শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালিত ।। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত বাংলাদেশ

আপডেট: ডিসেম্বর ১৫, ২০১৬, ১২:০৩ পূর্বাহ্ণ

১৯৭১ সালে বিজয়ের ঠিক পূর্বমুহূর্তে হত্যা করা হয় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান-বুদ্ধিজীবীদের। আল-বদর প্রধান মতিউর রহমান নিযামী ও মুজাহিদের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর জঙ্গি সদস্যরা বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায়। যাদের হত্যা করা হয়েছিল আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে তাদের কোনো রাজনীতি ছিল না, নির্বিরোধী, শান্ত। কিন্তু তাদের কি ছিল তা আমাদের চোখে পড়ে নি, ঘাতকদের চোখে তা ঠিকই পড়েছে। মানবিকতা যা মানুষের মূল ধর্ম। আর মানবিকতা সন্ত্রাস-সহিংসতা বিরোধী। সন্ত্রাস যাদের মূল ভিত্তি তারা মানবিকতার বিরুদ্ধে আঘাত হানবেই, হেনেছেও, এখনো হানছে।  ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালিদের মানবিকতার লড়াই। ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠাই ছিল এর মূল দর্শন। আর বুদ্ধিজীবীরা সবসময় সেই মানবিকতারই দিসারী, জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নের নির্দেশক- অনুসারি- সর্বোপরি জাতির বিবেক।
পাকিস্তান বাহিনীর এ দেশিয় দোসররা যারা সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, বাঙালি নিধনযজ্ঞে, লুটপাট, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগে সমান অংশীদার, বিজয়ের ঠিক পূর্বমুহূর্তে তারা সদ্যজাত বাংলাদেশকে করতে চেয়েছিল মেধাশুন্য। পরিকল্পনা করে, তালিকা করে, বেছে বেছে নির্মমভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। আল-বদর, আল-শামস আর রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা ক্ষুধার্ত হায়েনার মত বাংলাদেশের মানুষের ঘরে ঘরে হাজির হয়েছে মেধা আর মননের গন্ধ শুঁকে শুঁকে। ধরে নিয়ে গেছে বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। চোখ বেঁধে, হাত বেঁধে নিয়ে গেছে। কাউকে নিয়ে গেছে পিতার ¯েœহ আলিঙ্গন থেকে, কাউকে নিয়ে গেছে স্ত্রী বা স্বামীর কাছ থেকে। কাউকে নিয়ে গেছে পুত্র-কন্যার অতিনিরাবতার মাঝখান থেকে। আর ফিরে আসে নি তারা। তাদের প্রাণহীন দেহ পাওয়া গেছে রাজধানীর মিরপুরের বধ্যভূমিতে।
বুদ্ধি আর মেধা যখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য, যাঁরা বাংলাদেশের উন্নত ভবিষ্যত রচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারতো-তাঁদেরকে হত্যা করার উদ্দেশ্যই হলো বাংলাদেশ যেন উঠে দাঁড়াতে না পারে। বাঙালিদের বিজয় যখন কোনোভাবেই আটকানো গেলো না তখনই জঙ্গি আল-বদর, রাজাকার দল অত্যন্ত পরিকল্পিত উপায়ে বুদ্ধিজীবী হত্যাকা- সংঘটিত করে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর হায়েনার দল আবারো গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে। প্রতিবিপ্লবীদের আশ্রয় প্রশ্রয়ে তারা সংগঠিত হয়। শুরু করে প্রগতিশীল গণতন্ত্রমনা মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। আবারো সেই মানবতার বিরুদ্ধে অবস্থান, মানবিক মূল্যবোধে বিশ্বাসীদের ওপর সশস্ত্র হামলা, খুন। কিন্তু গণমানুষের ঘৃণার আগুনকে কখনই নেভাতে পারে নি স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকচক্র। সেই আগুনে তাদের পুড়তে হয়েছে, এখন পুড়ছে চূড়ান্তভাবে।
২০১৬ সালের বুদ্ধিজীবী দিবস জাতি পালন করলো নতুন উদ্যোম আর আত্মবিশ্বাসের ওপর ভর করে। বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-ের বিচারের বাণী নিভৃতেই কেঁদেছে। আজ ঘাতকেরা আইনের চোখে দোষী। আইনই বলে দিয়েছে ওই পাপীষ্ঠরা খুনি, ধর্ষক, লুণ্ঠনকারী, অগ্নিসংযোগকারী। বদর প্রধান বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-ের মূলহোতা মতিউর রহমান নিযামী, আলী আহসান মো. মুজাহিদ, কাদের মোল্লা, মীর কাসেম, কামরুজ্জামানদের মৃত্যুদ-ের রায় কার্যকর হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ‘ক্রিমিনাল সংগঠন’ জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ প্রায় সব নেতার মৃত্যুদ- অথবা যাবজ্জীবন কারাদ- হয়েছে। বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচারহীনতার যে দায়ভার জাতি বহন করে বেড়াচ্ছিলÑ শীর্ষ খুনিদের শাস্তি কার্যকর করে কিছুটা হলেও সে দায় থেকে মুক্ত হওয়া গেছে। এবারের শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালনের একটি বড় স্বার্থকতা ও সান্ত¦নার জায়গা।
মুক্তিযুদ্ধের শক্তির কাছে অপশক্তি কোনদিনই বিজয়ী হতে পারে না। আমরা বিশ্বাস করি, যারা মানুষের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাকে গণহত্যা চালিয়ে স্তব্ধ করতে চেয়েছিল তাদের প্রতি দেশবাসীর ঘৃণা জাগরূক থাকবে চিরদিন। শহিদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি জাতির বিন¤্র শ্রদ্ধায় কখনো ব্যত্যয় হয়নি, হবেও না কোনো দিন।