নিজস্ব প্রতিবেদক:
আলোচিত র্যাব হেফাজতে মৃত নারীর মৃতদেহের মাথায় ও হাতের মাংসে জমাটবাঁধা রক্তের উপস্থিতিসহ ওই নারীর বিরুদ্ধে র্যাবের করা মামলা নিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে।
২২ মার্চ (বুধবার) জেসমিনকে র্যাব আটকের পরদিন রাজশাহীর রাজপাড়া থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তার বিরুদ্ধে একটি মামলা করা হয়েছে। প্রতারণার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলাটি করেন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) এনামুল হক।
এদিকে, সুরতহাল প্রতিবেদনে আঘাতের বিষয়টি উঠে এসেছে। এই প্রতিবেদনে শুধু হাতের বাইরের আঘাতের চিহ্নের কথা উল্লেখ রয়েছে। তবে ময়নাতদন্তের সময় চিকিৎসকেরা দেখেছেন, হাতের ভেতরে মাংসে রক্ত জমাট বেঁধে ছিল। এছাড়া একাধিক সূত্র মাথায় আঘাতের বিষয়টিও নিশ্চিত করেছে।
নওগাঁর ভূমি অফিসের কর্মচারী সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর পর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে গিয়ে মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন রাজশাহীর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার জেসমিন আক্তার।
তিনি জানান, মাথা ছাড়াও জেসমিনের ডান হাতের কনুইয়ের কাছে তিনি আঘাত দেখেছেন। সুরতহাল প্রতিবেদনে এসব আঘাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। রামেকের মর্গে তিনজন চিকিৎসকের একটি বোর্ড ময়নাতদন্ত করেন। এই দলের প্রধান ডা. কফিল উদ্দিন। তিনিও নিশ্চিত করেন, মৃতদেহের ডান হাতের বাহুর নিচে ও কনুইয়ের কাছে একটা কালশিরা জখম ছিলো।
আঘাতের এই চিহ্ন নিয়ে চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। আর জেসমিনের স্বজনদের দাবি, আটকের পর জেসমিনকে নির্যাতন করা হয়েছিল। এর ফলেই তার মৃত্যু হয়েছে। তবে র্যাবের পক্ষ থেকে বরাবরই এ অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।
এরআগে, গত ২২ মার্চ সকালে অফিসে যাওয়ার পথে নওগাঁ থেকে তাকে আটক করে র্যাব-৫ এর রাজশাহীর একটি দল।
র্যাব দাবি করছে, আটকের পরই অসুস্থ হয়ে পড়লে জেসমিনকে হাসপাতালে নেয়া হয়। কিন্তু জেসমিনকে সকালে আটক করা হলেও নওগাঁ সদর হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল বেলা ১টা ১৫ মিনিটে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জেসমিন কোথায় ছিলেন, তাও জানা যায় নি।
জেসমিনের মামা নজমুল হক মন্টু জানান, তার ভাগনিকে আটক করা হয়েছিল নওগাঁর নওজোয়ান মোড় থেকে। র্যাব বলছে, আটকের পরই অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। কিন্তু সকাল ১০টার দিকে আটক করে হাসপাতালে নেয়া হলো দুপুরে। অথচ নওজোয়ান মোড় থেকে হাসপাতালের দূরত্ব আড়াই কিলোমিটার। রাস্তায় যানজট নেই। গাড়িতে যেতে সময় লাগে সর্বোচ্চ পাঁচ মিনিট। বাকি সময় কোথায় ছিল? সময় মিলছে না বলেই তাদের সন্দেহ তাকে নির্যাতন করা হয়েছে।
এদিকে, নওগাঁ হাসপাতাল থেকে জেসমিনকে রামেক হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল একই দিন রাত সাড়ে ৯টায়। পরে ২৪ মার্চ সকালে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) জেসমিন মারা যান। ২৫ মার্চ সকালে রামেকের মর্গে জেসমিনের মরদেহের ময়নাতদন্ত করা হয়। এরপর মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে মরদেহ দাফন করা হয়।
এ বিষয়ে রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এএফএম শামীম আহম্মদ জানান, জেসমিনের মাথার ডান পাশে তারা একটি আঘাতের চিহ্ন দেখেছিলেন। সিটি স্ক্যানে দেখা গেছে, তার মাথায় রক্তক্ষরণ হয়েছে। এর বাইরে তারা অন্য কোথাও আঘাত দেখেন নি।
এ বিষয়ে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ও রামেকের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. কফিল উদ্দিন জানান, মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ কেন হয়েছে তা জানতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। সবগুলো রিপোর্ট আসলে তারা তিনজন চিকিৎসক বসে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাবেন। তখন মতামতসহ ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে।
র্যাব হেফাজতে মারা যাওয়া নওগাঁর এই কর্মচারীর মৃত্যুর পর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা প্রতারণার মামলায় বিস্ময় প্রকাশ করেছে তার স্বজন ও সহকর্মীরা। স্বজনদের চোখে মুখেও এখন আতঙ্কের ছাপ। গণমাধ্যমের সাথে কথা বলতে চাইছেন না কেউ।
মামলার ওই এজহারে উল্লেখ করা হয়েছে, চাঁদপুর জেলার হাইমচর থানার গাজীবাড়ী এলাকার বাসিন্দা আল আমিন ও সুলতানা জেসমিনসহ অজ্ঞাতনামা দুই-তিনজন ব্যক্তি যুগ্ম সচিব এনামুল হকের নাম ও পদবি ব্যবহার করে ফেসবুক আইডি খুলে বিভিন্ন লোকজনকে চাকরি দেয়ার নাম করে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
কিন্তু জেসমিনের বিরুদ্ধে ওঠা এমন অভিযোগ মানতে পারছেন না তার স্বজন, প্রতিবেশি ও সহকর্মীরা। সুলতানা জেসমিনের মামা ও নওগাঁ পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর নাজমুল হক মন্টু বলেন, আমার ভাগ্নি অত্যন্ত সাদামাটা একজন গৃহিণী। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর ছোট্ট একটা চাকরি করে ছেলেটাকে মানুষ করছে সে। তার ছেলের লেখাপড়ার খরচের টাকা অনেক সময় আমাকে দিতে হয়। আর্থিক অনিয়ম করলে তো অভাব-অনটন থাকতো না। তার বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আমার ভাগ্নি একটা চক্রান্তের শিকার হয়েছে। আমার বিশ^াস, সঠিকভাবে তদন্ত করলে তার বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হবে।
গত সোমবার (২৭ মার্চ) বিকালে শহরের জনকল্যাণ পাড়ায় জেসমিনের ভাড়া বাসায় গিয়ে দেখা যায়, তার একমাত্র সন্তান শাহেদ হোসেন সৈকত ঘরে আছেন। কিন্তু কারো সঙ্গে কথা বলছেন না। সাংবাদিকরা তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও তিনি কোনো উত্তর দেন নি।
জেসমিনের ছোট ভাই সোহাগ হোসেন এবং ভগ্নিপতি রফিকুল ইসলাম গত রোববার গণমাধ্যমকে র্যাব হেফজাতে জেসমিনের মৃত্যুর অভিযোগ তুলে বক্তব্য দিলেও এখন তারা আর কোনো কথা বলছেন না। তাদের চোখে মুখে আতঙ্ক। জেসমিনের ভাই সোহাগ মিয়া এর আগে বলেছিলেন, আমার বোনের সাথে যা ঘটেছে এটা সবাই জানে। আর কোনো কথা বলতে চাই না। মামলা করতে চাই না। আমাদের কোনো দাবিও নাই।
সুলতানা জেসমিন (৪০) নওগাঁ সদরের চন্ডিপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসে অফিস সহায়ক পদে চাকরিরত ছিলেন। গত আট বছর ধরে শহরের জনকল্যাণপাড়ার দেলোয়ার হোসেন দুলালের বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করে আসছিলেন। প্রায় ১৭ বছর আগে স্বামীর সঙ্গে ডির্ভোস হওয়ার পর একমাত্র ছেলেকে নিয়ে ছিল তার সংসার। ছেলে শাহেদ হোসেন সৈকত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
তার ভাড়া বাড়ির মালিক দেলোয়ার হোসেন দুলাল বলেন, সুলতানা জেসমিন দীর্ঘদিন ধরে তার বাসায় ভাড়া থাকলেও তার কোনো অস্বাভাবিক চলাফেরা কখনও চোখে পড়ে নি। একদম ‘নিভৃতভাবে’ চলাফেরা করতেন। তার মতো মহিলা অন্যের ফেসবুক আইডি ব্যবহার করে চাকরি দেওয়ার নাম করে মানুষকে প্রতারণা করবে এতে বিস্মিত তিনি।
চন্ডিপুর ইউনিয়ন ভূমি উপ-সহকারী কর্মকর্তা মোমেনা খাতুন বলেন, এখানে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই জেসমিনকে একজন ভালো সহকর্মী হিসেবে পেয়েছি। অতীতেও তার বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির কোনো অভিযোগ আমার জানা মতে হয় নি। জেসমিন শান্তশিষ্ট মানুষ ছিল। তার প্রতারণার অভিযোগ উঠায় অবাকই হয়েছি।