সোমবার, ২৭ মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৩ চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ ।
রাণীনগর প্রতিনিধি
নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার একডালা ইউনিয়নের গুয়াতা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগের প্রায় ২৭ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে ওই বিদ্যালয়ের বর্তমান ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতির বিরুদ্ধে। অবৈধভাবে নিয়োগে কমিটির সদস্যদের স্বাক্ষর জাল করা নিয়ে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের মাঝে।
এ কারণে বিদ্যালয়টির সার্বিক অবস্থা এখন খুবই নাজুক হয়ে পড়েছে। ফলে ওই বিদ্যালয়ে পাঠদানের সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছেন অভিভাবক ও স্থানীয়রা। দীর্ঘদিনের এই দ্বন্দ্বের কারণে ভেঙে পড়েছে বিদ্যালয়ের সুষ্ঠু পাঠদানের পরিবেশ। সভাপতির স্বেচ্ছাচারিতা ও নানা অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রদান করা হয়েছে ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ বরাবর। ব্যবস্থাপনা কমিটির কিছু সদস্যকে ভয়ভীতি প্রদান করার অভিযোগও উঠেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার গুয়াতা উচ্চবিদ্যালয় একটি ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপিঠ। এটি ১৯৬৭ সালে স্থাপতি হয়। সরকারি শর্ত অনুসারে প্রতিটি বিদ্যালয়ে ৩৫-৪০জন সনাতন ধর্মের শিক্ষার্থীর জন্য একজন কাব্যতীর্থ শিক্ষক নিয়োগ প্রদান করার নিয়ম আছে। কিন্তু সেসময় এই বিদ্যালয়ে ৩-৪ জন শিক্ষার্থীর জন্য অর্থের বিনিময়ে কাব্যতীর্থ শিক্ষক হিসেবে ২০০২ সালে নিয়োগ প্রদান করা হয় বসুদেব কুমার পালকে। পরবর্তীতে এই শিক্ষক গত বছর নভেম্বর মাসের ২১ তারিখে প্রায় ১৭ লাখ টাকার বিনিময়ে ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতির মাধ্যমে প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি গ্রহণ করেন। এই অর্থ সভাপতি প্রতিষ্ঠানে না দিয়ে এককভাবে আত্মসাত করার কারণে ক্ষোভের সৃষ্টি হয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের মাঝে। শুধু অর্থই নয় সভাপতি সদস্যদের স্বাক্ষর জাল করে এককভাবে বসুদেবকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে এবং অন্য একজনকে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা এই দ্বন্দ্বের আরেকটি অন্যতম কারণ বলে জানা গেছে। প্রতিষ্ঠানে প্রদানের নাম করে সহকারী প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে প্রায় ১০ লাখ টাকার বিষয়ে অন্যান্য সদস্যরা ও অভিভাবকসহ বিদ্যালয়ের অন্য কেউই জানে না। এরপর থেকে শুরু হয় বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের মাঝে দ্বন্দ্ব।
বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সামছুল হক, এসএম সামছুল হক, জাহাঙ্গির আলম ও বাবলু সরদার ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ বরাবর সভাপতির স্বেচ্ছাচারিতা ও শিক্ষক নিয়োগের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করেন। ওই অভিযোগের ভিত্তিতে ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ গত জুলাই মাসের ১২ তারিখে তদন্ত করেন। এ কারণে ব্যাপকভাবে সমস্যায় পড়ে যান দুই প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি। আর এই বিষয়টি রফাদফা করার জন্যই তদন্ত ফলাফল প্রকাশিত না হতেই গত ১৯ জুলাই সভাপতি, প্রধান শিক্ষক, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির কিছু সদস্য ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে একটি ঘরোয়া বৈঠক করেন। বৈঠকে বিষয়টি সমাধান না হওয়ায় গত শুক্রবার আবার তারা বৈঠকে বসেন। ব্যবস্থাপনা কমিটির অন্যান্য সদস্যদের সুপারিশ ব্যতিত ওই দুই শিক্ষকের বেতন-ভাতা আটকে রয়েছে। তাই বাধ্য হয়েই সভাপতি ঘরোয়া এই বৈঠকের আয়োজন করেন। বৈঠকে সদস্য, অভিভাবক ও গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা সভাপতিকে শর্ত আরোপ করে বলেন- আমাদের না জানিয়ে নিয়োগ বিষয়ে যে অর্থের লেনদেন করা হয়েছে তা সম্পূর্ণভাবে বিদ্যালয়ের ফাণ্ডে প্রদান করতে হবে এবং তাকে অচিরেই সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে। ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অভিযোগপত্র তুলে নেওয়ার জন্য সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের ম্যানেজ করার জন্য দফায় দফায় বৈঠক করেন এবং বৈঠকে পুনরায় আরো কিছু অর্থের লেনদেন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
এসব ঘটনায় বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন যাবত ব্যাহত হচ্ছে সুষ্ঠুভাবে পাঠদান। এই দ্বন্দ্বের কারণে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এ কারণে ওই এলাকার অভিভাবক ও স্থানীয়রা চরম উদ্বেগ ও ক্ষতির আশঙ্কা করছেন।
জানতে চাইলে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বসুদেব কুমার পাল জানান, বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও সদস্যদের মাঝে বিভিন্ন বিষয়ে মন-মালিন্যের সৃষ্টি হওয়ায় তারা বৈঠক করে তা নিরসনের চেষ্টা করেন। আমার কোন বিষয় এরমধ্যে জড়িত ছিলো না।
ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য এসএম সামছুল হক জানান, ওদিন আমি বৈঠকে উপস্থিত ছিলাম না। তবে বিষয়টি নিয়ে বসার জন্য জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ে বৈঠক করা হয়েছে। আপনি সেখানে গেলে সবকিছু জানতে পারবেন বলে তিনি জানান।
ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি নজরুল ইসলাম শিশির জানান, বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের মাঝে বিভিন্ন কারণে অসন্তোষের সৃষ্টি হওয়ায় আমরা বিদ্যালয়ে ঘরোয়াভাবে বৈঠক করে তা নিরসনের চেষ্টা করি। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান রেজাইল ইসলাম জানান, সমস্যাটি অনেক আগের। আমি ওই স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। এই চলমান দ্বন্দ্বের কারণে বিদ্যালয়টি শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই চেষ্টা করেছি বৈঠক করে সমস্যাটি দ্রুত নিরসন করার জন্য। স্থানীয় সাংসদ আশ্বাস দিয়েছেন তিনি নিজে এই সমস্যাটি সমাধান করবেন। তাই আমরা সেই অপেক্ষায় রয়েছি।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও আতাইকুলা জনকল্যাণ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জালাল উদ্দিন জানান, বসুদেবের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগটি সম্পূর্ণভাবে অবৈধ। কারণ ওই বিদ্যালয়ে সরকারি বিধান অনুসারে কখনোই ৪০ জন সনাতন ধর্মের শিক্ষার্থী ছিল না। তাই বসুদেব শিক্ষক হিসেবেই অবৈধ। সে আবার প্রধান শিক্ষক হয় কিভাবে? অচিরেই কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। তা না হলে এই সমস্যার কারণে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শেখ আবদুুল্লাহ আল মামুন জানান, বিষয়টি আমার আওতার বাইরে। তারা আমার ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ বরাবর লিখিত অভিযোগ প্রদান করেছেন। তারাই বিষয়টি সম্পর্কে ভালো বলতে পারবেন।
এ বিষয়ে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোসলেম উদ্দিন জানান, আমি অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করেছি। তদন্ত ফলাফল রাজশাহী বিভাগীয় কর্মকর্তার কাছে প্রেরণও করেছি। তিনি তদন্ত ফলাফলের উপর ভিত্তি করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।