শনিবার, ১ এপ্রিল, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৮ চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ ।
শুভ্রারানী চন্দ
স্বপ্ন মানুষকে পৌঁছে দেয় সাফল্যের দোরগোড়ায়। যে মানুষের কোন স্বপ্ন নেই তার ভবিষ্যত অনিশ্চিত। মাঝিবিহীন নৌকা যেমন ¯্রােতের অনুকূলে ভাসতে ভাসতে কোথাও গিয়ে আটকে গেলে আর এগোতে পারে না। স্বপ্নবিহীন মানুষও তেমনি একটা জায়গায় পৌঁছে বিভ্রান্তির ভেতরে পড়েন, এরপরের ঠিকানা বা করণীয় নিয়ে। স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষ মাত্রই সফল মানুষ। হয়তো কখনও কখনও তার জীব্দশায় সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয় না কিন্তু যে স্বপ্নের বীজ তিনি একবার বপণ করেন তা যদি মঙ্গলকর হয় তবে তা বাস্তবায়িত হবেই। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সে স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করে। বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের। তাঁর সে স্বপ্ন শুধু সার্থকই হয়নি তা এখন শিশু চারাগাছ থেকে মহীরুহে পরিণত হচেছ দিন দিন। তেমনই এক স্বপ্ন¯্রষ্টা শোষিতের বন্ধু ফিদেল কাস্ত্রো।
প্রতিদিন পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষ জন্মগ্রহণ করেন আবার মৃত্যুবরণও করেন। দেশ, কাল, পাত্রভেদে যুগে যুগে পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ জন্মগ্রহণ করেছেন যাঁদের অবদান গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথে মানুষ স্মরণ করে কালের সীমানা পেরিয়ে, যাঁদের অমর কীর্তি মানুষকে যোগায় উৎসাহ, উদ্দীপনা প্রেরণা ও সাহস। এ পৃথিবীতে তাঁদের শারীরিক তিরোধান খুব যে শূন্যতা সৃষ্টি করে তা নয়। কারণ যে স্বপ্নের বীজ তাঁরা বুনে যান, যে সংগ্রাম, সাহস, মানবকল্যাণ ও দূরদর্শিতার স্বাক্ষর রেখে যান তাকে অবলম্বন করে একটা জাতি কিংবা দেশ শথ সহ¯্র যুগ ধরে এগিয়ে যেতে পারে দুস্তর-দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে আলোকময় সোনালী ভবিষ্যতের পথে। যে সব মানুষ নিবেদিত মানব কল্যাণে স্বয়ং ঈশ্বর তাঁদের দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করেন। সাহায্য করেন সংগ্রামী পথ পাড়ি দিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছাতে। তাঁদের কল্যাণময় শুভ কর্ম মানুষের অন্তর মন্দিরে ঠাঁই করে নেয় স্থায়ীভাবে। ঈশ্বররূপে তাঁদের স্থান হয় মানবমনের মন্দিরে। মানুষের ভেতরেই যে ¯্রষ্টার অবস্থান সে পরম সত্যিটি আমরা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারি এসব মঙ্গলময় আলোকময় মানুষের সংস্পর্শে এসে কিংবা তাঁদের জীবন সম্পর্কে কর্মকা- সম্পর্কে জেনে।
ফিদেল কাস্ত্রোর ক্ষমতা গ্রহণকে নানাভাবে দেখে বিশ্ববাসী। অনেকে মনে করেন তার শাসন ক্ষমতা গ্রহণ ছিল অগণতান্ত্রিকভাবে। তিনি ছিলেন, গণতন্ত্রের শত্রু। কিন্তু তিনি ক্ষমতায় আসীন হয়েছিলেন একজন একনায়ককে সরিয়ে যার নাম ফুলগেনসিও বাতিস্তা। কাস্ত্রোর উদ্দেশ্য ছিল একজন একনায়কের শাসন, শোষণ ও অত্যাচারের হাত থেকে কিউবার জনগণকে মুক্ত করা এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। সে দৃষ্টিকোণে কাস্ত্রো শোষিতের বন্ধু।
অবস্থানগত কারণে কিউবা ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ছিল অনেকটা ভৃত্য ও প্রভুর মতো। কাস্ত্রো যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যমুক্ত কিউবায় সে দেশের মানুষকে মুক্তির স্বাদ এনে দিয়েছিলেন। সে দেশের ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেছিলেন, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, মানুষের ন্যায্য পাওনা নিশ্চিত করেছিলেন। তার সব কাজের ভেতরেই মূল চিন্তা ছিল জনকল্যাণ। তিনি মানুষকে সম্পৃক্ত করেই কাজ করতে চেয়েছিলেন সব সময়। এ কারণেই সে দেশের জনগণ কাস্ত্রোর নেতৃত্বে বাতিস্তার পরাজয়কে সহজেই মেনে নিয়েছিল।
যে কঠিন সময়ে পুরো মহাদেশ জুড়ে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের, ধনী ও আমলারা ব্যস্ত ছিল সুযোগ-সুবিধার ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে ঠিক সেই সময়ে কাস্ত্রো ক্ষমতা দখল করেন। ফলে বিদ্রোহী শ্রেণি যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় আশ্রয় নেয় এবং সেখান থেকেই কাস্ত্রো বিরোধী কর্মকা- পরিচালনা করে। কাস্ত্রো ক্ষমতা দখল করেন ১৯৫৯ সালের ১ জানুয়ারি। বিভিন্ন সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়। তাঁর ক্ষমতা গ্রহণ করার পর কিউবা আক্রমণের চেষ্টা করা হয়। এমনকি কাস্ত্রোকে হত্যার ষড়যন্ত্রও করা হয়। কিন্তু কঠিন হাতে তিনি সাহসের সাথে সে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেন। তাঁর সব কর্মকা-ের মূল শক্তিই ছিল সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা।
কাস্ত্রোর নেতৃত্বে কিউবায় অনেকক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় রকমের সাফল্য অর্জিত হয়। সে অর্জন মোটেই কোন সহজপথে আসেনি। এজন্য কাস্ত্রোকে কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের দিক থেকে তিনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। নামমাত্র খরচে তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানে উচ্চ শিক্ষা লাভের সুযোগ করে দেন। তাঁর দেশের চিকিৎসকেরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছেন মানুষকে চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য। শুধু তাই নয় আফ্রিকার সদ্য স্বাধীন কিছু দেশে প্রতিষ্ঠিত বিপ্লবী সরকারকে উৎখাত চালানোর তৎপর প্রতিরোধ করতে কিউবার সামরিক বাহিনী সাহায্য করে। এ কারণে তিনি শুধুমাত্র কিউবা নয় পুরো ৩য় বিশ্বের শোষিত ও বঞ্চিত মানুষদের পরম আশ্রয় ও স্বপ্নদ্রষ্টা হয়ে উঠেছিলেন।
কিউবার যে সব জনগণ ফ্লোরিডায় আশ্রয় নেয় তাদের ভেতরে কাস্ত্রোর সম্পর্কে চরম ঘৃণার মনোভাব তৈরি হয় এবং যুক্তরাষ্ট্র তার মুল হোতা। যুক্তরাষ্ট্র কিউবার সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা জারী করে। এতদসত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের তরুণ শ্রেণি কিউবার চিকিৎসা বিভাগের সুযোগ নিতে আগ্রহী হয়। শুধু তাই নয় কিউবার ফ্লোরিডারের যতই ঘৃণা থাকুক না কেন, মনে মনে তারা কাস্ত্রোকে গ্রহণ করে নিয়েছিল।
মহান এ নেতা ৬৫ বছরের বেশি সময় নানাভাবে রাজনীতিতে সক্রিয় থেকে গত ২৫ নভেম্বর ২০১৬ বাংলাদেশ সময় শনিবার সকাল ৯টা ২৯ মিনিটে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। বিশ্ববাসী তাঁর মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত বিশেষ করে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো। বাংলাদেশের মানুষও তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত।
বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর চিন্তার মিল ছিল। জনগণই ছিল তাঁদের ক্ষমতার উৎস। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কাস্ত্রোর বিখ্যাত উক্তিটি অবশ্যই স্মরণীয়-আই হ্যাভ নট সিন হিমালয়েজ, বাট আই হ্যাভ সিন শেখ মুজিব।” মহান এ নেতার কর্মময় জীবন, মানুষের প্রতি তাঁর গভীর মমত্ববোধ তাঁকে সহজেই বুঝতে সাহায্য করেছে বঙ্গবন্ধুর উচ্চতাকে পরিমাপ করতে।
শোষিতের বন্ধু, বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের বন্ধু, আপোষহীন, এ নেতার আত্মার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। তাঁর আত্মার শান্তি হোক এবং আগামী পৃথিবী এগিয়ে যাক তাঁর মঙ্গলময় চেতনা ও কর্মের আদর্শে। অমর হোক তাঁর কীর্তি।