মাহী ইলাহি, এসএম শাহজামাল ও আকাশ ঘোষ:
দুর্গাপুর ও পুঠিয়া উপজেলা গঠিত রাজশাহী-৫ আসন। এই আসনে বিভিন্ন দলের প্রার্থীরা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই আসনটি আগে রাজশাহী-৪ ছিল। ২০০৮ সালে ভাগাভাগিতে রাজশাহী-৫ ও জাতীয় সংসদে নম্বর হয় ৫৬। ২০০৮ সালে বিএনপির নেতা নজরুল ইসলামকে হারিয়ে জয় তুলে নেন আবদুল ওয়াদুদ দারা। পরপর দুইবার এই আসনে তিনি সংসদ ছিলেন।
২০১৮ সালে এই আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন চিকিৎসক মনসুর রহমান। তিনি বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম মণ্ডলকে হারিয়ে জয়লাভ করেন। আবারও এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন আবদুল ওয়াদুদ দারা। মনসুর রহমান স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে মনোনয়ন তুললেও তা পরে প্রত্যাহার করে নেন। এই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন জেলা যুবলীগের সাবেক সহসভাপতি ওবায়দুর রহমান। নৌকা প্রার্থী দারাকে ছাড় দিতে নারাজ ঈগল প্রতিকের প্রার্থী ওবায়দুর রহমান।
রাজশাহী-৫ আসনে প্রতিক বারাদ্দের পর প্রথম দিকে প্রার্থীদের মধ্যে কিছুটা নিষ্ক্রিয়ভাব দেখা গেলে বর্তমান মনোনিত প্রার্থী ছাড়াও স্বতন্ত্র প্রার্থী মাঠ গরম করে রেখেছেন। এই আসনে আওয়ামীলীগ মনোনিত প্রার্থীর চেয়ে একই দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীকে নিয়েই বেশি আলোচনা।
এ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনিত প্রার্থীসহ ছয়জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এরমধ্যে রয়েছে আওয়ামী লীগ মনোনিত প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াদুদ দারা, ঈগল প্রতিক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী যুবলীগের সাবেক সহ-সভাপতি ওবায়দুর রহমান, জাতীয় পার্টি মনোনিত প্রার্থী আবুল হোসেন, গণফ্রন্ট মনোনিত প্রার্থী মখলেসুর রহমান, বিএনএম মনোনিত প্রার্থী শরিফুল ইসলাম ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির আলতাফ হোসেন মোল্লা নির্বাচন করছেন।
রাজশাহীর সবচেয়ে জটিল আসন এটি। একাদশ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে এ আসনে প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে গৃহদাহ হলেও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তার উল্টো চিত্র দেখা যায় । নির্বাচনের মাঠে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দলের পাশাপাশি এবার স্বতন্ত্র প্রার্থীর সাথে গৃহদাহ চলছে। তবে অন্যান্য দলের সাথে থাকা জাতীয় পার্টিও নির্বাচনী মাঠে রয়েছে। তৃণমূল প্রচার প্রচারণা পিছিয়ে নেই জাতীয় পার্টিও। এবার এ আসনে দলীয় মনোনয়নকে ঘিরে নৌকাকে বিজয়ের লক্ষ্যে মাঠে আছেন আওয়ামী লীগ প্রভাবশালী নেতারা। পাশাপাশি তৃণমূল আওয়ামী লীগে রয়েছে নৌকার বিজয়ের পক্ষে।
দলীয় মনোনয়ন নিয়ে এলাকায় জনসংযোগ, উঠান বৈঠকসহ নির্বাচনী নানা কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছেন। এ ছাড়া নির্বাচনি এলাকার রাস্তাঘাট, পথ-প্রান্তর, হাটে-ঘাটে আর মাঠে শুভেচ্ছা মাধ্যমে প্রার্থীরা ভোট প্রার্থনা করছেন। সাধ্যমত তৃণমূল ভোটারদের সাহায্য-সহযোগিতায় পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টাও করছেন তারা। এ ছাড়া ভোটযুদ্ধে জয়ী হতে তৃণমূলে চালিয়ে যাচ্ছেন প্রচারণা।
রাজশাহী-৫ আসনটি বিএনপির ঘাঁটি বলা হলেও স্বাধীনতার পর প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এখানে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ নেতা শাহ মোহাম্মদ জাফরুল্লাহ। এরপর ৫ম জাতীয় সংসদের ফলাফলে বিএনপি সরকার গঠন করলেও এ আসন থেকে জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি তাজুল ইসলাম মোহাম্মদ ফারুক সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ পর্যন্ত সব মিলে চারবার এখান থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন নৌকার প্রার্থীরা।
এছাড়াও এখানে ১৯৮৬ সালের ৩য় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রয়াত মুহাম্মদ আয়েন উদ্দীন। আর জাতীয় পার্টির অধ্যাপক আবুল হোসেন চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে রাজনৈতিক নানা সমীকরণের ফলে বর্তমানে এখানে নির্বাচনে জেতার মতো অস্তিত্ব নেই জাতীয় পার্টির।
কিন্তু এলাকায় প্রচার আছে সারাদেশের মধ্যে যে কয়েকটি আসন দাবি করেছে পার্টির চেয়ারম্যান তার মধ্যে রাজশাহী-৫ অন্যতম। অধ্যাপক আবুল হোসেন এরইমধ্যে তৃণমূল ভোটারদের মধ্যে সাড়া ফেলেছেন। এর প্রেক্ষিতে এলাকায় প্রচারণায়ও রীতিমতো রয়েছেন আবুল হোসেন। তবে বর্তমান তৃণমূলের চিত্র একটু উল্টো। টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের মনোনীত পার্টি আব্দুল ওয়াদুদ দারার জনপ্রিয়তার কাছে পিছিয়ে রয়েছে স্বতন্ত্র সহ অন্যান্য দলেরর প্রার্থীরা।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জানান, এই আসনে নৌকার মূল প্রতিদ্বন্দ্বি হয়ে উঠেছে ঈগল প্রতিক। তার পক্ষে নেমেছে আওয়ামী লীগের জৈষ্ঠ্য নেতারা। এছাড়াও আছে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা। কেউ গোপনে কেউ নেমেছে প্রকাশ্যে ঈগল প্রতিকের পক্ষ নিয়ে। প্রথম দিকে দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী যুবলীগের সাবেক সহ-সভাপতি ওবায়দুর রহমানও নিষ্ক্রিয়তার পরিচয় দেন। কিন্তু সময় গড়ানোর সাথে সাথে দলের সিনিয়র নেতাকর্মীদের পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থী ওবায়দুর রহমানও সতেজ হয়ে উঠেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ আসনের প্রবীণ রাজনীবিদ থেকে শুরু করে নবীনরাও নৌকা ছেড়ে এখন ঈগলের ডানায় উঠে দাঁড়িয়েছেন।
পুঠিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহরিয়ার রহিম কনক বলেন, কেন্দ্রীয়ভাবে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে নিষেধাজ্ঞা না থাকায় আমরা ঈগলের পক্ষে কাজ করছি। স্বতন্ত্র প্রার্থীর হয়ে কাজ করছি। কারণ নেতাকর্মীরা যার কাছে মূল্যায়ন পাবে সেখানেই যাবে, এটাই স্বাভাবিক।
দুর্গাপুর পৌর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল বাসার দলের বাইরে যাইনি মন্তব্য করে বলেন, সাবেক এমপি দারা মনোনয়ন পেয়েছেন এটাই অনেক। তার ভোটের দরকার নাই। তিনি আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়ে দলের লোকজনদের মারপিট, নির্যাতন চালাচ্ছেন। এখনি যদি এই অবস্থা হয় তাহলে পরে কি হতে পারে। যার কারণে পৌর যুবলীগের সকল নেতাকর্মী স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছি। তবে এ আসনটিতে নৌকা জয়ী হতে হলে প্রেক্ষপট পরিবর্তন করতে হবে।
স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক ও রাজশাহী জেলা যুবলীগের সাবেক সহ-সভাপতি ওবায়দুর রহমান বলেন, আমি প্রচার-প্রচারণা করতে গিয়ে প্রতিকুল পরিবেশের সম্মুখীন হচ্ছি। আমার সমর্থকরা বিভিন্ন যায়গায় প্রচারণা চালাতে গিয়ে মারও খাচ্ছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে কর্মী নামানোও অনেক দুষ্কর। তবে আমার জন্য দলের নিবেদিত প্রাণরা কাজ করছেন। বলতে গেলে এখন সবাইকে পাশে পাচ্ছি। আমাকে জয়ী করার জন্য আমার সমর্থকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। আমি জয়ের বিষয়ে শতভাগ আশাবাদী।
আওয়ামী লীগের মনোনিত প্রার্থী আবদুল ওয়াদুদ দারা নির্বাচনে তার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বি দেখছেন না। তিনি বলেন, আমি এই আসনের এমপি ছিলাম। এখানকার মানুষগুলো আমার পরিচিত। তাদের জন্য আমি উন্নয়নে কাজ করেছি। এমপি হয়ে আবারও তাদের জন্য কাজ করবো। আমরা শান্তি প্রিয় মানুষ, পুঠিয়া-দুর্গাপুরের মানুষ বরাবরই শান্তি প্রিয়। এখানে কেউ যদি কোন শান্তি বিনিষ্ট করার চেষ্টা করে তাকে জনগণ প্রতিহত করবে। এখন পর্যন্ত সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচনি পরিবেশ এখন পর্যন্ত বজায় আছে।
জাতীয় পার্টির মনোনিত প্রার্থী অধ্যাপক আবুল হোসেন বলেন, জয়ের বিষয়ে আমি শতভাগ আশাবাদী। এই এলাকার মানুষজন পরিবর্তন চায়। আমি চাই এখানে শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন হোক। গ্রামে-গঞ্জে লাঙ্গলের ভালো একটি প্রভাব আছে। পল্লীবন্ধু এরশাদকে সবাই মনে রেখেছেন। সাধারণ মানুষরা চায় জাতীয় পার্টি সরকার গঠন করুক। এই নির্বাচনে সাধারণ মানুষ যদি স্বতস্ফুর্ত ভানে ভোট দেয় তাহলে জাতীয় পার্টি জিতে যাবে।
পুঠিয়া উপজেলার প্রাণকেন্দ্র ত্রিমোহনী বাজার। বাজারের এক ব্যবসায়ী বলেন, নির্বাচন যে সরকারের অধীনে হোক আমরা চাই নির্বাচনের আগে পরে কোন ঝামেলা না হয়। আর যে ক্ষমতায় আসুক না কেন আমরা চাই পুঠিয়াবাসী যাতে সুন্দরভাবে থাকতে পারে। এই এলাকার যেন উন্নয়ন হয়। উন্নয়নবঞ্চিত হোক আমরা তা চায় না।
বানেশ্বর বাজারের চায়ের দোকানী বলেন, আমাদের আসনে নির্বাচনে স্বতন্ত্রপ্রার্থী ওবায়দুর ভাই দাড়িয়েছে। সে মোটামুটি মানুষ হিসেবে খারাপ না। আমরা আশা করছি নির্বাচনে জিতে যাবে। সে নির্বাচনে জিতলে এই এলাকার মানুষের কোন লোকসান নেই। গরিবের সঙ্গেও তারা যেমন ব্যবহার করে বড় লোকদের সঙ্গেও একই রকম। এমনকি তার কর্মীদের নামেও চাঁদাবাজি বা কারোর সঙ্গে ঝামেলা করে না। আমরা মোটামুটি শান্তিতেই ব্যবসা করতে পারি। তবে ভোটে জেতার পরে কি হবে সেটা জানি না।
রাজশাহী কলেজপড়ুয়া নিলয় দাস বলেন, এই সরকার অনেক উন্নয়ন করছে কিন্তু আমাদের মতো বেকারদের জন্য কিছু করছে না। আমাদের একটায় চাওয়া সরকার এবার ক্ষমতায় এসে বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে। শুধু সরকারি চাকরি না আমাদের উদ্যোক্তা হতেও সহায়তা করে।
দুর্গাপুর উপজেলার ভ্যানচালক আবদুল খালেক বলেন, আমরা গরীব মানুষ। আমাদের আর কি চাওয়া থাকবে। সবকিছুর দাম বেশি। সরকার যদি সবকিছুর দাম স্বাভাবিক নিয়ে আসে তাহলে আমরা ডাল ভাত খেয়ে বাঁচতে পারবো। আমরা চায় সবকিছুর দাম কমুক। আর যে সরকার গঠন করুক না কেন তার কাছে এই আমাদের প্রত্যাশা।
এই এলাকার ভোটাররা বলছেন, এই এলাকাতে সংঘর্ষের কোনো আশঙ্কা নেই। সবাই সৌহার্দপূর্ণ আচরণ করছেন। এটা যেন বজায় থাকে। ভোটের পরে সব প্রার্থীই যেন একে অপরের সাথে আন্তরিকতা দেখান। ভোটের পরেও আমরা আমরা সংঘর্ষ চায় না। এই এলাকায় শান্তিতে থাকতে চায়।
রাজশাহী-৫ আসনে দুটি পৌরসভা ও ১৩টি ইউনিয়ন পরিষদ আছে। এই আসনের মোট ভোটার ৩ লাখ ৩৭ হাজার ১৯৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার আছেন ১ লাখ ৬৯ হাজার ১৩১ জন। নারী ভোটার আছেন ১ লাখ ৩৮ হাজার ৬৩ জন। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার আছের চারজন।