রাবিতে স্থবির সাংস্কৃতিক অঙ্গন! আর্থিক সমস্যার পাশাপাশি কর্মী সঙ্কট

আপডেট: জুলাই ৩০, ২০১৭, ২:৩২ অপরাহ্ণ

শিহাবুল ইসলাম


জন্মলগ্ন থেকে সংস্কৃতি চর্চায় সমৃদ্ধ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি)। কিন্তু বর্তমানে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী বাড়লেও বাড়ছে না সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মী সংখ্যা। ধুঁকে ধুঁকে চলছে এ সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো। প্রচার-প্রচারণার অভাব ও আর্থিক সমস্যার পাশাপাশি কর্মী সঙ্কট যেন স্থবির করে দিচ্ছে ক্যাম্পাসটির সাংস্কৃতিক চর্চাকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যেক বছর বিভাগ বাড়ার সঙ্গে উল্লেখযোগ্যহারে বাড়ছে শিক্ষার্থী সংখ্যা। কিন্তু সেই হারে বাড়ছে না নাট্য সংগঠনগুলোর কর্মী সংখ্যা। দেশ অত্যাধুনিক হওয়ার সঙ্গে যোগ হচ্ছে নিত্যনতুন প্রযুক্তি ও মিডিয়া। শিক্ষার্থরাও ঝুঁকছে এসবের প্রতি। ফলে ধিরে ধিরে ছোট হয়ে আসছে বিশ্ববিদ্যালয় নাট্যচর্চা তথা সংস্কৃতিক চর্চার পরিসর। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সংস্কৃতি চর্চার সুস্থ পরিবেশ তৈরি এবং হল, বিভাগ ইত্যাদিতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রতিযোগিতায় সংস্কৃতি কর্মীদের অংশগ্রহণে অগ্রাধিকার দেয়া হলে এ সমস্যা থেকে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চার বছর পরেই ১৯৫৭ সালে শহিদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার ছাত্র-শিক্ষক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র (টিএসসিসি) প্রতিষ্ঠিত হয়। শিক্ষার্থীদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিজেকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলায় ছিল এ টিএসসিসি’র মূল লক্ষ্য। কিন্তু সে আসাও পূরণ করতে পারছে না বহু প্রতিক্ষিত নতুন ভবন পাওয়া এ কেন্দ্রটি। এক্ষেত্রে এর অবকাঠামোগত সমস্যার কথাও বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
টিএসসিসি সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ১২টি সাংস্কৃতিক সংগঠন রয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ড্রামা অ্যাসোসিয়েশন (রুডা), সমকাল নাট্যচক্র, অরণি সাংস্কৃতিক সংসদ, অ্যাসোসিয়েশন ফর কালচার অ্যান্ড এডুকেশন (এস), তীর্থক নাটক, অনুশীলন নাট্যদল, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী রাবি সংসদ, বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার রাজশাহী (বিথিরা), বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, গণশিল্পী সংস্থা রাবি শাখা, স্বনন ও সমগীত সংস্কৃতি প্রাঙ্গন।
২০১৪ সালে ১৫ জন সদস্য নিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে তীর্থক নাটক’র যাত্রা শুরু হয়। সংগঠনটি সে বছর তিনটি পথনাটক ও দুইটি মঞ্চ নাটকের আয়োজন করে। ২০১৫ সালে এসেও সদস্য সংখ্যা ১৫ জনে এবং চারটি পথ নাটকের আয়োজন করে। ২০১৬ সালে পথনাটক করে ছয়টি এবং সদস্য সংখ্যা সেই ১৫ জনই থাকে। চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পযন্ত তিনটি পথনাটক অনুষ্ঠিত হয়েছে। মঞ্চ নাটকের মহড়া চলছে। একইবছর শুরু হয়ে ২১ জন সদস্য নিয়ে তিনটি পথনাটক ও একটি মঞ্চ নাটক করে রুডা। ২০১৫ সালে এসে সদস্য সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১৮ জনে। ২০১৬ সালে পথনাটক চারটি এবং মঞ্চ নাটক একটি করতে পারে। তখন সদস্য সংখ্যা ছিল ২০ জন। চলতি বছরের শুরু থেকে চারটি পথনাটক ও একটি মঞ্চ নাটক প্রদর্শিত হয়েছে। এখন সদস্য সংখ্যা রয়েছে ২২ জন। প্রতিটি সাংস্কৃতিক সংগঠনেরই এভাবে প্রত্যেক বছর কর্মী সংখ্যা কমার সঙ্গে কমছে তাদের সংস্কৃতিক উপস্থাপনা।
এক্ষেত্রে অনেকগুলো সমস্যার মধ্যে কর্মী সঙ্কটকেই বড় করে দেখছেন রুডা’র সাধারণ সম্পাদক আকাশ কুমার। তিনি বলেন, ‘এখন কর্মী সঙ্কটই সবচেয়ে বড় বলে মনে করছি। এছাড়া প্রশাসনের আর্থিক দিকে অসহায়তাও একটি কারণ হতে পারে। টিএসসিসি’র নীতিমালাতে বলা রয়েছে, নাট্য সংগঠন বা সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো যদি কোনো প্রোগ্রাম করে থাকে তাদের বিভিন্ন সহযোগিতার কথা। কিন্তু আমরা কোনো ধরনের সহযোগিতা পাই না।’ এ কারণেই সাংস্কৃতিক অঙ্গনে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যসংগঠন ‘সমকাল নাট্যচক্র’ ১৯৮১ সালে যাত্রা শুরু করে ৩৩ বছর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যচর্চা করছে। জানতে চাইলে ঐতিহ্যবাহী এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আবু বকর শিমুল বলেন, ‘কর্মী সঙ্কটের কারণেই আমাদের এমন স্থবিরতা। আমাদের এখনো কোনো স্থায়ী আবাসন না থাকায়, কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। টিএসসিসি’র কার্যকারিতা নেই। আমরা টিএসসিসি পরিচালককে বারবার এ বিষয়ে অবহিত করেও কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেন নি।’
সংস্কৃতিকর্মী অরূপ দেবনাথ অভিযোগ করে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সংস্কৃতি চর্চার সুস্থ পরিবেশ তৈরি করতে পারলে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, বিভাগ ইত্যাদিতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রতিযোগিতায় সংস্কৃতি কর্মীদের অংশগ্রহণে অগ্রাধিকার দেওয়া হলে এ সমস্যা সমাধান হবে।’
গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর নাট্য অঙ্গনে সক্রিয় নয় বেশিরভাগ সাংস্কৃতিক সংগঠন। জানতে চাইলে রাবি কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি আবদুল মজিদ অন্তুর বলেন, ‘কর্মী সঙ্কটের কারণেই মূলত সাংস্কৃতিক অঙ্গনে স্থবিরতা। বিসিএস কেন্দ্রীক যে কোচিংগুলো ক্যাম্পাসে দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে শিক্ষার্থীরা সে দিকেই ঝুঁকে পড়ছে। কোচিংগুলো বিকেলের সময় হওয়ায় অনেক শিক্ষার্থীই এই সময়ে আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আসতে পারে না। সাংস্কৃতিক চর্চা করেও বিসিএস ক্যাডার হওয়া সম্ভব তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমাদের নাট্য সংগঠন তীর্থক নাটক।
বর্তমানে সবচেয়ে যে বড় সমস্যা তা হচ্ছে অর্থ সঙ্কট। বিশ্ববিদ্যালয়ের গুটিকয়েক সংগঠন বাৎসরিকভাবে মন্ত্রণালয় থেকে একটা বরাদ্দ পায়, যা দিয়ে একটা প্রোগামেই শেষ হয়ে যায়। আবার সে অর্থও সবগুলো সংগঠন পায় না। আর্থিক সংকট সাংস্কৃতিক সংগঠনকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। একটা প্রোগামের আয়োজন করতে গেলে যে পরিমাণ অর্থের দরকার তা আমরা বিভিন্ন শিক্ষকের কাছে ঘোরাফেরা করে অনেক কষ্ট করে যোগাড় করি। এর ফলেও সাংস্কৃতিক চর্চায় স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে বলে যোগ করেন তিনি।
আর একটি বড় সমস্যা আমাদের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর স্থায়ী কোনো কক্ষ নেই। এসময় তিনি টিএসসিসির কথা উল্লেখ করে বলেন, টিএসসিসি সাংস্কৃতিক মহড়ার অনুপযোগী। ওটা আমরা বাতিলের দাবি জানিয়েছি। এসময় তিনি সংস্কৃতি চর্চার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে নতুন ভবন নির্মাণের দাবি জানান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, ‘সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে তাদের কার্যক্রম চালানোর জন্য যথেষ্ঠ সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে। আমি দায়িত্ব নেয়ার পর যে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কক্ষ ছিল না তাদের রাকসু ভবনে কক্ষ বরাদ্দ দিয়েছি।’ আর সংস্কৃতি কর্মী সঙ্কটের প্রধান কারণ হিসেবে তাদের প্রচার-প্রচারণা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন তিনি।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার ছাত্র-শিক্ষক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক টিএমএম নূরুল মোদ্দাসের চৌধুরী বলেন, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর দাবিগুলো অবশ্যই যৌক্তিক। আমি দায়িত্ব নেয়ার পরে টিএসসিসি ভবনের যে মডেল হাতে পেয়েছি ঠিক সে অনুযায়ী ভবন নির্মাণ করেছি। সেক্ষেত্রে কক্ষগুলো ছোট হলেও এখন তা সংস্কার করা সম্ভব নয়।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ