নওগাঁ প্রতিনিধি:
নওগাঁর রাণীনগরে মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে উপজেলার ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া উপহার আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাড়ি বেচা-কেনার অভিযোগ উঠেছে। উপজেলার সবচেয়ে বড় আশ্রয়ণ প্রকল্প একডালা ইউনিয়নের ডাকাহার চৌধুরীপুকুর আশ্রয়ণ প্রকল্পে এই ঘর বেচাকেনার এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। শুধু ডাকাহার আশ্রয়ণ প্রকল্পেই নয় উপজেলার অন্যান্য প্রকল্পেও এমন ঘটনা ঘটছে। আবার অনেকেই নিজের নামে ঘর বরাদ্দ নিয়ে তালা দিয়ে হয়ে আছেন নিরুদ্দেশ।
সম্প্রতি বিষয়টি তদন্ত করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর লিখিত অভিযোগ প্রদান করা হয়েছে। উপজেলার কালিগ্রাম মুনসিপুর গ্রামের মৃত-তহির উদ্দীন মোল্লার ছেলে রফিকুল ইসলামের করা অভিযোগের ভিত্তিতে বিষয়টি বেরিয়ে এসেছে। অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত মে মাসে উপজেলার সদ্য বিদায়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে তাবাসসুম বিষয়টি তদন্ত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু গত ২৯ মে ইউএনও উম্মে তাবাসসুমের বদলিজনিত কারণে এবং উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় সেই তদন্ত আর আলোর মুখ দেখেনি।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের কয়েকটি ধাপের আওতায় উপজেলার একডালা, কালীগ্রাম, বড়গাছা ও কাশিমপুর ইউনিয়নে ১ম পর্যায়ে ৯০টি, ২য় পর্যায়ে ৩৩টি ও ৩য় পর্যায়ে ৫৩টিসহ মোট ১৭৬টি গৃহহীন-ভূমিহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট প্রতিটি বাড়িতে দুটি কক্ষ, সংযুক্ত রান্নাঘর, টয়লেট ও সামনে খোলা বারান্দাও রয়েছে। প্রতিটি আশ্রয়ণ পল্লীতে বাড়ি নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্যুৎ সংযোগ, বিশুদ্ধ পানির জন্য টিউবয়েল স্থাপন, চলাচলের জন্য রাস্তা ও নামাজের জন্য মসজিদসহ প্রধান প্রধান প্রয়োজনগুলো নিশ্চিত করা হয়েছে।
অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থ বছরে উপজেলার একডালা ইউনিয়নের ডাকাহার চৌধুরীপুকুর আশ্রয়ণ প্রকল্পে কয়েক দফায় ৫৯টি ঘর নির্মাণ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার এসব ঘর ভূমিহীন ও গৃহহীনদের মূজিব শতবর্ষের উপহার হিসেবে নির্মাণ করা হলেও প্রকল্পের অধিকাংশ ঘরই অনৈতিক ভাবে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে যাদের জমি ও বাড়ি উভয়ই আছে এমন সব ব্যক্তিদের। ঘর বরাদ্দ পাওয়া সুবিধাভোগীরা নিজের জমি ও বাড়ি থাকায় সেখানে বসবাস না করে উদ্বোধনের কিছুদিন পরে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ঘর বিক্রি শুরু করেন। অনেকে যারা বৈধ উপায়ে ঘর পাননি তারা নিরূপায় হয়ে মোটা অংকের টাকা দিয়ে প্রকল্পে বসবাসরত কতিপয় দালাল ও প্রকল্প অফিসের দালালদের মাধ্যমে ঘর কিনে বসবাস করছেন। আবার অনেকে অল্প দামে ঘর কিনে রেখেছে ভবিষ্যতে বেশি দামে বিক্রির আশায়। আশ্রয়ণ প্রকল্পে যেন শুরু হয়েছে ঘর বেচা-কেনার মহোৎসব।
আরো জানা যায়, আশ্রয়ণ প্রকল্পের ১নং ঘর বিক্রয় করেন মো. বেনো হোসেন আর ক্রয় করেন আজিজার। ৩৫নং ঘর মো. ফেকরুল বিক্রয় করেন আর ডাকাহার গ্রামের আফজাল হোসেনের ছেলে ইউনুছ আলী সেটি কিনে নেন। একই ঘর আবার ইউনুছ আলী বিক্রয় করেন দুলালের নিকট। ৩৭ নং ঘর আলম বিক্রি করেন শরিফুলের কাছে। ডাকাহার গ্রামের ছলিম উদ্দীনের নিজের জমি থাকার পরও বাপ-ছেলে ২টি ঘর বরাদ্দ পেয়েছে। এছাড়াও তারা আরো ২টি ঘর বিক্রয়ের জন্য ক্রয় করে রেখেছেন। রহমান কবিরাজ ওই গ্রামের মধ্যে তার ছাঁদ দেওয়া পাঁকা বাড়ি আছে থাকা সত্ত্বেও আশ্রয়ণ প্রকল্পে ২টি ঘর কিনে রেখেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দারা জানান, আশ্রয়ণ প্রকল্প সমবায় সমিতির সহ-সভাপতি হাছিন আলীর গ্রামে জমি ও বাড়ি থাকার পরও তার মা হাসিনা বেগমের নামে ১টি ঘর, নিজের নামে ১টি ঘর ও স্ত্রীর নামে ১টি ঘরসহ মোট ৩টি ঘর বরাদ্দ নিয়ে নিজেদের দখলে রেখেছেন।
মায়ের ঘর বিক্রির জন্য আগ্রহী ক্রেতাদের নিকট দরদামও চলমান রেখেছেন। এই আশ্রয়ণের সকল ঘর বিক্রয়ের মূল হোতা হাছিন আলী বলে জানান স্থানীয়রা। এই প্রকল্পের ৫৯টি ঘরের মধ্যে ২০টি ঘর ছাড়া সবই ক্রয়-বিক্রয় হয়েছে বলে অভিযোগ করেন আশ্রয়ণের অন্যান্য বাসিন্দারা। ঘর পাওয়ার যোগ্য এমন অসহায় মানুষরা সংশ্লিষ্ট অফিসের দালালদের চাহিদা মাফিক মোটা অংকের টাকা দিতে না পারার কারণে তারা ঘর পায় না। অথচ যারা ঘর নিয়ে জমজমাট ব্যবসা করছেন বিষয়টি জানার পরও কেউ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় দিন যতই যাচ্ছে ততই তাদের অত্যাচারের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তারা আরো জানান আশ্রয়ণ প্রকল্প সমবায় সমিতির বিভিন্ন পদে থাকা ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময় দুর্বল আশ্রয়ণের বাসিন্দাদের অহেতুক ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদা আদায় করেন। যারা প্রতিবাদ করেন তাদের ঘর থেকে বের করে দেয়ার হুমকি-ধামকি প্রদান করা হয়। যদি প্রথম থেকে সঠিক যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে প্রকৃত ভূমি ও গৃহহীনদের প্রদান করা হতো তাহলে এমন জঘন্য ঘটনা ঘটতো না। এতে করে প্রধানমন্ত্রীর মূল উদ্দেশ্য চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে বলে মনে করেন স্থানীয়রা। অবিলম্বে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানান প্রকল্পের বাসিন্দারা।
অভিযোগকারী রফিকুল ইসলাম বলেন, সরকারি ঘর প্রকৃত গৃহহীন ও ভূমিহীনরা পায়নি। যাদের ঘর আছে তারা পেয়েছে। যারা শুরু থেকেই অফিসের দালালদের সঙ্গে আঁতাত করে আর্থিক লেনদেন বজায় রেখেছিলেন তারাই আজ অন্যায়ভাবে সুবিধা ভোগ করছেন। প্রকল্পে অবৈধভাবে রাজত্ব করছেন। তাই প্রশাসনের কাছে আমার দাবি সঠিক তদন্তের মাধ্যমে পুনরায় যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত সুবিধাভোগীদের মাঝে ঘরগুলো বরাদ্দ প্রদান হোক।
একডালা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. শাহজাহান আলী বলেন, মুজিববর্ষ উপলক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া উপহার আশ্রয়ণ প্রকল্পের গৃহহীন ও ভূমিহীনদের ঘরগুলো হাত বদল হচ্ছে। আমি উপজেলা আইনশৃংখলা মাসিক সভায় এই বিষয়ে একাধিকবার বলার পরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এমন সব অন্যায় ও অবৈধ কর্মকান্ডের সঙ্গে আশ্রয়ণ প্রকল্প সমিতির পদে থাকা প্রভাবশালী কতিপয় ব্যক্তিরা পুরোদমে জড়িত। আমি প্রশাসনের কাছে সুষ্ঠু তদন্তের দাবী করছি।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাইমেনা শারমীন জানান, এই উপজেলায় তিনি নতুন যোগদান করেছেন। বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।