সোমবার, ২ অক্টোবর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৭ আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
কাক্সিক্ষতা নিসর্গ ইসলাম
শেষ মুঘল স¤্রাট বাহাদুর শাহ্ জাফর (১৭৭৫-১৮৬২) ভারতবর্ষে বৃটিশ পরাধীনতার বিরুদ্ধে প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামে তথা সিপাহী বিদ্রোহে নেতৃত্বদানকারী স¤্রাট। তাঁর জন্ম আনুমানিক ১৭৭৫ সালে। ১৮৫৭ সালে ৮২ বছর বয়সে তিনি সিপাহীদের পরিচালনার নেতৃত্ব তুলে নেন নিজ হাতে। ১৮৫৭ সালের ১২ মে থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪ মাসের বেশি সময় দিল্লি বিপ্লবী সিপাহীদের দখলে ছিল। এর নেতৃত্ব দেন স¤্রাট জাফর। তাঁর সন্তানেরা অর্থাভাব, সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং বিশৃংখলার কারণে এই বিপ্লব শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। বিপ্লবের সময় দিল্লিতে ছিল শাসরুদ্ধকর অবস্থা। মুঘল রাজবংশের শেষ স¤্রাট, যিনি নিজ মাতৃভূমিতে দুই গজ মাটির জন্য আক্ষেপ করেছেন। বিদ্রোহে সমর্থন ও নেতৃত্ব দানের অভিযোগে তাঁকে নির্বাসিত করা হয় রেঙ্গুনে। আর এখানেই ৮৭ বছর বয়সে ১৮৬২ সালের ৭ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন তিনি। রেঙ্গুনে তাঁর শবদেহ দাফন করা হয়। যা এখন বাহাদুর শাহ্ দরগাহ নামে পরিচিত।
ভারতে মুঘল সা¤্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরুদ্দিন মুহম্মদ বাবর ১৫৬২ খৃষ্টাব্দে পানিপথের যুদ্ধে জয়লাভ করার মাধ্যমে দিল্লিতে মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। বাবরের চরিত্র ছিল কঠিন ও কোমলে গড়া। তাঁর কবিত্ব প্রতিভার প্রকৃত উত্তরাধিকার ছিলেন শেষ স¤্রাট বাহাদুর শাহ্ জাফর। আর বাবর, হুমায়ন ও আকবরের মত বাহাদুর শাহ জাফরও ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারতবাসীকে উদাত্ত আহ্বান জানাতে পেরেছিলেন ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে।
১৮৫৭ সালের সিপাহী অভ্যুত্থানকে প্রকৃতপক্ষে কী বলা যায়? বিদ্রোহ বিপ্লব নাকি স্বাধীনতা সংগ্রাম? যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন এই ঘটনার তাৎপর্য ছিল ব্যাপক। এই সংগ্রামে হাজার হাজার ভারতীয় সিপাহী ও সাধারণ মানুষ জীবন দেয়। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এর প্রভাব গভীর।
সিপাহী অভ্যুত্থান এবং এই ঘটনায় বাহাদুর শাহের ভূমিকা সম্পর্কে বলার পূর্বে এর সুদীর্ঘ প্রেক্ষাপট সম্পর্কে আলোচনা করা প্রয়োজন। ১৬৪৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষে তাদের প্রথম কুটি স্থাপন করে মহানদীর নিকট। এরপর একে একে ঢাকা, বোম্বে, দিল্লি, কোলকতা, গুজরাট প্রভৃতি স্থানে কোম্পানি তাদের কুটি স্থাপন করতে থাকে। ১৬৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গ। ১৭১৪ সালে স¤্রাট ফররুখশিয়ার এর ফরমান দ্বারা দেশের স্বাধীনতাকে আংশিক বিলিয়ে দেয়া হয়েছিল বলা যেতে পারে। ১৭৫৯ সালে স¤্রাট হন দ্বিতীয় শাহ্ আলম। তার পূর্বে ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে সিরাজউদদৌলা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে পরাজিত হয়ে বাংলার স্বাধীনতা হারিয়েছেন। স¤্রাট শাহ্ আলমের ক্ষমতাও নিরঙ্কুশ ছিল না। প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, প্রাদেশিক শাসকদের অবাধ্যতা ও এবং মারাঠা বিদ্রোহ সবদিক দিয়ে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল তাঁকে। তখন স¤্রাট সাহায্য চান ক্লাইভের কাছে। কিন্তু, সাড়া দেননি তিনি। স¤্রাট তখন ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবার জন্য ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে নৈতিক সমর্থন দেন মীর কাশিমকে। তারপর, ১৭৬৫ সালে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি প্রদান করেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে।
বিদ্রোহী অমাত্যদের দমন করার জন্য তিনি গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিসের শরণ নেন। কিন্তু, সাড়া মেলেনি। তখন স¤্রাট বাধ্য হয়ে সাহায্য চেয়ে পত্র লিখেন আফগানিস্তানের রাজা জামান শাহকে ভারত আক্রমণ করে বিদ্রোহী অমাত্যদের শায়েস্তা করার জন্য। কিন্তু, তিনিও সাড়া দিলেন না।
১৮০৩ সালে স¤্রাট শাহ্ আলমকে নতুন গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি ইংরেজ শক্তির সম্পূর্ণ অনুগত করে ফেললেন। শাহ্ আলম ১৮০৬ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ইংরেজদের পেনশন ভোগী ছিলেন। পরবর্তী মুঘল স¤্রাট ছিলেন স¤্রাট দ্বিতীয় আকবর। তিনিও নামেমাত্র স¤্রাট। ১৮৩৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুঘল মুদ্রার পরিবর্তে ইংল্যান্ডের রাজার প্রতিকৃতি সংবলিত নতুন মুদ্রা চালু করে। মুঘল স¤্রাটের ক্ষমতার শেষ চিহ্নও মুছে যায় এভাবে। পিতা দ্বিতীয় আকবরের নিকট থেকে বাহাদুর শাহ্ রাজ্যহীন রাজত্ব লাভ করেন।
১৮৩৭ সালে বাহাদুর শাহ্ সিংহাসন লাভ করেন। তাঁর কর্তৃত্ব ছিল শুধুমাত্র রাজ প্রাসাদের মধ্যেই। তাঁর কোন প্রশাসনিক ক্ষমতা ছিল না। এমনকি রাজ প্রাসাদের বাইরেও যেতে পারতেন না একা। ১৮৫৭ সালের পূর্ব পর্যন্ত ইংরেজদের সাথে আপোসের চেষ্টা করে ছিলেন। রাজি হননি অভ্যুত্থানের নেতা হতে। তিনি ইংরেজদের সাথে আপোস করতে না পেরে বাধ্য হয়েই বিদ্রোহীদের নেতা হন। তখন তিনি অশীতিপর বৃদ্ধ। শারীরিক এবং মানসিক দিক দিয়ে প্রায় অনুপযুক্ত।
১৮৫৭ সালের ১১ মে মিরাটে ভারতীয় সেনারা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তারা যমুনা নদী পার হয়ে দিল্লি পৌঁছে যায়। দিল্লিবাসী তখনও জানতে পারেনি বিষয়টি। বিদ্রোহী সেনারা চুঙ্গি থানায় আগুন জ্বালিয়ে এবং হত্যা করে দারোগাকে। লালকেল্লার পিছনে একত্রিত হয়ে কেল্লার ভেতরের স¤্রাট বাহাদুর শাহ্ জাফরের সাথে তারা যোগাযোগের চেষ্টা করতে থাকে। স¤্রাট তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি জ্ঞাত করেন কেল্লার তত্ত্বাবধায়ক ক্যাপ্টেন ডগলাসকে। বিদ্রোহীদের অভিযোগ ছিল রাইফেল এর কার্তুজ গরু ও শুয়োরের চামড়া দিয়ে তৈরি। যা দাঁত দিয়ে ছিঁড়তে হত। ফলে মুসলমান ও হিন্দু উভয়ই ধর্ম বিসর্জন দিতে বসেছে। ইংরেজরা সমগ্র ভারতবাসীকে খৃষ্টান বানাতে চায়। তাই, ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের এই বিদ্রোহ।
এইসব বক্তব্যের একটু পরেই সংবাদ আসে ডগলাসহ হত্যা করা হয়েছে অন্যান্য ইংরেজ প্রহরীকে। শহরের চলছে লুটপাট। বিপ্লবী সেনারা ইংরেজদের পাইকারি হারে হত্যা করছে। এসময় দিল্লির সাধারণ লোকজন এসে স¤্রাটের নিকট নিরাপত্তা প্রদানের আবেদন জানায়।
এই সময় দিল্লি শহর বিপ্লবী সেনাদের দখলে চলে যায়। স¤্রাট তাঁর পুত্র মির্জা মুঘলকে কমান্ডার ইন চিফ মনোনয়ন দেন এবং অন্য পুত্রদের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করে শহরে আইন শৃংখলা ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব অর্জন করেন। স¤্রাট নিজে হাতির পিটে চেপে শহর পরিদর্শনে বের হন। তিনি ব্যবসায়ীদের দোকান-পাট খোলা রাখার অনুরোধ জানান। ক্ষতিগ্রস্ত অনেক বাড়িতে গিয়ে সান্ত¦না দেন। শহরের সর্দারদের বৈঠক ডেকে বিপ্লবী সেনাদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা নিয়ে আলাপ আলোচনা করেন।
বিদ্রোহী সেনারা দিল্লির গোলাবারুদের গুদাম দখল করার চেষ্টা করে এবং এর চারিদিক ঘেরাও করে রাখে। এই পরিস্থিতিতে প্রহরারত ইংরেজ কর্মকর্তারা বোমা মেরে গুদাম উড়িয়ে দেয়। এর ফলে আশেপাশের বহু মানুষ নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ছয়জন সেনা কর্মকর্তা আহত হন। বিপ্লবী সেনাদের প্রতিরোধ করার ক্ষমতা স্থানীয় ইংরেজ সেনাদের ছিল না। তাই স¤্রাট বাহাদুর শাহ্ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে আগ্রায় অবস্থানরত লে-গভর্নরের নিকট পত্র প্রেরণ করেন।
বিদ্রোহীরা লালকেল্লায় গিয়ে স¤্রাটের নিকট ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণের অনরোধ জানায়। নগরবাসী ছিল বিশৃংখলায় অতিষ্ঠ। এমন পরিস্থিতিতে বৃদ্ধ বয়সে স¤্রাট বাহাদুর শাহ্ বিপ্লবী সেনাদের নেতৃত্ব গ্রহণে রাজি হন। বিপ্লবী সেনারা তাঁকে স¤্রাট হিসেবে মনে করলে ১৮৫৭ সালের ১৬ মে তিনি লালকেল্লায় দরবার আহ্বান করেন এবং যুবরাজদের সেনা প্রধানসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দান করেন।
বাহাদুর শাহের দুই প্রধান অমাত্য হাকিম আহসানউল্লাহ্ খান ও মাহবুব আলী খান ছিলেন উচ্চাভিলাষী ও চক্রান্তকারী। ইংরেজদের সাথে ছিল তাঁদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। বিদ্রোহী সিপাহীরা খাদ্য, বস্ত্র ও অর্থ চেয়ে বিফল হন। আহসান উল্লাহ্ খান বিদ্রোহীদের সমস্ত খবর ইংরেজদের নিয়মিত সরবরাহ করেছিলেন। বিদ্রোহীরা হাকিমের বাড়ি পুড়িয়ে দেয় এবং তাঁকে হত্যার চেষ্টা করে। অবশ্য স¤্রাটের হস্তক্ষেপে তিনি রক্ষা পান। বাহাদুর শাহ্্ বিদ্রোহীদের নেতা হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে ইংরেজদের রোষানলে পড়ে যান। বিপ্লবী সেনাদের কর্মকা- ও লালকেল্লার স¤্রাটের নির্দেশসহ যাবতীয় তথ্য গোয়েন্দাদের মাধ্যমে ইংরেজদের নিকট পৌঁছে যেত। ফলে ইংরেজরা গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করত।
সিপাহীরা বিদ্রোহ করে প্রবল উদ্দীপনায়। বিপ্লবী সেনাদের কোন শৃংখলা ছিল না। কর্মকর্তাদের নির্দেশ সেনারা পালন করত না। বিপ্লব সফল করার ব্যাপারে কোন সুশৃংখল চেষ্টা চালানো হয়নি। পাশাপাশি স¤্রাটও ছিলেন আবেগ প্রবণ। তাঁর সবচাইতে বড় অসুবিধা ছিল যুবরাজদের অপকর্ম। যুবরাজ মির্জা মুঘল অর্থ সংগ্রহ করে তা কোষাগারে জমা দিতেন না। বাধ্য হয়ে স¤্রাট বখত খানকে প্রশাসনের সামগ্রিক দায়িত্ব দেন। তাঁকে লর্ড গভর্নর খেতাব দেয়া হয়। সেনাপ্রধান মির্জা মুঘল পছন্দ করেন নি স¤্রাটের এই সিদ্ধান্তকে।
জুলাই মাসে দিল্লিতে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে। হিন্দু-মুসলমান ঐক্য বজায় রাখার জন্য ঈদুল আজহার দিন গরু জবাই নিষিদ্ধ করা হয়। এব্যাপারে স¤্রাট লালকেল্লা থেকে একটি বিশেষ ফরমান জারি করেন।
বিপ্লবী সেনারা দীর্ঘদিন ধরে চেতনা পাওয়া কর্মকর্তার নির্দেশ অমান্য করতে থাকে। চেতনা পেয়ে ১০০ বিপ্লবী পুনরায় বৃটিশ বাহিনীতে ফিরে যায়। অন্যরা ও ফিরে যাবার দিতে থাকে। এদিকে, সেনা প্রধান যুবরাজ মির্জা মুঘলের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক দায়িত্ব নিয়ে বখত খানের দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। একই সাথে মুঘল অভিজাত সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশের ভূমিকাও ছিল ইংরেজদের পক্ষে। ইংরেজ রাজকর্মচারী স্যার সৈয়দ আহমদ খান বরাবর ছিলেন ইংরেজদের অনুগত। কবি মির্জা গালিব ছিলেন ইংরেজদের পেনশনভোগী। তিনি মুঘলদের দেয়া খেতাব ও ত্যাগ করেন। এ সময় তিনি কবিতায় ইংরেজদের প্রশান্তি পেরেছেন এবং গালমন্দ করেছেন বিদ্রোহীদের।
তবে, মুসলিম অভিজাতদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বিদ্রোহীদের সাথে ছিল। দেশিয় রাজ্যের মুসলিম নবাব ও জমিদার সরাসরি সিপাহীদের সমর্থন যুগিয়েছিলেন। তেমন হিন্দু জমিদার ও অভিজাত শ্রেণিও এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই অবস্থায় যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে ভারতবর্ষে প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম ব্যর্থ হয়ে যায়। হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ এই সিপাহী বিদ্রোহকে সমর্থন ও প্রত্যাখান করেছিল। স¤্রাট বাহাদুর শাহের পক্ষে সম্ভব ছিল না নেতৃত্ব দেয়া। তাঁর অবস্থান ছিল নামমাত্র।
সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে সিপাহি বিপ্লবের পরিসমাপ্তি এবং ইংরেজদের বিজয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। কারণ, রাজকোষাগার তখন শূন্য এবং সিপাহীরা লক্ষ্য অর্জনের পরিবর্তে নিজেদের বেতন নিয়ে অধিক চিন্তিত ছিল। বেতনের দাবিতে বিপ্লবী সেনারা দিল্লিতে অবস্থিত দুটি বেগম মহল ঘেরাও করে রাখে। স¤্রাট বাহাদুর শাহ্ যেকোন মূল্যে লড়াই চালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কারণ, ইংরেজরা জয়ী হয়ে স¤্রাট ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুদ- ছিল অবধারিত। বেতন না দিলে বিপ্লবী সেনা কর্মকর্তারা লুটপাটে অংশ নেবার হুমকি দেয়। উত্তরে স¤্রাট আশ্বাস দেন, তিনি তাঁর হাতি, ঘোড়া, শাহী অলংকার ও মালপত্র বিক্রি করে সেনাদের বেতন দিবেন। নাসিরবাদে সেনাদের চাপে স¤্রাট তাঁর রূপায় আসবাবপত্র সেনাদের হাতে তুলে দেন এবং সেসব বিক্রি করা অর্থ ভাগ করে দেন।
পরদিন খবর আসে মিরাটে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইংরেজরা দখল করে নিয়েছে আলীগড়। পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে আসছিল। স¤্রাট বাহাদুর শাহ বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্য দেশিয় বিভিন্ন রাজাদের একটি কাউন্সিলের হাতে রাজ ক্ষমতা হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলেন। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাইকে তিনি ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবার অঙ্গীকার করেন।
১৮৫৭ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ইংরেজরা দিল্লি শহরে প্রবেশ করে। ওই দিন তারা জামে মসজিদ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। বিপ্লবী সেনারা জামে মসজিদের আশ্রয় নিয়ে ইংরেজদের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করে। স¤্রাট জাফর যুদ্ধের সময় লালডুগি এলাকায় গিয়েছিলেন, সেখানে বিপ্লবী সেনা ও প্রজারা জমায়েত হয়। বৃটিশ সেনারা সেখানে গোলা নিক্ষেপ করেছিল। তাই স¤্রাটকে পুনরায় লালকেল্লায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। ১৭ ও ১৮ সেপ্টেম্বর উভয়পক্ষের মধ্যে প্রচ- যুদ্ধ হয়। বিপ্লবী সেনাদের আর মোকাবিলা করার ক্ষমতা ছিল না। ১৯ সেপ্টেম্বর স¤্রাট তাঁর স্ত্রী ও পুত্রদের নিয়ে আশ্রয় নেন হুমায়ুনের সমাধিতে।
২১ সেপ্টেম্বর মেজর হার্ডসন হুমায়ুনের সমাধি থেকে স¤্রাটকে গ্রেপ্তার করেন। আশ্বাস দেয়া হয় তাঁকে মৃত্যুদ- দেয়া হবে না। পরদিন ২২ সেপ্টেম্বর হার্ডসন হুমায়ুনের সমাধি থেকে তিন যুবরাজ মির্জা মুঘল, মির্জা খজর সুলতান এবং মির্জা আবু বকর কে গ্রেপ্তার করে লালকেল্লায় নিয়ে আসেন। দিল্লি গেটের কাছে পৌঁছানোর পর হার্ডসন তিন যুবরাজকে গুলি করে হত্যা করেন। পরে স¤্রাট পরিবারের ১৯ জন সদস্যকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের সাথে ষড়যন্ত্র ও যোগাযোগ এর অপরাধে মামলা দায়ের করা হয়। স¤্রাট বাহাদুর শাহের বিরুদ্ধেও রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি বিদ্রোহী সেনাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন, নিজেকে স¤্রাট ঘোষণা করেছেন এবং ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে উসকানি দিয়েছেন। সবচাইতে গুরুতর অভিযোগ হল ১৮৫৭ সালের ১৬ মে লালকেল্লায় নিরস্ত্র ৪৯ জন নারী-পুরুষ ও শিশুকে যে বিদ্রোহী সেনারা হত্যা করেছিল সেখানে স¤্রাটের উসকানি ছিল।৮ প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি স¤্রাট অবগতই ছিলেন না।
১৮৫৮ সালের ৯ মার্চ সামরিক আদালত সম্রাট বাহাদুর শাহের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করেন। রায়ে তাঁকে মৃত্যুদ-ের পরিবর্তে রেঙ্গুনে নির্বাসনের সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। ইংরেজদের আশংকা ছিল স¤্রাটকে মৃত্যুদ- দিলে তিনি ভারতবাসীর নিকট বীরের মর্যাদা পাবেন এবং এবিষয়কে কেন্দ্র করে পুনরায় সংঘবদ্ধ হবে ভারতীয়রা।
বাহাদুর শাহকে ১৮৫৭ সালের ১৯ নভেম্বর রেঙ্গুনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ১৮৬২ সালের ৭ নভেম্বর স¤্রাট মৃত্যুবরণ করেন। এসময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। বাহাদুর শাহ্ তাঁর পিতা দ্বিতীয় আকবর শাহের স্ত্রী লালবাই এর সন্তান। আকবর শাহ্ হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে লালবাইকে গ্রহণ করেছিলেন।
বাহাদুর শাহ্ আজ নেই। মুঘল বংশের শেষ জীবিত সন্তান, যে বংশ পৃথিবীতে সর্বাধিক সংখ্যক স¤্রাটের জন্ম দিয়েছে। এই বংশের বিভিন্ন শাখা শাসন করেছে চিন, তুরস্ক, পারস্য ও ভারত সা¤্রাজ্য। পৃথিবীর ইতিহাসে দুই বীর শক্তির রক্ত বইছে এই মুঘল বংশে। শেষ চারটি বছর রেঙ্গুনে নির্বাসিত জীবন কাটে স¤্রাটের। এই শেষ দিনগুলো তাঁর বহু দীর্ঘ ছিল, বহু যুগের সমান ছিল। স¤্রাটের লিখিত কবিতায় তাঁর জীবনের এই করুণ পরিণতি সম্পর্কে আপেক্ষ করার কথা জানা যায়।
লেখক: