শ্যামল বাংলার রূপ বৈচিত্র্যের কবি ওমর আলী

আপডেট: ডিসেম্বর ২, ২০১৬, ১২:০৮ পূর্বাহ্ণ

মো. হামিদুল ইসলাম


ষাটের দশকের খ্যাতিমান কবি, ‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’ খ্যাত কবি ওমর আলীর জন্ম ১৯৩৯ সালের ২০ অক্টোবর পাবনা জেলার সদর উপজেলার দক্ষিণে চর শিবরামপুর গ্রামে, মাতুলালয়ে। তার বাবা মো. উজির আলী। মা আহাদি খাতুন। মা ছিলেন একজন সাধারণ গৃহবধূ। চর চাঁদপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। সেখান থেকে চলে আসেন চর ঘোষপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। আবার চলে আসেন পাবনা শহরে গোপাল চন্দ্র ইন্সটিটিউশনে। সেখান থেকে পুরনো ঢাকার সদর ঘাট এলাকার পাগোজ হাইস্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকে শেষাবধি হাম্মাদিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে এসএসসি (তখনকার প্রবেশিকা) পাস করেন। পরে ভর্তি হন ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের সোহরাওয়ার্দি কলেজে (কলেজটির পূর্বে নাম ছিলো কায়েদে আযম কলেজ)। সেখান থেকেই ১৯৬২ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। পারিবারিক আর্থিক সংকটে তিনি ঢাকা থেকে ফিরে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে বিএ পাস কোর্সে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯৬৫ সালে বি.এ পাস করেন। আবার তিনি ঢাকায় চলে যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭০ সালে ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ পাস করেন। আরও পরে ১৯৭৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাংলা সাহিত্যে এম.এ পাস করেন। ঢাকার শিক্ষা জীবনের পাশাপাশি তিনি দৈনিক সংবাদ-এ সাব এডিটর পদে চাকরি করেন।


১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ পাস করেই চলে যান বগুড়ার নন্দিগ্রাম কলেজে চাকরি করতে। ইংরেজির প্রভাষক পদে চাকরির সময়কাল ছিল সামান্য। একই বছরের সেপ্টেম্বরে তিনি কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা ডিগ্রী কলেজে ইংরেজির প্রভাষক পদে চাকরিতে যোগদান করেন। ভেড়ামারা ডিগ্রী কলেজে ছিলেন ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। দীর্ঘ আট বছর ভেড়ামারা ডিগ্রী কলেজে চাকরি করে  চলে যান পাবনা শহরে শহীদ বুলবুল কলেজে। শহীদ বুলবুল কলেজ ১৯৮৩ সালে সরকারিকরণ হলে তিনি ইংরেজির প্রভাষক হিসেবে আত্মীকৃত হন। ১৯৯২ সালে তিনি প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। কিছুকাল তিনি সিরাজগঞ্জ সরকারি ইসলামিয়া কলেজে চাকরি করেন। শেষে তিনি ১৯৯৯ সালের অক্টোবরে পাবনা সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজ থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে চাকরি থেকে অবসরে যান।
কবি ওমর আলী ছাত্রজীবনেই বিবাহ করেন। মাত্র আঠারো বৎসর বয়সে ১৯৫৬ সালে নিজ গ্রামের কাছাকাছি চরকোমরপুর গ্রামের কেরামত আলী প্রামাণিকের কন্যা সহিদা খাতুনকে বিবাহ করেন। বিবাহের পরে তিনি চর কোমরপুরে জমি কিনে বাড়ি করে বসবাস করেন। তিনি তিনপুত্র এবং চার কন্যা সন্তানের জনক। সন্তানরা যার যার মত ঘর সংসারে ব্যস্ত।
পদ্মার দক্ষিণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠি বাড়ি আর পদ্মার উত্তরে চর কোমরপুর ওমর আলীর বাড়ি। পদ্মার উত্তাল ঢেউ আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য সৃষ্টির নিদর্শন কুঠি বাড়ির আবহ ওমর আলীর মনকে দোলা দেয় বলেই হয়তো ছোট বেলা থেকেই মুখে মুখে ছড়া কবিতা আওড়াতেন। ওমর আলীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ এদেশে শ্যামল রঙ রমনীর সুনাম শুনেছি ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয়। কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের পর পাঠক মহলে প্রশংসিত হয় এবং তখনই বাংলা সাহিত্যে কাব্যটির দীর্ঘতম নামকরণের স্বীকৃতি লাভ করে। অদ্যাবধি এদেশে শ্যামল রঙ রমনীর সুনাম শুনেছি-ই হচ্ছে দীর্ঘতম বইয়ের নাম।
১৯৬৬ সালে তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ অরণ্যে একটি লোক আধুনিক কবিতায় নতুনত্বের স্বাদ আনে। এরপর তিনি আর থেমে থাকেননি। একে একে একচল্লিশটি কাব্যগ্রন্থ এবং দুটি উপন্যাস তিনি পাঠককে উপহার দেন। কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ হচ্ছে প্রস্তর যুগ তা¤্র যুগ, নিঃশব্দ বাড়ী, তেমাথার শেষে নদী, বিয়েতে অনিচ্ছুক একজন, ডাকছে সংসার, স্বদেশে ফিরছি, ছবি, লুবনা বেগম ও অন্যান্য। উপন্যাস দুটি হচ্ছে কুতুব পুরের হাসনাহেনা ও খনি ম্যানসনের মেয়ে।
বাংলাসাহিত্যে কবিতায় অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার প্রাপ্ত হন। তিনি অনেক সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তন্মধ্যে কবি বন্দে আলী মিয়া পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, আবুল মনসুর পুরস্কার, রাজশাহী গুণীজন সম্মাননা, পাবনা গুণীজন সম্মাননা ইত্যাদি।
কবি ওমর আলীর শেষ জীবন কেটেছে খুবই কষ্টে। রোগে শোকে অর্থনৈতিক কষ্টে কেটেছে শেষ জীবন। ২০১২ সালে তিনি স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। উন্নত চিকিৎসা ও নিয়মিত চিকিৎসার অভাবে ২০১৪ সালে পুনরায় প্যারালাইজড হন। সেই থেকে তিনি গ্রামের নিজ বাড়িতে বিছানাগত ছিলেন। উন্নত চিকিৎসা, নিয়মিত চিকিৎসা ও সেবাশুশ্রুষার অভাবে শেষ পর্যন্ত ২০১৫ সালের ৩ ডিসেম্বর বিকেলে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৭৬ বৎসর। পাবনার আরিফপুর কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।
তার কবিতায় বারবার উঠে এসেছে গ্রাম, নদী, গাছপালা, নারী, বধূ, কৃষাণ-কৃষাণী, মাঠ, ফসল, প্রকৃতি, স্থান ও শ্যামল বাংলার প্রকৃতির রূপ। এজন্যই কবি ওমর আলী শ্যামল বাংলার রূপ-বৈচিত্র্যের কবি হিসেবে বেঁচে থাকবেন অনাদিকাল।