বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৯ মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ।
রাবি প্রতিবেদক :
গেস্ট রুমে বসাকে কেন্দ্র করে মধ্যরাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) শাখা ছাত্রলীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। শনিবার (১১ মে) রাত দশটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী হলের গেস্ট রুমে এই সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশের প্রচেষ্টায় শনিবার দিবাগত (রবিবার, ১২ মে) রাত তিনটার পরে দুই পক্ষ তাদের অবস্থান থেকে সরে যায়।
পাঁচ-ছয় ঘণ্টা ধরে চলা সংঘর্ষ ও উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয় ঘটনাস্থল। চলে ইটপাটকেল নিক্ষেপ। এসময় নেতাকর্মীদের হাতে রামদা, রড, লাঠিসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র দেখা যায়। এঘটনায় বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। পাশাপাশি দুটি বাইক ভাঙচুর করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, শনিবার (১১ মে) রাত ৯টার দিকে হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী হলের গেস্ট রুমে বসে সাংগঠনিক আলোচনা করছিলেন ওই হল শাখার সহ-সভাপতি ও দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা আতিকুর রহমানসহ প্রায় ৩০ জন। তিনি রাবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বাবুর অনুসারী।
এমন সময় শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নিয়াজ মোর্শেদ তার কয়েকজন অনুসারীকে নিয়ে এসে অন্যদের কয়েক মিনিটের জন্য গেস্ট রুম ত্যাগ করতে বলেন। এ বিষয়টি নিয়ে দুপক্ষের মাঝে বাকবিতন্ডা তৈরি হয়। বাকবিতন্ডার এক পর্যায়ে সেটি সংঘর্ষে রূপ নেয়।
জানা যায়, সংঘর্ষ শুরু হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা লাঠি, রড, রামদা, চাপাতিসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র হাতে সংঘর্ষে অংশ নেয়। সংঘর্ষ চলাকালে উভয়পক্ষ ইটপাটকেল ছোঁড়ার পাশাপাশি ৬-৭টি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটায়।
সংঘর্ষের পরে নিয়াজ মোর্শেদের অনুসারীরা শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের অভ্যন্তরে এবং রাবি শাখার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের নেতাকর্মীরা মাদার বখস হলের সামনে অবস্থান নেন। এতে দুই হল সংলগ্ন এলাকায় আতংক সৃষ্টি হয়।
রাত দেড়টা নাগাদ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই উপাচার্য অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম (প্রশাসন) এবং উপ-উপাচার্য অধ্যাপক হুমায়ুন কবীর (শিক্ষা)। এসময় সংঘর্ষ বন্ধ হলেও বিরাজ করছিলো উত্তপ্ত পরিস্থিতি। তখনও অনেকের হাতে রড, রামদাসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র দেখা যায়।
এসময় রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক হুমায়ুন কবীর সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনার সূত্রপাত অনেক আগে হলেও, আমাদের নলেজে এসেছে কিছুক্ষণ আগে। আমাদের প্রক্টরিয়াল টিমের নজরে হয়ত কমবেশি ছিল। তবে তারা আমাদের কিছুক্ষণ আগে জানিয়েছে। আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। যেভাবে দ্রুত সমাধান করা যায় পুলিশ প্রশাসনের সহায়তায় আমরা সেটার চেষ্টা করছি।
ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি নিয়াজ মোর্শেদ বলেন, প্রেসিডেন্ট পক্ষের ১০-১৫ জন ছেলে গেস্ট রুমে বসে ছিলো। হলে প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারি দুই পক্ষ থেকে দুজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট সাইডের পক্ষ থেকে আতিক দায়িত্বে আছে। আমারও একটা ছোট ভাই দায়িত্বে আছে। আজ (শনিবার, ১১ মে) গেস্ট রুমে যখন ওরা বসে তখন আতিক ছিলো না। ওরা আমার ছোট ভাই হওয়াতে ওদের রিকুয়েষ্ট করে বলেছিলাম, ভাইয়া আমার একটা গেস্ট আছে। আমি পাঁচ মিনিট কথা বলবো৷ তোমরা পাঁচ মিনিট আমাকে সময় দাও। তোমরা একটু বাহিরে দাঁড়াও। আমাকে পাঁচ মিনিট সময় দাও। আমি বড় ভাই হিসেবে এই রিকুয়েষ্ট করতেই পারি।
তিনি আরও বলেন, এর কিছুক্ষণ পর আতিক উপস্থিত হয় এবং আমার উপর চড়াও হয়। তখন তিনি (আতিক) আমাকে বলে, ‘তুমি এভাবে ওদের বেড় করে দিতে পারো না।’ তখন আমি বলি, ‘আমি তো ওদের সাথে খারাপ আচরণ করে বলি নি। শুধুমাত্র বড় ভাই হিসেবে পাঁচ মিনিট সময় চেয়েছি।’ তারপর আমির আলী হল এবং বঙ্গবন্ধু হল থেকে কয়েকজন নেতাকর্মী উপস্থিত নয়। তখন তাদের সাথে কিছু বাকবিতন্ডা তৈরি হয়। তারপর ওরা আমার বাবা-মা কে নিয়ে গালাগালি শুরু করে।এই তুচ্ছ ঘটনা থেকেই সূত্রপাত।
তারপর বিভিন্ন হল থেকে রামদাসহ দেশীয় অস্ত্র সাথে করে আসতে শুরু করে। আমি গেটের কাছে আসার পর ওরা ভাঙচুর শুরু করে। ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। রামদা দিয়ে তেড়ে আসে। তখন থেকে সূত্রপাত হয়। এখানে আমার কোনো দোষ ছিলো না। ওরা গায়ে পড়ে ঝামেলা শুরু করে। আমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং হল শাখার বর্তমান সভাপতি।
আমি ছোট ভাইদের একটা বিষয়ে রিকুয়েষ্ট করতেই পারি। তারা যখন আমার বাবা-মা তুলে গালি শুরু করে, তখন বিষয়টা আমার খুব খারাপ লাগে। তখন আমার পাশে ছোট ভাই ছিলো। ওর সাথেও কথা কাটাকাটি হয়৷ ওখান থেকেই সূত্রপাত।
রাবি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহ-হিল-গালিব বলেন, আমরা শনিবার রাত নয়টার দিকে জানতে পারি যে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হচ্ছে। তারপর আমরা এসে দেখি নিয়াজ ও বহিরাগত কিছু সন্ত্রাসী রামদা এবং রেল লাইন থেকে ইট-পাথর ও ককটেল এনে শিবির যেমন নিক্ষেপ করে তেমনি নিক্ষেপ করে ছাত্রলীগের উপর।
যাদেরকে সিসি ক্যামেরা দেখলেই বোঝা যাবে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানিয়েছি, তারা যেন রেইড দিয়ে দ্রুত বহিরাগতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসে। আর আমরাও বসে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবো। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগকে জানিয়েছি তারাও সন্ত্রাসীদের স্থান দিবেন না।
রাবির সোহরাওয়ার্দী হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আমরা হল প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন একসাথে হলে প্রবেশ করি এবং চেষ্টা করেছি প্রতিটি কক্ষে প্রবেশ করে তল্লাশি করার। বিশেষ করে যে রুমগুলো আমরা মনে করেছি হয়তো কোনো দেশীয় অস্ত্র থাকতে পারে, সে রুমগুলো ভালোভাবে দেখেছি। সেখানে কোনো দেশীয় অস্ত্র পাইনি। পাশাপাশি কিছু কক্ষে তালাবদ্ধ অবস্থায় দেখেছি।
তিনি আরও বলেন, যারা হয়তো এই সংগঠনের (ছাত্রলীগ) সাথে ছিলো বা এই ঘটনার সাথে ছিলো তারা ডাইনিংয়ের উপর দিয়ে হল ত্যাগ করে পালিয়েছে। বর্তমানে কোনো বহিরাগত এই হলে নেই। আমাদের সাথে সরাসরি পুলিশ প্রশাসনের ৩০ এর অধিক সদস্য সহযোগিতা করেছে৷ আমরা প্রতি রুমে তল্লাশি করে জানার চেষ্টা করেছি যে, হলে কোনো বহিরাগত বা সন্ত্রাসী অবস্থান করছে কি না। কিন্তু কাউকে পাওয়া যায় নি।
এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় আমি সহ হলের আবাসিক শিক্ষকেরা সকাল পর্যন্ত হলে অবস্থান করেছি। যেন কোন শিক্ষার্থী নিরাপত্তাহীনতায় না ভুগে।
দীর্ঘ সময় পর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলেও দ্রুত সময়ে কেন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যখন কোনো ঘটনা সংগঠনের মধ্যে ঘটে তখন দুইপক্ষকে নিয়ে মিমাংসা করতে একটু সময় লাগে। তবে এ ঘটনা দীর্ঘসময় হলেও কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটে নি।
তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে কি না এ বিষয়ে তিনি বলেন, ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিকভাবে আমরা তদন্ত কমিটি গঠন না করতে পারলেও শিগগিরই তদন্ত কমিটি গঠন করে আপনাদের জানিয়ে দিবো ছাত্রদের আবাসিক হলে কোনো সন্ত্রাসীদের জায়গা নেই। এ ধরনের কর্মকাণ্ডে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
রাজশাহী মহানগর পুলিশের মতিহার থানার ডেপুটি পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মধুসূদন রায় বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা ও স্বাভাবিক পড়াশোনার পরিবেশ যেন বজায় থাকে, সাধারণ শিক্ষার্থীরা যেন নির্ভয়ে এবং স্বাভাবিকভাবে পড়াশোনা করতে পারে আমরা সেই লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাথে একসাথে কাজ করবো। এবং বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্পর্শকাতর জায়গা। এখানে চাইলেই কেও হস্তক্ষেপ করতে পারে না বা করা উচিত না। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব একটি প্রশাসন রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের চাহিদার প্রেক্ষিতে যদি কোনো সহায়তা লাগে, সেক্ষেত্রে আমরা তৎপর ও সচেষ্ট রয়েছি।
রাবি’র প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সবসময় আইন শৃঙ্খলা বিষয়ে সচেতন। সেই দৃষ্টিকোন থেকে বলবো, একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। এখানে দেশীয় অস্ত্রের কথাও শুনেছি৷ কিন্তু আমরা যখন হলের বিভিন্ন কক্ষে প্রবেশ করি তখন কোনো অস্ত্রের নমুনা পাইনি। আমরা উপস্থিত হওয়ার পর দুর্ঘটনা এড়াতে তাদেরকে সরিয়ে দিই। ছাত্রদের মঙ্গলের কথা বিবেচনা করে, প্রশাসনের সাথে কথা বলে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা হবে।