শাসা আর মিশেল আমাকে মেরে একেবারে মাটিতে শুইয়ে দিলো

আপডেট: অক্টোবর ২২, ২০১৬, ১১:৫৯ অপরাহ্ণ


জাস্টিন ট্রুডো
মন্ট্রিয়লের নটরডেম-দ্য-গ্রেস এলাকার মার্লো অ্যাভিনিউ এ ম্যাথিউ ওয়াকারের বাড়িতে আমরা বেশিরভাগ সময় এক হতাম। একদল কিশোরের আনন্দ-স্ফূর্তিতে মেতে উঠার জন্য ওখানে জড় হওয়ার ব্যাপারটা ম্যাটের বাবা-মা কখনো খারাপভাবে নিতেন না। বরং তাদের রান্নাঘরে যথেষ্ট পরিমাণে ‘জাং’ খাবারের  ব্যবস্থা থাকতো যেটা আমাদেরকে ওখানে যাবার জন্য আরো বেশি টানতো। (হাসির ব্যাপার হচ্ছে, ম্যাথিউ এখন একজন কার্ডিওলজিস্ট)। পরবর্তীতে, মন্ট্রিয়লে আমাদের সবার কোথাও রাত কাটানোর প্রয়োজন হলে আমরা সেখানে হানা দিতাম।
আমাদের বাড়িতেও মাঝে মাঝে বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানাতাম, তবে বাবা এ ব্যাপারে খুব বেশি আগ্রহ দেখাতেন না। আর আমাদের বাড়িটা সবার কাছে তেমন বেশি আগ্রহের জায়গাও ছিলো না। অ্যাভিনিউ দ্য পিনস-এ আমাদের বাড়িটা ছিলো বিশাল। বাড়ির পাহাড়ের দিককার প্রবেশদ্বার থেকে ছাদের ওপর পর্যন্ত একটা শিল্পকর্ম টাঙানো ছিলো। ওটার সোজা নিচে ছিলো বাবার জায়গা। ওখানে তিনি ছাড়া অন্য কেউ যেতো না। ওখানেই ছিলো তাঁর শোবার ঘর, পড়ার জায়গা আর লাইব্রেরি, তারপর ছিলো লম্বা একটা ফাঁকা জায়গা যেখানে সারিভাবে টাঙানো থাকতো পৃথিবীর বিভিন্ন নেতাদের সাথে তোলা তাঁর সব ছবি আর তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া বিভিন্ন স্মারক উপহার। ওটার নিচের তলাটা ছিলো আমাদের এবং তারপর ছিলো একটা বেইজমেন্ট যেটার সুড়ঙ্গ পথ গিয়ে মিলেছিলো সুইমিং পুলে। ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য কিছুটা বৈরী এই পরিবেশে আর এক ধাপ কঠোরতা ছিলো ভাষা ব্যবহার নিয়ে। বাবা নিয়ম করে দিয়েছিলেন বিভিন্ন তলায় বিভিন্ন ভাষায় কথা বলতে হবে। বিষয়টা ছিলো এমন যে সব চেয়ে উঁচু তলায় কথা বলতে হলে সেটা বলতে হতো শুধুমাত্র ফরাসিতে। ফলে ওই তলার কিচেনে বা লিভিং রুমে তিনি যদি আমাকে বা আমার বন্ধুদের ইংরেজিতে কথা বলতে শুনতেন, তাহলে আমরা তাঁর কাছ থেকে তিরস্কার শুনবো এটা ধরেই নিতাম। চিরকাল এমন অযৌক্তিক নিয়ম শৃংখলার মধ্যে জীবন পার করার ফলে এটা আমার কাছে তেমন কিছুই মনে হতো না, কিন্তু এ ব্যাপারটা আমার বন্ধুদের কাছে খুবই অস্বস্তিকর মনে হতো।
আমাদের তলায় শাসা, মিশেল আর আমার জন্য আলাদা শোবার ঘর ছিলো, এ ছাড়াও একটি পারিবারিক ঘর ছিলো। আমাদের তলাটা সব সময় হাসি, ঠাট্টা, তামাশা আর বাদ-বিবাদের শব্দে সরগরম হয়ে থাকতো। আসলে বালকেরা যেমনটি করে, তেমন হৈ চৈ সব সময় লেগেই থাকতো। তবে আমরা যত বেশি বিভিন্ন ধরনের মানুষের সাথে প্রতিনিয়ত মিশছিলাম, আমাদের বন্ধন আরো বেশি মজবুত হচ্ছিলো এবং আমাদের সেই বয়সেই একে অপরকে সব ধরনের সহযোগিতা করতাম। তবে বাড়িতে আমাদের কিছু অদ্ভুত কর্মকা- দেখে আমাদের প্রতি বন্ধুদের আগ্রহ ছিলো অন্যরকম। আমাদের  পারিবারিক ঘরটায় নিচু গদিওয়ালা বসার জায়গা আর মোটা মাদুর বিছানো থাকতো, বাবা আমাদের অবসর কাটানো আর খেলাধূলা-মারামারি করার জন্য এমনভাবে ঘরটা সাজিয়েছিলেন। আমরা জুডো শিখতে শিখতে বেড়ে উঠেছিলাম। ফলে একে অপরকে ধরে ধ্বস্তাধস্তি করে আছাড় দেয়া ছিলো আমাদের একটা খেলা বা আনন্দের ব্যাপার। কিন্তু আমরা যখন লাঠি আর কাঠের তলোয়ার নিয়ে একে অপরকে আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হতাম, তখন আমাদেরকে কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হতো। প্রথমত ছিলো, কারো মুখে ঘুষি মারা যাবে না এবং কাউকে কামড়ানো যাবে না। আর কেউ যদি আঘাত পেয়ে আহত হয়ে পড়ে, তবে তখনই খেলা থামিয়ে দিতে হবে। আমার বন্ধুরা যখন প্রথমবারের মতো আমাদের কুস্তি লড়তে দেখেছিলো। তখন আমাদের আক্রমণাত্মক লড়াই দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। আমি আগেই বলেছি, ওই সময়ের মধ্য এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিলো যে, শাসা, মিশেল আর আমি একেবারে আলাদা আর পরস্পর বিরোধী ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য নিয়ে বেড়ে উঠছি। ফলে একে অপরকে ধরে আছাড় দেয়ার ধরনটাও ছিলো  আমরা যে প্রক্রিয়ায় বেড়ে উঠেছিলাম সেই ধরনের।


কিছু কিছু সময় আসতো যখন আমাদের তর্ক-বিতর্ক আমাদের আয়ত্ত্বের বাইরে চলে যেতো। আমার মনে পড়ছে, একবার আমরা আমাদের বাবার ভলভো’টা নিয়ে নিউবরো লেকে মা’য়ের বাসার দিকে যাচ্ছিলাম। আমি ছিলাম চালকের আসনে। তখন আমার বয়স আঠারো, শাসার ষোল আর মিশেলের চৌদ্দ। হঠাৎ কী এক অদ্ভুত কারণে আমরা এক উত্তপ্ত তর্কে মেতে উঠেছিলাম। আসল বিষয়টা ছিলো, কার আয়ত্ত্বে গাড়ির জানালাগুলো থাকবে। এটা এমন এক বিষয় যে শুধুমাত্র ওই কিশোর বয়সের ছেলেমেয়েরাই এমন সব গৌণ বিষয় নিয়ে এমন আগুনঝরা তর্কে মেতে উঠতে পারে। বিষয়টা এমন এক পর্যায়ে গেলো যে আমি রাস্তার পাশে গাড়ি থামালাম। তারপর আমরা খেলা নয়, একেবারে সত্যিকারের মারামারি শুরু করে দিলাম। শাসা আর মিশেল আমাকে মেরে একেবারে মাটিতে শুইয়ে দিলো। অপমান আর রাগে আমি বিড়বিড় করতে লাগলাম। যাহোক, আমরা সবাই ধীরে ধীরে ঠা-া হয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। তারপর বাকি পথটা যাবার জন্য একে অপরের প্রতি যে তীব্র রাগ ছিলো সেটা ধীরে ধীরে প্রশমিত করেছিলাম।
যখন আমরা মন্ট্রিয়লে ফিরলাম আর বাবা সবকিছু শুনলেন, তখন তিনি আমাদেরকে এভাবে রাস্তায় মারামারি করায় কানাডার আইনে যে শাস্তি আছে সেটা পড়ে শুনালেন। তিনি শুধু বলেছিলেন, “তোমাদের ভিতর যা ঘটেছে সেটা কোনো ব্যাপার নয়। শুধু মনে রেখো, তোমাদের তিনজনকে সব সময় এক সাথে থাকতে হবে।” এই কথা বলে কিছুক্ষণ থেমে তিনি আমাদের সতর্ক করে বলেছিলেন, ভবিষ্যতে তিনি যেনো এমন কিছু আর না শুনেন। এই কারণে, আমরা সব সময় আপ্রাণ চেষ্টা করেছি, আমরা যেনো আর কখনো রাস্তার পাশে অমন মারামারিতে জড়িয়ে না পড়ি।
এখন আমার ছেলেমেয়ে হবার পর আমি উপলব্ধি করতে পারি, ছেলেমেয়েরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করলে সেটা বাবা-মা’র কাছে কত বেশি বেদনাদায়ক হয়। এখন আমি সত্যিই বুঝতে পারি কেনো আমাদের অমন মারামারিতে তাঁর মনটা খারাপ হয়ে যেতো।
অ্যাথলেটিক্স থেকে যে কোনো খেলার প্রতি আমার সারাজীবনের এই যে প্রেম তা কিন্তু গড়ে উঠেছিলো ব্রেবফ স্কুল থেকে। সেটা ঘরে বাইরের যে কোনো খেলা বিশেষ করে ফুটবল এর কথা বলা যায়। এমনকী জিমন্যাসটিক্স দলের সাথেও আমার ওঠাবসা ছিলো। সচারচর কানাডায় যেমনটি হয় তেমনি এখনকার মত তখনো ব্রেবফ এ খেলার রাজা বলতে হকি’কেই বুঝাতো। তোমাদের মনে হতে পারে, আমরা যখন কিন্ডার গার্ডেনে পড়তাম তখন থেকেই বাবা আমাদের হাতে লাঠি ধরিয়ে দিয়ে কিছু ছুঁড়ে দিয়ে তা মারার জন্য উৎসাহ দিতেন। কিন্তু আসলে তেমন কিছু ঘটতো না। একেবারে শুরু থেকেই তিনি এমন কিছু করতে বলতেন যাতে আমরা আমাদের নিজেদের একার শক্তি বা ক্ষমতা দেখানোর সুযোগ পেতাম। তিনি সব সময়ই চাইতেন আমরা নিজে নিজেরাই কতটুকু লড়াই চালাতে পারি বা কত দূরে যেতে পারিÑ তেমন খেলায় আমরা মেতে থাকি। অন্যের সহযোগিতা বা দলে থেকে খেলা চালিয়ে যাওয়া বা সাফল্য আনায় তিনি কখনো সন্তুষ্ট হতেন না। তিনি সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন যে, কাঁপতে কাঁপতে বরফের ওপর স্কেটিং করে তিনি তাঁর ভোরটা কাটাবেন না। আমার অনেক বন্ধুর পরিবারই হকি পছন্দ করতেন কিন্তু বাবার ইচ্ছায় আমাদের পছন্দ ছিলো গ্রামান্তর দৌড় ও পাহাড়ের ওপর থেকে স্কেটিং করতে করতে নিচে নামা। আমাদের এটা পছন্দের কারণ ছিলো কারণ আমরা পুরো পরিবারই বাড়ির বাইরে এমন ধরনের খেলাধূলায় মেতে থাকতাম।
আমার এটাও মনে হয়, তাঁর চরিত্রের ভিতরের যে অনুভূতি প্রবণতা কাজ করতো, তা হকি বা এই ধরনের খেলাধূলার ক্ষেত্রে বৈরী ছিলো। প্রকৃতির মধ্যে বেড়ে উঠা মানুষ প্রকৃতির অপার প্রাকৃতিক নিয়মের মধ্যে না থেকে একজন স্ট্রাইপ শার্ট পড়া মানুষের বাঁশির ফুঁ’তে নিয়ন্ত্রিত হওয়া খেলায় জীবন পার করবেন সেটা তিনি মানতেই পারতেন না। আমরা যখন কেবল স্কেট করা শিখছিলাম, সেটা ছিলো রিদিউ ক্যানালে। তখন আমরা শুধু হকিস্টিক বা এ ধরনের খেলার সামগ্রী চোখে দেখতাম।
আমি যখন স্কুলে আমার হকির সরঞ্জাম দেখিয়েছিলাম, তখন পরিস্থিতিটা একেবারে ঘোলাটে হয়ে গিয়েছিলো। হকির স্টিকটা দেখতে চৌকষ আর নামকরা কোনো ব্র্যান্ডের কিনা এই বিষয়টা কানাডার হাই স্কুলের ছাত্রদের কাছে এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিলো। আমার বিশ্বাস ছিলো, বাবা আমাকে কোনো খেলাধূলার জিনিসপত্র বিক্রি করে এমন এক দোকানে নিয়ে গিয়ে এমন এক ব্র্যান্ডের হকিস্টিক কিনে দিবে যাতে আমি আমার হকি খেলোয়াড় বন্ধুদের দলে সহজেই ভিড়তে পারি। সত্যি বলতে কী, আমি হকি খেলায় খুব ভালো ছিলাম না। কিন্তু বাবা আমাকে আমার প্রত্যাশিত কোনো দোকানে না নিয়ে গিয়ে, আমাকে আমাদের বাড়ির স্টোর রুমে নিয়ে গিয়ে একটা নীল লম্বা কাঠ বের করে দিলেন। যেটা কয়েক বছর আগে চেকোশ্লভাকিয়ায় রাষ্ট্রীয় সফরে উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, সেটা একটা হকিস্টিক এবং খুবই অসাধারণ কিছু। কিন্তু আমার সন্দেহ হচ্ছিলো, সেটা আসলেই হকিস্টিক কি না। কারণ, আমি ওটা যে কোন ব্র্যান্ডের সেটা বুঝতে পারছিলাম না। ওটার গায়ে যা লিখা ছিলো সেটা এমন এক ভাষায় যে আমার পক্ষে পড়া সম্ভব ছিলো না। ওটা আমাকে কোনোভাবেই খুশি করতে পারে নি। স্কুলের খেলার মাঠে আমার নিজেকে মনে হচ্ছিল রচ ক্যারিয়ার এর “দ্য হকি সোয়েটার” এর সেই ক্ষুদে বালকের মতো। তার সাথে আমার অমিলের জায়গাটা ছিলো। সে শুধু পড়েছিলো ভুল জার্সি আর আমি খেলতে গিয়েছিলাম ভুল হকিস্টিক নিয়ে। আমি যখন আমার সেই নীল রঙের বাবার দেয়া অদ্ভুত হকিস্টিক নিয়ে স্কুলের হকি দলে খেলতে গিয়েছিলাম, তখন আমার বন্ধুরা আমার হকিস্টিকের দিকে একবার তাকিয়েই তৎক্ষণাৎ জেনে ফেলেছিলো, আমার আর হকি দলে খেলা হচ্ছে না।
(চলবে)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ