মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১১ আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
রাগিব আহসান মুন্না:
গোদাগাড়ির নিমঘুটু। উত্তরের রুক্ষমাটিকে সুফলা করে তুলেছে যে কৃষি জনগোষ্ঠী তাদের গল্প উন্নয়নের বিভ্রমে ধরা পড়ে না। কিন্তু সেই রুক্ষমাটির দুঃখ নিয়ে দুই আদিবাসী সহোদর অভিনাথ আর রবি’র আত্মাহুতি বারবার মনে করিয়ে দেয় সমাজের নিম্নকোটির উপর চলমান বৈষম্য ও সহিংসতাকে। গেল ২১ মার্চ ছিল এই ভাতৃদ্বয়ের আত্মহত্যার প্রথম বছর। একে তো দ্ররিদ্র কৃষক, এমনিতেই সমাজের দুর্বল অংশের মানুষ, তার উপর আদীবাসী। পরিচয়ের প্রশ্নেও ক্ষমতাধরদের সবধরনের অত্যাচার তাদের মুখ বন্ধ করে সইতে হয়। শুধু বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য শস্য ধান। প্রায় ৫ কোটি মেট্রিকটন ধান প্রতিবছর বাংলাদেশের কৃষক উৎপাদন করে থাকে। আর এই উৎপাদনে দেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উত্তরাঞ্চলকে দেশের শস্য ভান্ডার বলা হয়ে থাকে। এই অঞ্চলের কৃষিতে ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও চাষাবাদের ক্ষেত্রে রয়েছে ব্যাপক সংকট। সংকটের উৎস পুঁজিবাদী উৎপাদন কাঠামো। বিশ্ব ব্যবস্থায় মুক্তবাজার নীতির প্রভাবে বেড়েছে কর্পোরেট ও ক্ষুদ্রঋণের নামে এনজিওদেও নতুন ধরনের দাদন-ব্যবসার আধিপত্য। কৃষির উপর থেকে অধিকার হারিয়েছে খোদকৃষক। যে কৃষকের নিজস্ব বিজতলা ছিল, সেচ সার এক সময় নিজেই নিয়ন্ত্রণ করতো তা এখন তার অধিকারে নেই। উৎপাদনের সকল উপকরণের নিয়ন্ত্রণ বড় বড় কর্পোরেটের অধীনে। এক সময় বিএডিসির মাধ্যমে রাষ্ট্র কৃষককে নানামুখি সুবিধা দিয়ে থাকতো। কর্পোরেট উত্থানের সাথে সাথে রাষ্ট্রীয় সহায়তার এই উদ্যোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে কৃষক তার স্বকীয়তা হারিয়ে রূপান্তরিত হয়ে পরিণত হয়েছে কর্পোরেট পুঁজির দাসে। কৃষক এখন কৃষি উপকরণ কিনতে একবার ঠকে, আরেকবার ঠকে বাজারে পণ্য বিক্রি করতে গিয়ে। বহুস্তরি বাজারে দালাল ফড়িয়া আর কর্পোরেটদেরই আধিপত্য।
দেশের উত্তরাঞ্চল ধান উৎপাদনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে। ধান উৎপাদনে বিখ্যাত হলেও এ অঞ্চলের কৃষক শস্য উৎপাদনে বহুবিধ সংকট সমস্যার মুখোমুখি। বিশেষ করে ফারাক্কার প্রভাবে শুকনো মৌসুমে পানি সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করে। ছোট ছোট নদী খাল বিল একেবারে শুকিয়ে যায়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। বদলে যাচ্ছে ঋতুক্রম। মরুকরণ অনুভুত হচ্ছে ক্রমান্বয়ে। এদিকে ভারত তিস্তা নদীর পানির নতুন করে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়ায় এই প্রক্রিয়া আরো ঘণীভুত হচ্ছে। ফলে দীর্ঘ মেয়াদে শুধু কৃষি নয় জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে এ অঞ্চলে এক সর্বনাসা পরিস্থিতির জন্ম দিবে।
ভূ-উপরিস্থ পানি কমে যাওয়ার এই অঞ্চলের কৃষকদের প্রতিনিয়ত ভূগর্ভের পানির উপরে নির্ভরশীলতা বাড়ছে। যা দীর্ঘ মেয়াদিতে কৃষি ব্যবস্থায় চরম বৈরি পরিস্থিতির জন্ম দিবে। ধান ছাড়াও আমাদের দেশের কৃষকরা উত্তরাঞ্চলের বেশ কিছু জায়গায় পাটের চাষ করে। বিশেষ করে নাটোর, পাবনার নিম্নাঞ্চল ও চলন বিলের দুই পাড়ে পাট চাষ হয়ে থাকে। পাট যখন পরিপক্ক হয় তখন পাট গাছ কেটে পানিতে জাগ দেওয়া হয়। এবছরে পাট চাষিদের অভিযোগ তারা পাটের জাগ দিতে পারছে না ভূ-উপরিস্থ পানির অভাবে। আবার রাজশাহীর বাগমারা, তানোর, দুর্গাপুর অঞ্চলে পানের চাষ বেশ লাভজনক। অনাবৃষ্টি, পানি ভূ-উপরিস্থ পানির অভাব এবং সেচে অনিয়মের কারণে পানের ফলন ভাল হয়নি। চাষীদের মাথায় হাত।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, বগুড়া, কুড়িগ্রাম, মিঠাপুকুর দিনাজপুর সহ উত্তরের বেশ কিছু জেলায় আম, আলু, টমেটোর ব্যাপক উৎপাদন হয়ে থাকে। সাধারণ হিমাগারে আলু রাখার ব্যবস্থা থাকলেও আম, টমেটো সংরক্ষণ করার জন্য বিশেষায়িত হিমাগার প্রয়োজন। হিমাগার নির্মাণ করলে আম, টমেটোজাত পণ্য উৎপাদন করে কৃষক বেশ লাভবান হতে পারে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে উৎপাদনে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সহায়তা করার জন্য রাষ্ট্রীয় কোনো ভূমিকা থাকেনা। কৃষক নিজ প্রচেষ্টায় ব্যাংক ঋণ নিয়ে তার সমস্যার সমাধান করে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে সে তার উৎপাদিত পণ্যের লাভজনক মূল্য পায়না। তখন তার পক্ষে সময়মত ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হয় না। সেই ক্ষেত্রে তাকে মামলা মোকাদ্দমার আইনি হয়রানিতে পড়তে হয়। অনেক সময় বিপদগ্রস্ত কৃষক এনজিওর কাছ থেকে উচ্চহারের সুদে ঋণ নিয়ে বিপদে পড়ে এবং নিঃস্ব হয়ে যায়। মুক্তবাজার নীতিতে বাজারের উপর ফড়িয়া আর সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ থাকলেও কৃষক প্রতিনিয়ত বাজারের উপরে তার অধিকার হারিয়ে চলেছে। তাই প্রয়োজন কৃষকের জন্য সমবায় ভিত্তিক বাজার ব্যবস্থা।
উত্তরাঞ্চলের কৃষি ব্যবস্থা নানামুখি সমস্যা ও সংকটে জর্জরিত। এ সত্ত্বেও নিজের প্রচেষ্টায় নানা ধরনের সমস্যাকে উপেক্ষা করে কৃষক তার উৎপাদনকে অব্যাহত রেখেছে। যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তার সুরক্ষা দিচ্ছে।
রাষ্ট্রীয় সহায়তা থাকলে উত্তরাঞ্চলের বিশাল বরেন্দ্র ভূমি হয়ে উঠতে পারে অফুরন্ত শস্য ভা-ার। সেই লক্ষ দিয়েই সত্তর দশকে উত্তরবঙ্গে রাজশাহী প্রকল্পের রূপকল্প করা হয়েছিল। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বরেন্দ্রের রুক্ষমাটি সুজলা-সুফলা ভূমিতে রূপান্তরিত হয়ে যেত। এই প্রকল্প ভূ-উপরিস্থ পানির উপর নির্ভর করে গড়ে তুলার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রস্তাবিত এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়নি।
উত্তর রাজশাহী প্রকল্প আলোর মুখ দেখলে এ অঞ্চলে ২২৮% পরিমাণ ধান বেশি উৎপাদন হতো যার পরিমাণ ২ লক্ষ ১১ হাজার মেট্রিক টন। ভূ-উপরিভাগে খাল বিল জলাধার গড়ে তোলার মাধ্যমে বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রকৃতি পরিবেশ ঠান্ডা ও মনোরম হতো। জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেত। জলবায়ু ভারসাম্য থাকতো। বৃষ্টিপাতে পরিমাণ বাড়তো। ভূগর্ভের পানি উত্তোলনের ফলে ধীরে ধীরে পানির স্তর নিচের দিকে চলে যাচ্ছে। ভূগর্ভের নানা স্তরের
বিভিন্ন ক্ষতিকারক উপাদান সেচের পানিতে মিশছে। যা শুধু খেতের জন্য ক্ষতিকারক নয়, জীববৈচিত্র্যের উপরও এর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে।
১৯৮২ সালে ইউএনডিপি উত্তরাঞ্চলে পানি ও সেচ ব্যবস্থার উপর একটি গবেষণা চালায়। এবং একটি প্রস্তাবনা প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা যাবে না। কারণ এই অঞ্চলে পুনঃভরণ প্রক্রিয়া যথেষ্ট নয়। তাই ভূ-গর্ভের পানি শুধু গৃহস্থালি কাজে ব্যবহারের জন্য উত্তোলন করা যেতে পারে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে ১৯৮৫ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি অনুসন্ধানী গবেষণা পরিচালনা করে একটি প্রতিবেদন প্রদান করে। প্রতিবেদন সুপারিশ করা হয়, হস্তচালিত গভীর নলকূপ দিয়ে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তলন করা যেতে পারে।
বরেন্দ্র সমন্বিত এলাকা উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে সোয়া দুই লক্ষ একর জমি নিয়ে গভীর নলকূপের আওতায় আনা হয়। এর মাধ্যমে ফসলের নিবিড়তা ১১৭% থেকে বেড়ে ১৭৬% উন্নীত হয়। নলকূপের সেচের এই অভিজ্ঞতা বরেন্দ্র অঞ্চলে গভীর নলকূপ স্থাপন করে সেচ ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন প্রতিবেদন অনুযায়ী চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ জেলায় মোট ১ লক্ষ ৪ হাজার ৮৫৮টি পাম্প স্থাপিত হয়। এর মধ্যে বরেন্দ্র প্রজেক্টের মাধ্যমে ৮৫১৫টি পরিচালিত হয়। বাকি ৯৬ হাজার ৩৩০টি চলে ব্যক্তি মালিকানায়। বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের আওতায় জমির পরিমাণ ২ লক্ষ ৯৫ হাজার ৭৬১ হেক্টর। আর ব্যক্তি আওতায় ২ লক্ষ ১১ হাজার ৩৮৬টি পাম্প পরিচালিত হয়।
১৯৯২ সালে বরেন্দ্র বহুমুখি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ প্রকল্প চালু করা হয়। উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলার ১১টি জেলায় এর কার্যক্রম বিস্তৃত। উত্তরাঞ্চলের বিস্তৃত এলাকায় এর কার্যক্রম থাকলেও বিশেষ করে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁতে সেচ ব্যবস্থা জোরদার করতে হয়েছে অন্যান্য এলাকার তুলনায়। এর ফলে ব্যক্তি মালিকানায় এই তিন জেলায় বেশি সংখ্যক পাম্প পরিচালিত হয়।
নওগাঁয় ব্যক্তিমালিকানায় পরিচালিত হয় ৫৩ হাজার ৯২৩টি। জেলার ৫১% সেচ ব্যক্তিমালিকানার অধীন। রাজশাহীতে ২৮৫২টি বরেন্দ্র প্রকল্পের অধীন; ব্যক্তিমালিকানায় পরিচালিত হয় ২৭,১০৫টি। চাঁপাইনবাবগঞ্জ বরেন্দ্র প্রকল্পের অধীন ১৫৮৩টি আর ব্যক্তিমালিকানায় ১৫৩১৬টি।
এই সকল ব্যক্তি মালিকানাধীন পাম্প পরিচালিত হয়, মুনাফা অর্জনের লক্ষ থেকে এতে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে উত্তর রাজশাহী সেচ প্রকল্পের পরিকল্পনা ছিল, ভূ-উপরিস্থ পানি দিয়ে সেচ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। তা বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে সেচ ব্যবস্থায় ব্যক্তিমালিকানার প্রভাব। কৃষক, কৃষি, দেশকে বাঁচাতে হলে কর্পোরেটের হাত থেকে কৃষক আর কৃষি ব্যবস্থাকে মুক্ত করতে হবে। বাজার ব্যবস্থায় কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তার জন্য দরকার কৃষকদের সম্মিলিত সংগ্রাম। পরিস্থিতি সেই দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে।
লেখক: রাজনীতিক