রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও ভাতা পেয়ে ঘটেছে ১১ বীরঙ্গনার জীবনযাত্রার মান || দেশের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগের জন্য গর্ববোধ

আপডেট: ডিসেম্বর ১৩, ২০১৬, ১২:০৭ পূর্বাহ্ণ

ইমতিয়ার ফেরদৌস সুইট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ



স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়ে দারুন খুশি চাঁপাইনবাবগঞ্জের ১১ বীরাঙ্গনা। গতবছর তাদের বীরঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারি গেজেট প্রকাশের পর থেকেই পাচ্ছেন মাসিক মুক্তিযোদ্ধা ভাতা। জাতীয় দিবসগুলোতে সরকারি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণও জানানো হচ্ছে তাদের। দীর্ঘসময় পর রাষ্ট্রের এমন সম্মানে চরম খুশি বীরঙ্গনাদের পরিবার ও স্বজনরা। এখন বীরঙ্গনারা নিজেদের পরিচয় দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। বরং দেশের জন্য তাদের সর্বোচ্চ ত্যাগের জন্য গর্ববোধ করেন।
৭১-এর অগ্নিঝরা দিনগুলোতে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে সম্ভ্রম হারানো সারাদেশের ৪১ জন নারীকে বীরঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার খেতাব দিয়ে গতবছরের ১২ অক্টোবর সরকারি গেজেট প্রকাশ করে সরকার। এই ৪১ বীরঙ্গনার মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জেই বসবাস ১১ বীরঙ্গনার। এর মধ্যে গোমস্তাপুর উপজেলার বোয়ালিয়া গ্রামে বাড়ি ৯ জনের। বাকি দুই জনের বাড়ি সদর উপজেলা ও শিবগঞ্জে। বীরঙ্গনারা হলেন, গোমস্তাপুরের বোয়ালিয়া ইউনিয়নের রাবিয়া  বেগম, হাসনা বেগম, জলো বেগম, সফেদা বেগম, আয়েশা বেগম, রেনু বেগম, হাজেরা বেগম, আরবী বেগম ও রাহেলা বেগম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের লিলি বেগম ও শিবগঞ্জের মালেকা বেগম।
বোয়ালিয়ার বীরঙ্গনা জলো বেগম জানালেন, গোমস্তাপুর উপজেলার বোয়ালিয়া, নয়রশিয়া, চকমজুমদার, সাহাপুর এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সবচেয়ে বেশি হত্যাযজ্ঞ, নিরিহ বাঙালিদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া ও নারীদের সম্ভ্রমহানির ঘটনা ঘটে। এসব এলাকায় পাক বাহিনীর হাতে সম্ভ্রম হারানো নারীদের সংখ্যা কয়েকশ উল্লেখ করে তিনি জানান অনেকেই লজ্জায় মুখ খোলেনি আজও।
যুদ্ধকালীন বিভিষিকাময় সেই দিনগুলোর কথা জানতে চাইলে বীরঙ্গনা হাসনা বেগম জানান,  বিয়ের ৩ মাসের মাথায় পাকিস্তানি হায়েনারা কেড়ে নেয় আরেক বীরঙ্গনা হাজেরা বেগমের সম্ভ্রম। সেই কারণে তার স্বামী পরিত্যাগ করে হাজেরাকে। পরে হাজেরার এক বোন মারা গেলে সে ঘর বাধে বোন জামাইয়ের সাথে। অন্যদিকে সন্তান প্রসবের মাত্র তিন মাসের মাথায় রাজাকারদের সহায়তায় পাক হানাদারদের লাঞ্ছনার শিকার হয় বোয়ালিয়ার আরেক বীরঙ্গনা  আরবী বেগম। শুধু তাই নয়, গুলি করে হত্যা করে আরবীর স্বামীকেও।
বীরঙ্গনা মালেকা বেগমের ৭ সন্তানের মধ্যে ৩ ছেলে ও ৪  মেয়ে। থাকেন ননদের জমিতে। ছেলেরা কেউ খোঁজ রাখেনা তার। তাই মানুষের কাছ থেকে চেয়ে চিন্তে চলত সংসার। তবে এখন ভাতা পাওয়ায় সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরেছে। সরকারের কাছে তার দাবি নিজের নামে একটি এক টুকরো জায়গা বরাদ্দ দেয়ার।
আরেক বীরঙ্গনা রাহেলা বেগমের এক ছেলে ও এক মেয়ে। রাহেলা বেগমের আক্ষেপ, ছেলের নিজ সংসারেই টানাটানি। মাকে দিতে পারেনা কোন খরচ। তাই পরের বাড়িতে কাজ করে ও ধান কুড়িয়ে চলে সংসার রাহেলা বেগমের। সেদিক থেকে বীরঙ্গনা রাবিয়া  বেগম অন্যদের ভালো আছেন। ছেলে মেয়েরা সবসময় খোঁজখবর রাখে তার।
তবে এতো কষ্টের মধ্যেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়ে এখন দারুন খুশি বীরাঙ্গননারা। তারা জানালেন, এখন অনেকেই তাদের খোঁজখবর নেয় তাদের। গেজেট প্রকাশের পর থেকেই প্রতিমাসে ১০ হাজার টাকা করে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাচ্ছেন তারা। জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানগুলোয় নিয়মিত দাওয়াত মিলে তাদের। এছাড়া বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যাক্তি উদ্যোগে সহায়তার হাত বাড়িয়ে অনেকেই তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম জানান, অস্ত্র হাতে যুদ্ধ না করলেও এসব বীরঙ্গনারা তাদের মতই বীর। তিনি আরো জানান, নিজের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হারিয়ে এতোদিন লোকচক্ষুর  অন্তরালে ছিল এসব বীরাঙ্গনা। তাদের স্বীকৃতি দিয়ে দেশের সকল বীরঙ্গনাদের সঠিক সম্মান জানানোর সুযোগ করে দিয়েছে সরকার। প্রতিমাসে ১০ হাজার টাকা করে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা দেয়াসহ মুক্তিযোদ্ধাদের বরাদ্দকৃত সবধরনের সুবিধা বীরঙ্গনাদের দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ