মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১১ আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
আখতার বানু বীণা:
আজ ২৫ শে বৈশাখ, ৮ মে, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬২ তম জন্মবার্ষিকী। কবির শুভ জন্মদিনে তাঁকে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। ১২৬৮ বঙ্গাব্দে বৈশাখ মাসে আজকের দিনে (১৮৬১ সালের ৭ মে তারিখে) কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন, কলকাতার জোড়া সাঁকোর ৫ নং দারকানাথ ঠাকুর লেনের মহর্ষি ভবনে। মৃত্যুবরণ করেন ১৩৪৮ সালের ২২ শে শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১ সাল)। পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মাতা সারদাদেবী। বাংলা সাহিত্যে, বিশ্বের ইতিহাসে সমুদ্রসম রবীন্দ্রনাথ। সাহিত্যের বিশাল ভান্ডারে সকল বয়সের সকল মানুষের জন্য তাঁর লেখনি। সাহিত্যের এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেন নি। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে একজন। একাধারে লেখক, গীতিকার, সুরকার, সংগঠক, শিক্ষাবিদ, দেশপ্রেমিক, চিন্তাবিদ, দার্শনিক। আবৃত্তি, অভিনয়, চিত্রাঙ্কণেও পারদর্শী ছিলেন তিঁনি। অনেক উপন্যাস, কাব্যগ্রন্থ, নাটক, গীতিনাট্য, গল্পের রচনা করেছেন সাথে শিশু সাহিত্যের বিশাল ভান্ডার গড়েছেন। সেগুলো জ্ঞানমূলক, উপদেশনামূলক তার সাথে আনন্দদায়ক। শিশুদের জন্য তিঁনি অনেক ছড়া, কবিতা,গল্প, নাটক, গান, উপন্যাস লিখেছেন। এগুলো শিশু মনের উপযোগী করে সহজ সরল ভাষায় রচিত। যেমনÑ শিশু ভোলানাথ, খাপছাড়া, ছড়া ও ছবি, গল্পগল্প কল্পণা, সহজপাঠ ইত্যাদি। শিশুদের মন নিয়ে, শিশুদের দেখা নিয়ে, শিশুদের ইচ্ছা, সুখ দুঃখ বেদনা নিয়ে তিঁনি লিখেছেন।
যেমনÑ খাপছাড়ার শুরুতে তিঁনি লিখেছেন‘সহজ কথা লিখতে আমায় কহ যে/ সহজ কথা যায়না লেখা সহজে।/ কঠিন লেখা নয়কো কঠিন মোটে/ যাÑতা লেখা তেমন সহজ নয়তো।’
কবির ৮/৯ বছর বয়সে লেখা“জল পড়ে পাতা নড়ে/ পাগলা হাতি মাথা নাড়ে।” “এক যে ছিল বাঘ গায়ে তার ডোরা ডোরা দাগ।” “আমসত্ব দুধে ফেলি তাহাতে কদলী দলি/ সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে হাপুশ হুপুশ।” যেখানে ভোজন রসিক কবিমনের প্রকাশ।
শিশুদের চিন্তারাজ্যে ঢুকে গিয়ে লিখেছেন বীরপুরুষ কবিতা “মনে কর যেন বিদেশ ঘুরে/ মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দুরে / তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে/ দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে /আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার পরে/ টগবগিয়ে তোমার পাশে বসে।” আবার ঠিক যেন শিশুদের দেখা, কবির দেখা আমাদেরও দেখা একই রকমÑ ‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতায় বলছেন
“আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে / বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে,
পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি / দুইধার উঁচু তার ঢালু তার পাড়ি। কিচিমিচি করে সেথা শালিকের ঝাঁক / রাতে উঠে থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক।” মনে হচ্ছে নদীটি আমাদের সকলেরই চেনা।
‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’ কবিতায় যেখানে মেঘের খেলা দেখে কবির মনে পড়ে লুকোচুরি সহ কত খেলার কথা। মনে পড়েছে সুয়োরাণী দুয়োরাণীর কথা। মনে পড়েছে অভিমানী কঙ্কাবতীর কথা। তারই সাথে শিব ঠাকুরের বিয়ের কথা।
তালগাছ দেখলে সত্যি সত্যিই মনে পড়ে যায় তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে সবগাছ ছাড়িয়ে আকাশে উঁকি দিচ্ছে।
আবার শিশুদের নানা সময়ে নানা কিছু হতে ইচ্ছা করে, সে সব ইচ্ছার কথা থেকে লিখেছেন ‘মাস্টারবাবু’ তে “আমি আজ কানাই মাস্টার পড় মোর বেড়াল ছানাটি, আমি ও কে মারি না মা, বেত/ মিছেমিছি বসি নিয়ে কাঠি । / রোজ রোজ দেরি করে আসে /পড়াতে দেয়না ও তো মন,/ আমি বলি ‘চ, ছ, জ ঝ ঞ/ ও কেবল বলে মিয়োঁ মিয়োঁ।” যেখানে শিশুর মাস্টার হতে ইচ্ছে
কখনও নৌকা যাত্রা করতে ইচ্ছা করে সে ইচ্ছার কথা ভেবে লিখেছেন‘নৌকাযাত্রা’ কবিতায় “আমি যাচ্ছি রাজপুত্র হয়ে / নৌকাভরা সোনামানিক বয়ে।” যেখানে আশুকে শ্যামকে সাথে নিয়ে তিনজন যাবেন। আরও অনেক কবিতায় অনেক কিছু হতে ইচ্ছা । জ্যোতিষ শাস্ত্র, মাতৃবৎসল, বৈজ্ঞানিক, ছোটবড় কবিতায় বাবার মত কর্তা সেজে কাজ করতে।
‘মাঝি কবিতায় বলছেন “মা যদি হও রাজী / বড় হলে আমি হব খেয়াঘাটের মাঝি।”
‘ইচ্ছামতী’ কবিতায় বলেছেন
“যখন যেমন মনে করি/ তাই হতে পারি যদি আমি / তবে একখানি হই ইচ্ছামতী নদী।” যেখানে দখিন ধারে থাকবে সূর্য উঠার পার আর বায়ের ধারে সন্ধ্যাবেলায় নামবে অন্ধকার। দুইপারের সাথেই মনের কথা হবে কবির অর্ধেক দিনে অর্ধেক রাতে।
‘লুকোচুরি’ কবিতায় কবির ফুল হয়ে গাছে ফুটতে ইচ্ছে। বই খাতা ফেলে দিয়ে ফেরিওয়ালা হতে ইচ্ছে, তাই লিখেছেন “ইচ্ছে করে সেলেট ফেলে দিয়ে /এমনি করে বেড়াই ফেরি নিয়ে।” এসবের পাশাপাশি সোনার তরী, দুই পাখি, আষাঢ়, কড়ি ও কোমল শিশুদের জন্য অসাধারণ সৃষ্টি আর কবিগুরু শিশুদের মনের পরিপূর্ণ বিকাশ।
কবিতার মত অমল ও দইওয়ালা নাটকে আমরা দেখেছি দইওয়ালার সুর “দই দই ভালো দই” এ সুর অমলের খুব ভালো লাগে। সে লেখাপড়া করে প-িত না হয়ে দইওয়ালা হতে চায়। ‘ইচ্ছেপূরণ’ গল্পে ছেলে বাবার মত বয়স আর বাবা ছেলের মত বয়স পেতে চায়। ছুটি গল্পের ফটিকের সাথে আমাদের প্রায় সকলেরই পরিচয় আছে। ফটিকের শেষ পরিণতিতে আমাদের চোখে জল এসে যায়। মায়ের কাছে যাবার বায়না, জাহাজে চড়ে। জ্বরে কাতর ফটিক খালাসির মত সুর করে বলতে থাকে “একবাও মেলেনা দোঁ বাও মেলে এÑ এÑ না।” পোস্টমাস্টার গল্পে পোস্টমাস্টারের নৌকা ছেড়ে দিলে রতন যেন কোথায় হারিয়ে যেতে থাকেÑ“রতনের মনে কোন তত্বের উদয় হইল না। সে সেই পোষ্ট অফিসের গৃহের চারিদিকে কেবল ভাসিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল।” কাবুলিওয়ালা গল্পে কাবুলিওয়ালার সাথে মিনির খুব ভাব হয়। দু’জনের মধ্যে ঠাট্টা প্রচলিত ছিল। মিনি বলতো “কাবুলিওয়ালা ও কাবুলিওয়ালা তোমার ঝুলির ভিতর কী ? কাবুলিওয়ালা মিনিকে বলতোÑ “খোঁখী তোমী সসুরবাড়ি কখনও যাবে না ?” আবার মিনিও কাবুলিওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করতো“তুমি শ্বশুরবাড়ি যাবে?” কাবুলিওয়ালা বলতো “হামি সসুরকে মারবে।”
এভাবে অনেক রসাত্মক গল্পসহ বলাই, আপদসহ শিশুদের জন্য অনেক গল্প লিখেছেন।
কবিগুরুর সাহিত্যের বড় দিক তাঁর লেখা গান রবীন্দ্র সঙ্গীত নামে পরিচিত। এপার বাংলা ওপার বাংলা দুই বাংলার জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বড়দের পাশাপাশি, শিশুদের জন্যও অনেক গান তিঁনি রচনা করেছেন “মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি /আজ আমাদের ছুটি ও ভাই আজ আমাদের ছুটি।” সেই ছুটিতে কবি দিশেহারা কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। গণতান্ত্রিক অধিকারের চর্চায় লিখেছেন “ আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে / নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী সত্বে।” অসংখ্য মৃত্যুকে তিনি জয় করেছেন। তারই আলোকে লিখেছেন “মম চিত্তে নীতি নৃত্যে কেযে নাঁচে তাতা থৈ থৈ তাতা থৈ থৈ। কী আনন্দ কী আনন্দ দিবারাত্রী নাঁচে মুক্তি নাঁচে বন্ধ… পাছে পাছে তাতা থৈ থৈ তাতা থৈ থৈ।”
ছোট্ট জোঁনাকীকে বলছেন“জোঁনাকী কী সুখে ঐ ডানা দু’টি মেলেছো। / আঁধার সাঁঝে বনের মাঝে উল্লাসে প্রাণ ঢেলেছো।/তুমি নওতো সূর্য নওতো চন্দ্র /তোমার তাই বলে কী কম আনন্দ /তুমি আপন জীবন পূর্ণ করে আপন আলো জ্বেলেছো/ ও জোঁনাকী” নিজের পূর্ণতার মধ্য দিয়ে অপরকে আলো ছড়ানোর অসাধারণ দর্শনের উপস্থাপন। আবার শিশুদের সামাজিকভাবে বেড়ে উঠতে, একে অপরের প্রতি সহযোগিতা, সহমর্মিতায়, ভালবাসায় আচ্ছন্ন করতে লিখেছেন “আয় তবে সহচরী হাতে হাতে ধরি ধরি নাচিব ঘিরি ঘিরি, গাহিব গান।” এরকম অসংখ্য গান। কবিতা, গল্পসহ আরও অনেক কিছুর সংমিশ্রণে শিশু সাহিত্য। যার সাথে মিশে আছে শিশু মনের যাবতীয় কল্পনা, রূপ- রস, গন্ধ, আবেগ অনুভূতিসহ নানান আশা আকাক্সক্ষা। যেখানে জুড়ে আছে শিশু সাহিত্যের একটি বিরাট অংশ। যা নির্দিষ্ট একটি ছকে তুলে আনা সম্ভব না। আর তার চর্চায় প্রতিনিয়ত শিশুসহ আমাদের সকলের মন সুস্থ থাকে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, মাদার বখ্শ্ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ, রাজশাহী।