শিক্ষায় যত সংকট

আপডেট: জানুয়ারি ৮, ২০১৭, ১১:৪০ অপরাহ্ণ

ড. সুলতান মাহমুদ রানা


একটি দেশের উন্নয়নের অন্যতম চাবিকাঠি হলো শিক্ষার উন্নয়ন। প্রবাদে আছে ‘যে জাতি যত শিক্ষিত সে জাতি তত উন্নত’। জাতিকে উন্নত করতেই শিক্ষার উন্নয়নে বিশেষ নজর রাখা হয়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার প্রথম থেকেই দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। অনেক ক্ষেত্রে সফল হয়েছে। ২০১০ সালে শিক্ষানীতি প্রণয়ন এবং পরবর্তীতে শিক্ষানীতির আলোকে শিক্ষা আইন প্রণয়নের আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। এছাড়াও শিক্ষার অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ নীতিগত অনেক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। এককথায় বলা যায় নানাবিধ প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে হলেও বাংলাদেশে ইতিমধ্যেই শিক্ষা ক্ষেত্রে যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে।
কিন্তু শিক্ষায় নানা ধরনের উন্নয়ন ঘটলেও কিছু ক্ষেত্রে প্রায়ই আপত্তি-বিপত্তি লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রায়ই বিশেষ কিছু মারাত্মক সমস্যা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে আঁকড়ে ধরে। এতে শিক্ষাব্যবস্থা প্রচ- রকমভাবে আক্রান্ত হয়। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে শিক্ষার পাশাপাশি আক্রান্ত হয় শিক্ষকরাও। ফলে সবার মনে প্রশ্ন জেগেছে কেন শিক্ষাব্যবস্থা আক্রান্ত হচ্ছে বারবার। গত কয়েকদিন ধরে গণমাধ্যমে ‘ভুলে ভরা পাঠ্য বই’ নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছে। নতুন বছরের বই উৎসব নিয়ে যেমন উদ্দীপনা ও অনুভূতি হওয়ার কথা সেটি এবার হয়ে ওঠেনি। কারণ শিশুদের নতুন বইয়ের ছাপায় কিছু সাংঘাতিক ধরনের ইচ্ছাকৃত এবং অনিচ্ছকৃত ভুল হয়েছে। যেসব ইস্যুতে কিংবা যুক্তিতে এসব পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তা গোটা শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি সমগ্র সমাজব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। এ বিষয়ে গণমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার পর পর্যালোচনার জন্য ইতোমধ্যেই একটি কমিটি করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। ভুলগুলো পরিমার্জনে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের ইতোমধ্যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পেরেছি।
প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম অনেক সমস্যার কথাই আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরে। এসব সমস্যা কোনোটি সমাধান হয় আবার কোনোটি সমাধানের ধারে কাছেও আসে না। বেশিরভাগক্ষেত্রে সংশোধনযোগ্য সমস্যা হলেও তা হেলাফেলা করে উদ্যোগের অভাবে সংকটেই থেকে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে শুধু ‘পাঠ্য বইয়ে ভুল’ নিয়ে নয়- শিক্ষার আরো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সংকট আমাদের চোখে পড়েছে। এমনকি গণমাধ্যমেই অনেকগুলো সমস্যা নিয়ে প্রতিনিয়ত আলোচনা-সমালোচনা চলছে। শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা প্রায়ই এসব বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিয়ে যাচ্ছেন। প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রতিটি স্তরেই নানাবিধ সমস্যা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আঁকড়ে ধরেছে।
গত কয়েকদিন ধরে পত্র-পত্রিকায় মেডিকেল শিক্ষা নিয়েও বেশ কিছু সংকটের সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে। কোনো রকমে জোড়াতালি দিয়ে এই ব্যবস্থাকে ক্রমেই সংকটের মুখে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। অথচ স্বাস্থ্যখাত বিবেচনায় মেডিকেল সেক্টরটি আমাদের দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই খাতের উন্নয়নে সরকারের বিশেষ নজরও রয়েছে। তবুও প্রয়োজনের তুলনায় ৬৩ শতাংশ কম শিক্ষক দিয়ে চলছে মেডিকেল শিক্ষাদান প্রক্রিয়া। আর এ সমস্যা সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই রয়েছে। শুধু শিক্ষকের ঘাটতিই নয়, অবকাঠামোর ঘাটতিও প্রকট। প্রায় ৮০ শতাংশ বেসরকারি মেডিকেল কলেজে বস্তুত হাসপাতাল নেই (প্রথম আলো, ৫ জানুযারি ২০১৭)। একটু আন্তরিকতা থাকলেই এ খাতটিকে আরো উন্নত করা সম্ভব। আমাদের দেশে মেডিকেল খাতে যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে অনেক চিকিৎসকের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু যথাযথভাবে চিকিৎসক গড়ে তুলতে না পারলে তারা সমাজের কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণ বয়ে আনার সম্ভবাবনাই বেশি থাকে।
পাঠ্যপুস্তকে ভুল ছাপা এবং বেমানান বিষয় ঢুকিয়ে দেওয়া, কিংবা মেডিকেল শিক্ষায় জোড়াতালির ইস্যু বাদ দিলেও শিক্ষাসংক্রান্ত আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদেরকে প্রায়ই ব্যথিত করে তোলে। শিক্ষার পরিকল্পনা, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও পরীক্ষাপদ্ধতিতে যা খুশি তা-ই করার বাড়াবাড়ি দেখে মনে হচ্ছে, শিশুদের কল্যাণ-অকল্যাণের বিষয়গুলো বুঝতে তথাকথিত বিশেষজ্ঞদের সমস্যা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের বয়স বিবেচনা করে পাঠ্যপুস্তকের সংখ্যা সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে প্রধানমন্ত্রী ইতিপূর্বে জোরালো নির্দেশনা দিলেও তা মানা হচ্ছে না। এমনকি শিশুর স্কুলব্যাগ তার শরীরের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি হতে পারবে না বলে গত ডিসেম্বরের গোড়ায় রায় দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। গত বছর পঞ্চম শ্রেণিতে যে শিশুটিকে ৬টি বই পড়তে হয়েছে, এখন তাকে ১৪টি বই পড়ে পরীক্ষা দিতে হবে। হঠাৎ করে দ্বিগুণের বেশি পড়ার চাপ শিশুরাও সামলাতে পারবে না। এমনকি এতো পাঠ্য পড়ানোর জন্য যথাযথ শিক্ষক ও শিক্ষা উপকরণও বেশির ভাগ বিদ্যালয়ে নেই। উল্লেখ্য, বেশিরভাগ বিদ্যালয়ে চারু ও কারুকলা, শারীরিক শিক্ষা ও সংগীতের কোনো শিক্ষক নেই। ফলে শিক্ষা হয়ে পড়ছে কোচিং নির্ভর। বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষক ও শিক্ষা উপকরণ না থাকায় শিশুকে বাধ্য হয়েই কোচিং নির্ভর হতে হচ্ছে।
প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা হওয়ার কথা আনন্দময়। কিন্তু এক বছরে বইয়ের সংখ্যা দ্বিগুণ করে আনন্দের পরিবর্তে মানসিক চাপ সৃষ্টির বিষয়টি আমাদের সকলকে অবাক করে দিয়েছে। এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে আমরা আরো লক্ষ করছি যে, তড়িঘড়ি করে পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ণ এবং পরীক্ষার ফলাফল প্রদানে জোর দেওয়া হচ্ছে শিক্ষা নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক। শিক্ষার সকল স্তরেই এই তড়িঘড়ি বিশেষভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে। আর এই তড়িঘড়ির ফলে ভুলের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। কখনোই গুণগত মানের কথা চিন্তা করা হচ্ছে না। সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়ে শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে বিবেচনা করার প্রবণতাও লক্ষ করা যাচ্ছে। এরই মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার খাতা দেখতে সঠিক ও প্রয়োজনীয় সময় বরাদ্দ দেওয়ার জন্য কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে যোগ্য ও অভিজ্ঞ শিক্ষক দিয়ে এসব পরীক্ষার খাতা দেখাতে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনি হবে না, তা-ও জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে।
দীর্ঘদিন থেকেই শিক্ষার বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। কিন্তু শিক্ষাকে নিস্কণ্টক মাত্রায় আনা কেন সম্ভব হচ্ছে না তা নিয়ে গভীরভাবে ভাববার সময় এসেছে। এখন সকলের মনেই একটি প্রশ্ন জাগ্রত হয়েছে যে, সরকারের আন্তরিক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কেন শিক্ষাকে নিষ্কণ্টক করা সম্ভব হচ্ছে না। তাহলে কি ধরে নেওয়া যায় যে, ভেতরে ভেতরে এমন কোনো ষড়যন্ত্র আছে যা শিক্ষার অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। কোনো কিছুকে আবহেলা না করে গুরুত্ব সহকারে সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের ব্যবস্থা করতে না পারলে শিক্ষার উন্নয়ন তথা রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
ংঁষঃধহসধযসঁফ.ৎধহধ@মসধরষ.পড়স