মাহী ইলাহি, নজরুল ইসলাম বাচ্চু ও আমানুল হক আমান:
টানা তিনবারের সংসদ সদস্য সরকারের পররাষ্ট প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে সফলতা দেখিয়েছেন। সমালোচনা, বিতর্ক এসব থেকে দূরেই থেকেছেন সব সময়ই। কিন্তু বিতর্ক এড়াতেও পারেন নি। নানা বিতর্কের মধ্যে তার জনপ্রিয়তায় টান পড়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজের নির্বাচনি এলাকায় সেই প্রভাবই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিতর্কের প্রথমেই আছে- শাহরিয়ার আলম তার নির্বাচনি এলাকার পোড়-খাওয়া আওয়ামী লীগ নেতাকর্মিদের উপেক্ষা করেছেন। এই উপেক্ষা তৃণমূলের নেতাকর্মিদের ক্ষুব্ধ করেছে। শাহরিয়ার আলমের চেয়ে এই আসনে প্রচারণায় এগিয়ে আছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী রাহেনুল হক। আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশও আছে তার সাথে।
এবারও আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে টানা চতুর্থবার আসনটিতে নির্বাচন করছেন শাহরিয়ার আলম। গত তিনবার জয়ী হলেও এবার সেখানে তার জয়ে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা রাহেনুল হক রায়হান। তার প্রতীক কাঁচি। তার বাড়ি চারঘাট উপজেলার শালুয়া ইউনিয়নে।
১৫ বছর রাজশাহী-৬ আসনে প্রভাবের সঙ্গে রাজনীতি করলেও এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজের নির্বাচনি এলাকায় ‘বহিরাগত তকমা’ লেগেছে শাহরিয়ার আলমের গায়ে। এলাকায় কম যাতায়াতও তাকে ভোটের মাঠে অনেকটা পিছিয়ে রেখেছে।
ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী উপজেলা বাঘা ও চারঘাট। পদ্মা পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা এই দুই উপজেলা নিয়ে গঠিত রাজশাহী-৬ আসন। স্বাধীনতার পর এ আসনে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দলের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দু’টি উপ-নির্বাচনসহ সাতটি সংসদীয় নির্বাচনের চার বার আওয়ামী লীগ, তিন বার বিএনপি ও একবার আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী নির্বাচিত হন।
১৯৯১ ও ২০০১ সালে বিএনপির মনোনিত প্রার্থী এখানে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে প্রয়াত আজিজুর রহমান এবং ২০০১ সালে সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত কবির হোসেন বিএনপির মনোনয়ন পেয়ে এমপি হয়েছিলেন। আর ১৯৯৬ সালে বিএনপির মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হোন প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা ডা. আলাউদ্দিন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার আনিসুর রহমান। তবে দলের মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে বিএনপির মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের ফিরে যান ডা. আলাউদ্দিন। তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল হলে ১৯৯৭ সালের উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ফের তিনি এমপি হন এবং প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান।
এর পর ১৯৯৯ সালে তিনি মারা যাওয়ার পর ওই আসনের উপ-নির্বাচনে এখানে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতা রাহেনুল হক রায়হান বিজয়ী হন। উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নুরুল ইসলাম ঠাণ্ডু। ২০০১ সালের নির্বাচনে রায়হানুল হক রায়হান আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেও সেবার বিদ্রোহী প্রার্থী হন বাঘা পৌরসভার মেয়র আক্কাস আলী। তার বিদ্রোহের কারণে বিএনপির প্রার্থীর কাছে হেরে যান রায়হান। তবে সবাইকে পেছনে ফেলে ২০০৮ সালের নির্বাচনে দলের মনোনয়ন ছিনিয়ে নেন শিল্পপতি শাহরিয়ার আলম। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনেও তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রার্থিতা ঘোষণা হওয়ার পর শাহরিয়ার আলম নিজ দলের নেতাকর্মীদের তুমুল বিদ্রোহের মুখে পড়েন। এমনকি এলাকায় শাহরিয়ার আলমকে অবাঞ্ছিতও ঘোষণা করে আওয়ামী লীগের একাংশের নেতাকর্মীরা। তবে মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের এক জায়গায় নিয়ে গিয়ে ২০০৮ সালে বিপুল ভোটের ব্যবধানে এমপি নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে দ্বিতীয়বার এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে তৃতীয়বারের মত এমপি হন শাহরিয়ার আলম। কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতা রাহেনুল হক রায়হান বিদ্রাহী প্রার্থী হন। এ নির্বাচনে অন্য দলের প্রার্থী না থাকায় বিদ্রোহীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয় পান এই শিল্পপতি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি চতুর্থবারের মত আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। তবে তাকে এবার ছাড় দিতে নারাজ স্বতন্ত্র প্রার্থী রাহেনুল হক রায়হান।
এই আসন থেকে নির্বাচন করছেন আরও চার প্রার্থী। তারা হলেন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের মনোনিত প্রার্থী জুলফিকার মান্নান জামী, জাতীয় পার্টির প্রার্থী শামসুদ্দিন রিন্টু ন্যাশনাল পিপলস পার্টির মহসিন আলী ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের (বিএনএম) অধ্যক্ষ আবদুস সামাদ। তবে নোঙর প্রতিক বাদে অন্য প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা দেখা যাচ্ছে না।
স্বতন্ত্র প্রার্থী রাহেনুল হক রায়হানের পক্ষে নেমেছেন আওয়ামীলীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতারা এবং স্থানীয় সাবেক ও বর্তমান জনপ্রতিনিধিরা। তারা এই নির্বাচনি নৌকা ছেড়ে কাঁচির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। সিনিয়র নেতা ও স্থানীয়দের এমন বিভক্তির ফলে ভোটযুদ্ধে নৌকাকে হাড্ডাহাড্ডি প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে ফেলেছে কাঁচি। ভোটযুদ্ধে শাহরিয়ার আলমের নৌকাকে পেছনে ফেলতে পারেন স্বতন্ত্র প্রার্থী রাহেনুল হকের কাঁচি, এমন কথা চাওর হচ্ছে ভোটারদের মধ্যে। ভোটকে কেন্দ্র করে আওয়ামীলীগের সিনিয়র নেতাদের দ্বিধাবিভক্ত অবস্থানের ফলে দুই প্রার্থীর অফিস ভাঙচুর ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থককে পিটিয়ে আহত করার ঘটনাও ঘটেছে। তাতে নির্বাচনে কেন্দ্র করে নৌকা ও কাঁচির কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কাও করছেন স্থানীয় ভোটাররা।
স্থানীয় নেতাকর্মীরা জানান, চারঘাট উপজেলার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মাঝে দ্বিধাবিভক্তি কাজ করছে। এতে স্বতন্ত্র প্রার্থী রাহেনুল হক অনেকটা গোছানো প্রচারণা চালালেও শাহরিয়ার আলমের কর্মীদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এদিকে ছয়জন প্রার্থীর মধ্যে একমাত্র রাহেনুল হকের বাড়ি চারঘাট উপজেলায়। তার সাথে বর্তমান দুই ভাইস চেয়ারম্যানও রয়েছে। সবমিলিয়ে নিজ উপজেলাতেও শক্ত অবস্থানে রয়েছেন তিনি। রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও বাঘা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান লায়েব উদ্দিন লাভলু, জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও বাঘা পৌর মেয়র আক্কাস আলী, বাঘা উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল মোকাদ্দেস, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বাঘার পাকুড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান মেরাজ উদ্দিন কাঁচি প্রতীকের রাহেনুল হকের পক্ষে পুরো বাঘা উপজেলা চষে বেড়াচ্ছেন।
চারঘাট উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি গোলাম কিবরিয়া বিপ্লব, নারী ভাইস চেয়ারম্যান তাজমিরা খাতুন, ইউসুফপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান শফিউল আলম রতন, ভায়ালক্ষীপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান শওকত আলী বুলবুল, সরদহ ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান ও ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা মতিউর রহমান তপন, পৌর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল ইসলামসহ অনেকেই নৌকা ছেড়ে কাঁচির পক্ষে মাঠে নেমেছেন।
শাহরিয়ার আলমের পক্ষে কাজ করছেন, চারঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান ফখরুল ইসলাম, আড়ানী পৌর মেয়র মুক্তার আলী, চারঘাট পৌর মেয়র একরামুল হকসহ বেশ কিছু ইউপি চেয়ারম্যান, স্থানীয় ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতৃবৃন্দ।
চারঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক দফতর সম্পাদক জালাল উদ্দিন বিশ্বাস বলেন, ত্যাগী নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে তিনি (শাহরিয়ার আলম) হাইব্রিডদের নিয়ে নিজস্ব গোষ্ঠী তৈরি করেছেন। তিনি এবং তার কর্মী বাহিনীর কথায় ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে আসবে না। এজন্য কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর লক্ষে নৌকায় না চড়ে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পাশে দাঁড়িয়েছি। কাঁচিকে বিজয়ী করেই ঘরে ফিরবো।
চারঘাট সদর এলাকায় আফরোজা বেগম বলেন, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট কেন্দ্রে ভোট দিতে পারি। আমরা চায় না কোনো প্রার্থী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ুক। আর সংঘর্ষ হলে প্রাণ যায় সাধারণ মানুষের। কোল খালি হয় কোনো মায়ের।
আহসান হাবিব নামের আরেক ভোটার বলেন, যারা এলাকায় উন্নয়ন করবে এবং দরিদ্র গরিব মানুষের পাশে থেকে কর্মসংস্থান করবে তাকেই ভোট দিবো। এতদিন তো একজনকে দেখলাম। এবার আরেকজনকে দেখি।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত চারঘাট পৌরসভার মেয়র একরামুল হক একরাম বলেন, নৌকা হেরে যাওয়ার কোনো কারণ দেখছি না। ভোটের দিনের অপেক্ষা করছি। সেদিন দেখিয়ে দেব। যারা প্রতিমন্ত্রীর কাছে সুবিধা পায়নি তারা বিরোধিতা করছেন এখন। তার দাবি, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা উগ্রতা দেখাচ্ছে, প্রচারণায় এগিয়ে আছে, এটা সত্য। আমাদের ভোটাররা বাসা-বাড়িতে বসে আছে। তাই নৌকার অবস্থা খারাপ মনে হচ্ছে।
চারঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান ফখরুল ইসলাম বলেন, এখানে নৌকাই বিজয়ী হবে। তার ও তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হিংসা ও প্রতিহিংসার কারণে। বিএনপি-অধ্যুষিত এ অঞ্চলে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে তাদের ভূমিকা বেশি বলে দাবি করেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে শাহরিয়ার আলমের বক্তব্য জানতে মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সবশেষ মঙ্গলবার রাত আটটায় তাকে ফোন করা হলেও পাওয়া যায়নি। তাই বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
স্বতন্ত্র প্রার্থী রাহেনুল হক রায়হান বলেন, বর্তমান সংসদ সদস্য তার নিজস্ব বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ এলাকার মানুষ। এলাকার মানুষ পরিবর্তন চাচ্ছে। এই পরিবর্তন করার কারণে আমি প্রার্থী হয়েছি। যদি কোনো সমস্যা না হয় তাহলে ভোটের মাঠে আমাকে হারাতে পারবে না। আওয়ামী লীগের বিশাল একটি অংশ আছে আমার পক্ষে। এছাড়াও আছে সাধারণ মানুষ। আমি জয়ের বিষয়ে আশাবাদী।
এ আসনে তিনটি পৌরসভা ও ১৩টি ইউনিয়নে মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৪০ হাজার ৫২৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৭০ হাজার ৫২৭ জন এবং নারী ভোটার সংখ্যা ১ লাখ ৬৯ হাজার ৯৯৯ জন। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার আছেন একজন।