সোমবার, ২৯ মে, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
সুফি সান্টু, নাটোর
একাত্তরের ৩০ মার্চ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নাটোরের রেড লেটার ডে। লালপুরের পল্লি ময়না গ্রামের ওই যুদ্ধই প্রথম প্রতিরোধ এবং একমাত্র সরাসরি যুদ্ধ। যুদ্ধে শহীদ হন প্রায় ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রাণ হারায় হানাদার বাহিনীর মেজর খাদেম হোসেন রাজাসহ সাতজন। যুদ্ধক্ষেত্রে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ময়না স্মৃতিসৌধ। প্রচলিত প্রথায় এবারও ৩০ মার্চ ময়না দিবসে স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে কৃতজ্ঞচিত্তে শহীদদের স্মরণ করা হবে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২৫ মার্চ ঢাকায় অপারেশন সার্চ লাইট শুরু হওয়ার পর পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে সারাদেশে মোতায়েন শুরু করা হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৫ রেজিমেন্টের একটি দল ঢাকা থেকে রাজশাহী সেনানিবাসে যাওয়ার পথে নাটোর ও পাবনার সীমান্ত এলাকায় মুলাডুলিতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ছত্রভঙ্গ হয়ে রেজিমেন্টের ৭টি গাড়ি বহর লালপুর উপজেলার মনির উদ্দিন আকন্দ সড়ক পথে ময়না গ্রামে ঢুকে পড়ে। চন্দনা নদী পার হতে না পেরে ৩০ মার্চ গ্রামের সৈয়দ আলী মোল্লার বাড়ি সংলগ্ন আমবাগানে আশ্রয় নেয়। এ খবর ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। খবর পেয়ে নাটোর ও লালপুরের মুক্তিযোদ্ধা, পুলিশ, আনসারসহ সর্বস্তরের মানুষ ময়না গ্রামে গিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ঘিরে ফেলেন। শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। দীর্ঘ সময়ের এই অসম যুদ্ধে শহীদ হন অন্তত ৪০ জন বাঙালি। এতো মৃত্যুর পরও ‘মাথা নোয়াবার নয়’। মুক্তিযোদ্ধাদের গড়ে তোলা প্রাণপণ এই প্রতিরোধে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। সঙ্গে তাদের বেশ কিছু পাকিস্তান সেনার মৃতদেহ।
যুদ্ধে অন্যতম শহীদ সৈয়দ আলী মোল্লার ছেলে ওই সময়ের কলেজছাত্র আবুল হাসেম মোল্লা বলেন, ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যাওয়ার পথে পাকিস্তানি সেনাদের মধ্যে মেজর খাদেম হোসেন রাজাসহ সাতজন গমের জমিতে ধরা পড়েন। উত্তেজিত জনতা তাদের পিটিয়ে হত্যা করেন। এদের কবরও ময়নাতেই। মেজর রাজা সম্পর্কে টিক্কা খানের ভাগ্নে।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তায় তাদের দ্বিতীয় হেড কোয়ার্টার স্থাপন করে নাটোরে। সেনাবাহিনীর সরব উপস্থিতি ও সমরসজ্জার কারণে নাটোরে অসংখ্য গণহত্যার ঘটনা ঘটলেও উল্লেখযোগ্য কোন সম্মুখ যুদ্ধ বা প্রতিরোধ যুদ্ধ হয় নি। এ হিসেবে ময়নার যুদ্ধই নাটোরের প্রথম প্রতিরোধ ও একমাত্র যুদ্ধ বলে মনে করেন ময়না যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধারা।
যুদ্ধের আত্মত্যাগকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্যে স্থানীয় সাবেক সাংসদ শহীদ মমতাজ উদ্দীনের প্রচেষ্টায় ময়নাতে ১৯৭৮ সালে স্থাপিত শহীদ স্মৃতিসৌধ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এই সৌধে ১৫ জন শহীদের নামাঙ্কিত করা হয়েছে। শহীদদের স্মৃতির সম্মানে পরিচালিত হয়ে আসছে ময়না শহীদ স্মৃতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মেরিনা পারভীন জানান, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ময়না একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। স্কুল শিক্ষক আবদুল ওয়াহেদ বলেন, স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হলেও শহীদদের হত্যাকা-ের স্থান, কবরগুলো এখনও অরক্ষিত। নতুন প্রজন্মকে ইতিহাস জানান দিতে এগুলো সংরক্ষণে কার্যকর পদক্ষেপ চাই। ময়না যুদ্ধে নিহত শহীদ পরিবারের সদস্যরা কোন রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা বা স্বীকৃতি পান নি বলে জানা গেছে।
ময়না যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নাটোর জেলা কমান্ডের কমান্ডার আবদুর রউফ সরকার বলেন, ময়না যুদ্ধে আত্মদানকারী ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা আর্থিকভাবে স্বচ্ছল নয় বলা চলে। এজন্য যোগ্যতা অনুযায়ী তাদের সরকারি চাকরি এবং আর্থিক অস্বচ্ছল ব্যক্তিদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করা উচিত।
বিগত বছরগুলোর মতো এবারও ৩০ মার্চ ময়না স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। লালপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত অনুষ্ঠানে ওয়ালিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আনিসুর রহমানের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন নাটোর ১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া) আসনের সাংসদ অ্যাড. আবুল কালাম আজাদ।