লালদীঘির ২৪ হত্যা: বিচারের অপেক্ষায় তিন দশক

আপডেট: জানুয়ারি ২৫, ২০১৭, ১২:০৫ পূর্বাহ্ণ

সোনার দেশ ডেস্ক


চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে আওয়ামী লীগের সমাবেশের আগে গুলি চালিয়ে ২৪ জনকে হত্যার ঘটনায় করা মামলার বিচার শেষ হয়নি ২৯ বছরেও।
নিহতদের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, এখন ২৪ জানুয়ারি ছাড়া কেউ আর তাদের খোঁজ রাখে না। নিহতদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধটিও পড়ে আছে অযতœ-অবহেলায়। অবশ্য এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর আশা, চলতি বছরের মধ্যেই রায় হতে পারে।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের শেষ দিকে ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা নগরীর লালদীঘি ময়দানে এক জনসভায় যাওয়ার পথে তার গাড়িবহরে নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। এতে কমপক্ষে ২৪ জন নিহত হন।
গত ২৬ জুন আদালতে দেয়া সাক্ষ্যে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘শেখ হাসিনাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে’ সেদিন গুলি চালানো হয়েছিল। ভাগ্যক্রমে তা তার গায়ে লাগেনি। বিনা উসকানিতে সেদিন ‘পরিকল্পিত হত্যাকা-’ ঘটানো হয়েছিল।
চট্টগ্রামের তখনকার পুলিশ কমিশনার ও মামলার আসামি রকিবুল হুদার নির্দেশে ওই ঘটনা ঘটানো হয় বলে আদালতকে বলেন মোশাররফ।
এ মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা ইততোমধ্যে মারা গেছেন। মামলার বাদী আইনজীবী মো. শহীদুল হুদা, সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা এএসপি আব্দুল কাদের এবং আসামি পুলিশ কনস্টেবল বশির উদ্দিনও বেঁচে নেই।
চার বছর পর মামলা
গত ২৬ মে আদালতে দেয়া সাক্ষ্যে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ড. অনুপম সেন বলেন, ঘটনার দিন আনুমানিক বেলা ১টার দিকে শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রাক চট্টগ্রাম আদালত ভবনের দিকে দিকে আসার সময় গুলি শুরু হয়।
“বিভিন্ন জনকে গুলি খেয়ে আমি কাতরাতে দেখেছি। অনেককে প্রাণরক্ষার চেষ্টা করতেও দেখেছি। পরে শুনেছি, গুলিতে মোট ২৪ জন মারা গেছেন।” গুলি শুরু হলে আইনজীবীরা মানববেষ্টনী তৈরির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে রক্ষা করে তাকে আইনজীবী সমিতি ভবনে নিয়ে যান।
অনুপম সেন তার সাক্ষ্যে বলেন, নিহতদের কারও লাশ পরিবারকে নিতে দেয়নি তখনকার সরকার। হিন্দু-মুসলমান নির্বিচারে সবাইকে বলুয়ার দীঘি শ্মশানে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল।
এরশাদের সামরিক শাসনের অবসানের পর ১৯৯২ সালের ৫ মার্চ আইনজীবী মো. শহীদুল হুদা বাদী হয়ে এ মামলা দায়ের করেন। কিন্তু তখনকার বিএনপি সরকারের সময়ে মামলার কার্যক্রম এগোয়নি।
২০ বছরে ৪১ জনের সাক্ষ্য
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর মামলাটি পুনরুজ্জীবীত হয়। আদালতের আদেশে সিআইডি মামলাটি তদন্ত করে ১৯৯৭ সালের ১২ জানুয়ারি প্রথম এবং অধিকতর তদন্ত শেষে ১৯৯৮ সালের ৩ নভেম্বর দ্বিতীয় দফায় অভিযোগপত্র দেয়া যাতে আসামি করা হয় আট পুলিশ সদস্যকে।
সেই আসামিরা হলেন- চট্টগ্রামের তখনকার পুলিশ কমিশনার মীর্জা রকিবুল হুদা, কোতোয়ালি অঞ্চলের পেট্রোল ইন্সপেক্টর জে সি ম-ল, কনস্টেবল আব্দুস সালাম, মুশফিকুর রহমান, প্রদীপ বড়ুয়া, বশির উদ্দিন, মো. আবদুল্লাহ ও মমতাজ উদ্দিন।
এ মামলার বিচার শুরুর পর গত ২০ বছরে সাক্ষ্য দিয়েছেন ৪১ জন। ১৯৯৭ ও ১৯৯৮ সালে একজন করে মোট দুজন, ২০০০ সাল থেকে গত ১৭ বছরে ৩৯ জন এবং ২০১৬ সালে মামলাটি চট্টগ্রামের বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে আসার পর ছয় জন সাক্ষ্য দেন।
২০০১ সালের মে থেকে ২০০৬ সালের ২৩ অগাস্ট এবং ২০০৯ সালের ২৬ জুলাই থেকে ২০১৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত এ মামলায় কারও সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি।
এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যথাযথ তদারকির অভাবে দীর্ঘদিন এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি। গত বছরের ২০ জানুয়ারি মামলাটি এ আদালতে আসে। এরপর এক বছরে চারটি ধার্য দিনে ছয় জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে।”
মামলার নথিতে দেখা যায়, এ মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের মধ্েয আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু, সাজেদা চৌধুরী, আব্দুর রাজ্জাক, এম এ জলিল, এম এ মান্নান, আখাতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু এবং আতাউর রহমান খান কায়সারের নাম রয়েছে। তাদের মধ্যে শেষ পাঁচজন গত কয়েক বছরে মারা গেছেন।
মেজবাহ উদ্দিন বলেন, “দ্বিতীয় অভিযোগপত্রে ৭০ জনকে সাক্ষী করা হয়। এর মধ্যে ৪১ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। আর বেশি সাক্ষী করাব না। ৩১ জানুয়ারি শুনানির পরবর্তী দিনে নিহতদের স্বজনসহ নয়জনকে ডাকা হয়েছে। ওইদিনই রাজনৈতিক সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য সমন জারি করতে আদালতে আবেদন করা হবে।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষ্যগ্রহণের বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন, “আমার নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের (আইনমন্ত্রী) সাথে আলোচনা সাপেক্ষে প্রধানমন্ত্রীর জবানবন্দি কীভাবে গ্রহণ করা যায় সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেব।”
‘আমাদের কেউ মনে রাখেনি’
ওই দিনের ঘটনায় নিহতরা হলেন- মো. হাসান মুরাদ, মহিউদ্দিন শামীম, স্বপন কুমার বিশ্বাস, এথলেবার্ট গোমেজ কিশোর, স্বপন চৌধুরী, অজিত সরকার, রমেশ বৈদ্য, বদরুল আলম, ডি কে চৌধুরী, সাজ্জাদ হোসেন, আব্দুল মান্নান, সবুজ হোসেন, কামাল হোসেন, বি কে দাশ, পঙ্কজ বৈদ্য, বাহার উদ্দিন, চান্দ মিয়া, সমর দত্ত, হাসেম মিয়া, মো. কাসেম, পলাশ দত্ত, আব্দুল কুদ্দুস, গোবিন্দ দাশ ও শাহাদাত।
তাদের স্মরণে চট্টগ্রাম আদালত ভবনের প্রবেশ পথে নির্মাণ করা স্মৃতিস্তম্ভটি রয়েছে জরাজীর্ণ অবস্থায়।
এ বিষয়ে গণপূর্তমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের পরও কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন নিহতদের পরিববার ও আইনজীবীরা। নিহতদের মধ্যে হাসান মুরাদ ছিল লামাবাজার এ এস পৌর করপোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র।
তার ভাই আবুল মনজুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “২৯ বছর তো পেরিয়ে গেল। শুধু আশার বাণী শুনি। বছর গড়িয়ে যায়, বছর আসে। স্মৃতিসৌধে ফুল আর আলোচনাতেই শেষ।”
তিনি বলেন, “চাওয়া ছিল রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিয়ে স্মৃতিসৌধ সংরক্ষণ করা হবে। এতে ভাইয়ের আত্মা শান্তি পাইতো। ভেবেছিলাম- কিছু পাই আর না পাই অন্তত স্মৃতি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। হত্যাকা-ের সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।”
নিহত স্বপন কুমার বিশ্বাসের বোন কলি বিশ্বাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিচার তো হয়নি। আমরা আর কি আশা করব? সবই ঝিমিয়ে গেছে। অনেক আশ্বাস দিয়েছিল কিছুই হয়নি। কেউ আমাদের মনেও রাখেনি। শুধু ২৪ জানুয়ারি আসলে একটু খবর নেয়।”- বিডিনিউজ