বৃহস্পতিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৩ আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
ওয়ালিউর রহমান বাবু
দীর্ঘ সময় পর রাষ্টীয় সম্মানে সম্মানিত হলেন ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর স্বকণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা ও ম্যাজেসটি ঢাকার তৎকালীন ইস্টপাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) পিলখানা হেড কোয়ার্টার থেকে ঝুঁকি উপেক্ষা করে যিনি ব্ল্যাকসেটের মাধ্যমে বাইরে প্রেরণ করেন জাতীয় বীর রাজশাহীর গর্ব সাহসী মানুষ বিল্পবী শহিদ সুবেদার মেজর শওকত আলী।
উনিশো একাত্তরের ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় ঢাকার বিশ্বস্ত ছাত্র নেতারা জেনে ফেললেন বঙ্গবন্ধু কিছু পরই স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। কিছু একটা হতে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর নিজ কন্ঠে ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘোষণা অডিও ও ম্যাসেজটি ইস্টপাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) পিলখানা হেড কোয়ার্টারে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব দেয়া হলো ছাত্র নেতা কাজী আরিফকে। ঝুঁকি উপেক্ষা করে সাহসী ছাত্রনেতা কাজী আরিফ বঙ্গবন্ধুর স্বকন্ঠে স্বাধীনতা ঘোষণার অডিও ও ম্যাসেজ পিলখানার আজিমপুর গেটে অপেক্ষায় থাকা সিরাজুল ইসলামের কাছে পৌঁছে দিলে তিনি তা সতর্কতার সাথে সেটি হস্তান্তর করলেন সুবেদার মেজর শওকত আলীর কাছে। সূত্রের ধারণা এই ঝুঁকিপুর্ণ কাজের সাথে আরো কয়েক জনের ভূমিকা থাকতে পারে। রাত এগারোটার দিকে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার নেসার আহমেদের বাড়ির দিক থেকে ট্রেসার সেল ফাটার সাথে সাথে সেনাবাহিনী ইস্টপাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) ব্যারাক, কোয়ার্টার গার্ড দখল করে নিলো। সুবেদার মেজর শওকত আলীর দেয়া পরামর্শে সিগন্যাল কোরের বাঙালি সদস্যরা ছাদে থাকায় রক্ষা পেয়ে গেলো। সুবেদার মেজর শওকত আলীর সাথে থাকা সিগন্যাল ম্যান আব্দুল মোত্তালিব কে নিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠলেন ।
তিনি মেটোরেনা এসিবিসি-৩ সেটে (ব্লাক সেট) ভয়েস অপসন ও টিজি অপসনের মাধ্যমে তার কাছে আসা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার অডিও ও মেসেজটি “ঞযরং রং সধু নব সু ষধংঃ সধংংধমব, ভৎড়স ঃড়ফধু ইধহমষধফবংয রহফবঢ়বহফবহঃ.” ও পধষষ ঁঢ়ড়হ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব ড়ভ ইধহমষধফবংয যিবৎব বাবৎ ুড়ঁ সরমযঃ নব ধহফ যিধঃবাবৎ ুড়ঁ যধাব, ঃড় ৎবংরংঃ ঃযব ধৎসু ড়ভ ড়পপঁঢ়ধঃরড়হ ঃড় ঃযব ষধংঃ. ণড়ঁৎ ভরমযঃ সঁংঃ মড় ড়হ ঁহঃরষ ঃযব ষধংঃ ংড়ষফরবৎ ড়ভ ঃযব চধশরংঃধহ ড়পপঁঢ়ধঃরড়হ ধৎসু রং বীঢ়বষষবফ ভৎড়স ঃযব ংড়রষ ড়ভ ইধহমষধফবংয ধহফ ভরহধষ ারপঃড়ৎু রং ধপযরবাবফ.” বাইরে প্রেরণ করলেন। রাত সাড়ে এগারোটায় চট্রগ্রামের সিগন্যাল ম্যান আবুল খায়ের তার সেটে এটি পেয়ে কমান্ডার ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামকে দেয়া মাত্রই তিনি সংশ্লিষ্টদের কাছে সেটি প্রেরণের ব্যবস্থা করলেন। চট্টগ্রাম, ঠাকুরগাঁও, গাইবান্ধা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন বিওপি ও ওয়্যারলেস সেন্টারে এটি সংরক্ষণ করে সংশ্লিষ্টরা তা অন্যদের কাছে জানাতে ভূমিকা রাখতে থাকলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বকন্ঠে স্বাধীনতা ঘোষণার অডিও ও ম্যাসেজটি পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছে ধরা পড়ে গেলে তারা রাত একটার দিকে সুবেদার মেজর শওকত আলী ও সঙ্গে থাকা আব্দুল মোতালেবকে এগারো নম্বর ব্যারাকে নেবার পর সেখান থেকে ঢাকা মোহাম্মদপুর শরীরচর্চা কলেজের টর্চার সেন্টারে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করতে থাকলো। সেখানে তার সহকর্মী সুবেদার মোল্লা, সুবেদার জহুর মুন্সি, সুবেদার আব্দুল হাই, সুবেদার আইয়ুবসহ অন্যদের বন্দি করে নিয়ে এসে নির্যাতন করতে থাকলো। পাকিস্তানি সৈন্যরা সুবেদার জহুর মুন্সি, সুবেদার আব্দুল হাইকে পেরেক দিয়ে দেওয়ালে গেঁথে দিয়ে তাদের উপর নির্যাতন চালাতে থাকলো। তারা এভাবে শহিদ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। ধরা পড়ে গিয়েও ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেন সিগন্যাল ম্যান আব্দুল মোত্তালিব। বিভিন্ন টিজি-অপশন থেকে ম্যাসেজটি সংগ্রহ করার পর প্রচারপত্র আকারে বিলি করা হলো। কোন তথ্য বের করতে না পেরে পাকিস্তানি সৈন্যরা সুবেদার মেজর শওকত আলীর শরীরে জ্বলন্ত সিগারেট দিয়ে পুড়িয়ে ঘাঁ করে দিলো। উপড়ে নিলো মাথার চুল, তুলে নিলো নখ, লোহার শিক ঢুকিয়ে দিলো দুই চোখে। এরপরও তার কাছ থেকে কোন তথ্য বের করতে না পেরে ২৯ এপ্রিল ঢাকার নারায়ণগঞ্জে পাগলা নদীর ঘাটে তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করলো। বিভিন্ন সময় এ নিয়ে অনেক কথা অনেক যাচাই পর্ব হয়েছে। কিন্তু এর বড় সাক্ষি বঙ্গবন্ধু নিজেই। পাকিস্তানে বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে ঢাকায় ফিরে আসার পাঁচ দিন পর ঊনিশশো বাহাত্তর সনের ১৬ জানুয়ারি নিউওয়ার্ক টাইমস-এর বিশেষ প্রতিনিধি সিডনিস্ক্যানবার্গকে দেয়া তার সাক্ষাৎকারে এর সত্যতা পাওয়া গিয়েছে। আর এক সাক্ষি ছাত্রনেতা কাজী আরিফ। তিনি বেঁচে নেই। সেই রাতের ঘটনা এবং নির্যাতন প্রত্যক্ষ করা অনেকে এখনো বেঁচে আছেন। বিষয়টি নিয়ে সরকারি পর্যায়ে অনেক বার যাচাই হয়েছে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময়, পরবর্তী সরকার এবং বর্তমান সরকারের যাচাই এ একই সত্যতা পাওয়া গেছে। মেজর শওকতক আলীর পরিবার সূত্রে জানা যায়, তাঁর কোন খোঁজ না পেয়ে উনিশশো একাত্তর সনের ১০ সেপ্টেম্বর তার স্ত্রী, একমাত্র কন্যা সেলিনা পরভীনকে নিয়ে পিলখানায় গেলে সিগন্যাল কোরের অবঙালি কর্নেল আব্দুল রহমান আওয়ান শহিদ সুবেদার মেজর শওকত আলীর বই, খাতা, ডায়রি ফেরত না দিয়ে টেলিভিশন, মটর সাইকেল ফেরত দিয়ে যা বলেন, তা হলো “তিনি কোয়ার্টার থেকে ওয়্যারলেসসহ ধরা পড়েছেন, তাঁর কাছে মুজিবের ম্যাজেস পাওয়া গিয়েছে”। মেজর এজাজ, ক্যাপ্টেন আক্তার ও একই মন্তব্য করলেন। সত্যতা এটাই বঙ্গবন্ধু স্বকণ্ঠে স্বাধীনতা ঘোষণার অডিও ও ম্যাসেজটি সুবেদার মেজর শওকত আলীর মাধ্যমে ব্লাক সেটে বাইরে প্রেরণ করা হয়। জাতীয় বীর সুবেদার মেজর শহিদ শওকত আলী যে দুঃসাহসিক অবদান রাখলেন তা বীর শ্রেষ্ঠের চেয়ে কম নয়। তাই তাকে ইতিহাসের পাতায় জাতীয় সম্মানে সম্মানিত করার জন্য দেশ এবং দেশের বাইরের মিডিয়াগুেিলতে অনেক বারই বিষটি উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু নানা জটিলতায় বিষটি আটকে থাকে।
দেশের প্রথম কমিউনিটি বেতার “রেডিও পদ্মা”৯৯.২ এফ এম বহুবার এই জাতীয় বীরের দুঃসাহসিক ভূমিকা শ্রোতাদের কাছে উপস্থাপন করে তাকে খেতাব প্রদানসহ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেবার জন্য সরকার ও সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। রাজশাহী থেকে প্রকাশিত দৈনিক সোনার দেশেও এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখে। বিষয়টি বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সুবিবেচনায় আনেন। বিজিবি ( বাংলাদেশ বর্ডারগার্ড বাহিনী)তে মরণোত্তর পদক প্রদানে নিয়ম না থাকায় তাকে পদক প্রদান করতে অনেকটা দেরি হলেও এবারের বিজিবি দিবসে ২০ ডিসেম্বর বিজিবি ঢাকা হেড কোয়ার্টারে আবেগ আপ্লুত ও অন্য রকম এক পরিবেশে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় বীর সুবেদার মেজর শহিদ শওকত আলীকে জাতীয় বীরের মর্যাদায় সম্মানিত করে তার কন্যা সেলিনা পারভীনের হাতে বাংলাদেশ বর্ডারগার্ড বাহিনীর সর্বোচ্চ পদক “বর্ডারগার্ড বাহিনী পদক”দিয়ে বললেন দেরি হলেও এই জাতীয় বীরকে রাষ্টীয়ভাবে সম্মানিত করতে পেরে তিনি অনেক বেশি গর্বিত। জাতীয় বীর সুবেদার মেজর শহিদ শওকত আলীর স্মৃতি বিজড়িত রাজশাহীতে তাকে স্মরণীয় করে রাখতে নগরপিতা, সিটি কর্পোরেশন, সরকারি পর্যায় সংশ্লিষ্ট মহল উদ্যোগ নিতে পারেন।
( জাতীয় বীর শহিদ সুবেদার মেজর শওকত আলী)
লেখক: মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রাহক , প্রডিউসার প্রেজেন্টার রেডিও পদ্মা