছে।
জাতীয় পার্টির প্রার্থী ও উপজেলা সভাপতি আবু তালেব প্রামাণিক বলেন, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রচারণা চালাচ্ছি। প্রতিটি ইউনিয়নে একটি নির্বাচনী ক্যাম্প ও দুটি পৌরসভায় দুটি ক্যাম্প করেছি। অন্য প্রার্থীদের সমস্যা হলেও আমার প্রচারণা চালাতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
আওয়ামী লীগ মনোনিত প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ বলেন, সংসদ সদস্য এনামুল হক হলেও পুরো বাগমারাতে আমার নামডাক আছে। সবার বিপদে আপদে ছুটে গেছি। তরুণরা আমাকে বেশ সমর্থন করছেন। তারা ভোট দিয়ে জিতিয়ে নিয়ে আসবেন। পুরো আওয়ামী লীগ আমার সাথে আছেন। সবাই আমাকে সহযোগিতা করছেন নির্বাচনে জেতার জন্য।
বৃহত্তম বাগমারা উপজেলায় ১৬টি ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভা। এই আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৬ হাজার ৩৫২ জন। পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৫৩ হাজার ৮৪৯ জন। নারী ভোটার ১ লাভ ৫২ হাজার ৫০০ জন। এই আসনে তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার আছে তিনজন।