মাহী ইলাহি:
গেল বছরের জুলাইয়ে রাজশাহী নগরীর ৫টি স্থানে এডিস মশার লার্ভা পেয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর। এরপর নড়েচড়ে বসে রাজশাহী সিটি করপোরেশন। পরিস্কার-পরিচ্ছন্নখ্যাত রাজশাহী নগরীতেও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব সারাদেশের মতো বেড়ে গিয়েছিল। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা ঘটনাও ছিল নিত্যনৈমত্তিক।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিল সিটি করপোরেশন এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনসহ কর্মকর্তা-কর্মচারিবৃন্দ। শুরু করেন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সচেতনতামূলক নানা কার্যক্রম। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে চলে নানা অভিযান। বছরব্যাপী পরিকল্পিত নানা কর্মসূচির কারণে বর্তমানে রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সারাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়লেও রাজশাহী সিটি এলাকায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাখতে বছরব্যাপী নেয়া হয়েছে নানা কর্মসূচি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের আইসিটি শাখার তত্ত্বাবধানে ওয়েবসাইট ও স্বাস্থ্য বিভাগের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ডেঙ্গু নিয়ে সতর্কতামূলক বার্তা দিয়ে আসছে। ফেব্রুয়ারি মাস থেকে নগরীর ৩০ ওয়ার্ডের স্কুল, কলেজ ও পাড়া-মহল্লার জনসাধারণের মাঝে প্রায় ২ লাখ সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ শুরু হয়েছে। এই কার্যক্রম চলবে আগামী জুন পর্যন্ত। চলতি বছরের মার্চ থেকে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে সিটি পর্যায়ে ওরিয়েন্টেশন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এই কর্মসূচি চলমান থাকবে জুন মাস পর্যন্ত।
সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্ন বিভাগ সূত্র জানায়, রাজশাহী নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডেই একজন স্বাস্থ্য সহকারীর নেতৃত্বে চলতি বছরের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত ওয়ার্ডের প্রতিটি ব্লক অনুযায়ী উঠান বৈঠক কর্মসূচি চলমান রয়েছে। সামনে আসছে বর্ষাকাল। এজন্য ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব রোধে চলতি বছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে স্কুল পর্যায়ে ওরিয়েন্টশন কার্যক্রম পরিচালিত হবে। রাসিকের জনসংযোগ শাখার উদ্যোগে আগামী জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর সোশ্যাল, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন ও সংবাদ প্রচারের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার কার্যক্রম চালানো হবে।
সূত্র জানায়, আগামী জুলাই থেকে ডিসেম্বর প্রতি মাসে মেডিকেল সেন্টার, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, ক্লাব প্রতিনিধি, স্থানীয় সুশীল সমাজ ও স্বাস্থ্য সহকারিদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি ওয়ার্ড পর্যায়ে ওরিয়েন্টশন কার্যক্রম পরিচালনা করবে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডে ওয়ার্ড কাউন্সিলদের সমন্বয়ে ওয়ার্ড পর্যায়ে গঠিত ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত অন্যান্য রোগ প্রতিরোধ কমিটির মাসিক সভা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। রাজশাহী সিটি হাসপাতালসহ নগরীর ১৩টি বিভিন্ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের পর থেকেই সারাবছর বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যবস্থা রেখেছে সিটি করপোরেশন।
এছাড়া এই ১৩ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে সারাবছরই ডেঙ্গু রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা স্থায়ী কমিটির উদ্যোগে চলমান কাজের অংশ হিসেবে সারাবছরই পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে সচেতনতার লক্ষ্যে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার বিভিন্ন পদক্ষেপ অব্যাহত রয়েছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এডিস মশার লার্ভা যাতে কোথাও জন্মাতে না পারে সেজন্য নগরীর প্রতিটি আনাচে-কানাচ সার্বক্ষণিক পরিচ্ছন্ন রাখতে সারাবছর সিটি কর্পোরেশনের একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে এবং এডিস মশার বংশবিস্তার রোধে সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বাসা-বাড়ির বাইরে ফেলে রাখা ফুলের টব, ভাঙা হাড়ি-পাতিল, গাড়ীর পরিত্যক্ত টায়ার, ভাঙা কলস, ড্রাম, ডাব-নারিকেলের খোসা, এয়ারকন্ডিশনার ও রেফ্রিজারেটারের তলায় পানি যাতে জমে থাকতে না পারে সেজন্য ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে এই বিশেষ টিম কয়েকদিন পরপর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে আসছে।
এছাড়া প্রতি-মাসে সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ’র উদ্যোগে সিটি পর্যায়ে গঠিত ডেঙ্গু ও মশাবাহিত অন্যন্য রোগ প্রতিরোধ কমিটি সামগ্রিক কাজের অগ্রগতি ও প্রতিবেদন তৈরি করেন। এই প্রতিবেদন অনুসারে, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম মনিটরিংয়ের মাধ্যমে আপডেটও হয়ে থাকে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি কর্পোরেশনের অব্যাহত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডের ওয়ার্ড কাউন্সিলরের তত্ত্বাবধানে মসজিদসমূহে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব রোধকল্পে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে চলতি বছরের জুলাই থেকে অক্টোবর তিন মাসব্যাপী মাইকিং কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। শুধু তাই নয়, মসজিদে খতবার সময় ডেঙ্গু বিষয়ে সচেতনতামূলক নানা বার্তা মসজিদের ঈমামের মাধ্যমেও দিয়ে আসছে সিটি কর্পোরেশন। এছাড়া ডেঙ্গুর চিকিৎসা সেবা সর্বদা সচল রাখতে সিটি কর্পোরেশনের ৪০ জন স্বাস্থ্য সহকারীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। তারা সিটি এলাকার বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছেন।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা শেখ মো. মামুন বলেন, ডেঙ্গুর এখন আর কোন সময় বা মৌসুম নেই। যেকোন সময় মহামারী আকার ধারণ করতেই পারে। সেজন্য রাসিক সারাবছরই সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি থেকে শুরু করে বিনামূল্যে ডেঙ্গু চিকিৎসাসহ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নানা কার্যক্রম পরিচালনা করে এটি অব্যাহত রেখেছে। সিটি করপোরেশনের মেয়র ও কাউন্সিলর যখন যেই প্রোগ্রামই করুক না কেন সেখানে ডেঙ্গু নিয়ে একটু হলেও সচেতনামূলক আলোচনা হয়। শুধু তাই নয়; এডিস মশার লার্ভা ও ডিম ধ্বংস করার কাজ আমরা সারাবছরই করছি। এছাড়া আমাদের পরিচ্ছন্ন বিভাগের ছোট্ট একটি টিম সিটি করপোরেশনের প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে নিয়মিত বাসা-বাড়ি ও এর আশেপাশের ঝোপঝাড় পরিস্কার রাখতে অনুরোধ জানাচ্ছে এবং এই কার্যক্রম সারাবছরই চলমান। পাশাপাশি আমাদের যেসব স্বাস্থ্যকর্মী গর্ভবতী মা ও শিশুদের নিয়ে কাজ করেন তারাও ডেঙ্গু নিয়ে সচেতনতামূলক বার্তা প্রদান করে আসছে।
রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. এফ.এ.এম আঞ্জুমান আরা বেগম বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করছি। নগরীর ১৩টি পয়েন্টে ফ্রিতে ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যবস্থা সারাবছরই রাখা হয়েছে। ডেঙ্গুর চিকিৎসা-ব্যবস্থাও ফ্রি করে দেয়া হয়েছে। আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীরাও বিভিন্ন সচেতনতামূলক নানা কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে রাজশাহীতে ডেঙ্গু বেশ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
গেল বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়। ৯ জানুয়ারি সবশেষ রোগী ভর্তি হয়েছিল। এরপর আর নতুন কোনো রোগী ভর্তি হয়নি।
রামেক হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালে মোট ৫২৯ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছে। এদের মধ্যে ৫২৩ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছে। ৬ জন রোগী মারা গেছেন।
২০২৩ এর জুলাই থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ৫ হাজার ৪৩১ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছে। এদের মধ্যে রাজশাহী জেলাতে আক্রান্ত হয়েছেন ৪ হাজার ১৯৮ জন। এই মৌসুমে রামেক হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছে ৫ হাজার ৩৯৩ জন । তবে সবচেয়ে বেশি রোগী ছিল চারঘাট ও বাঘা উপজেলার। মহানগরীর রোগী ছিল তুলনামূলক কম।
রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফএমএ শামীম আহমেদ বলেন, গেল মৌসুমে হাসপাতালে এবার ৫ হাজার ৪৩১ জন ডেঙ্গু রোগী ছিল। তাদের জন্য তখন আলাদা ওয়ার্ড করা হয়েছিল। বর্ষা শুরু আগে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। এবারও আমাদের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। তবে সবাই যদি সচেতন হয় তাহলে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা সম্ভব।