সংসার টেকাতেই শিশুটি চুরি করেন শুভ্রা || নবজাতকের পরিচয় নিশ্চিত হতে ডিএনএ পরীক্ষার উদ্যোগ

আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২, ২০১৭, ১২:১৯ পূর্বাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক



নগরীর নওদাপাড়া এলাকার নগর মাতৃসদন থেকে নবজাতকটি চুরির উদ্দেশ্য পুলিশের কাছে প্রকাশ করেছেন শাহিন আক্তার শুভ্রা। তিনদিনের রিমান্ডে পুলিশের কাছে তিনি স্বীকার করেছেন সংসার টেকাতেই নবজাতকটিকে তিনি চুরি করেছেন। এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহ মখদুম থানার এসআই মতিয়ার রহমানের সঙ্গে কথা বলে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। গতকাল বুধবার তিনদিনের রিমান্ড শেষে শুভ্রাকে আদালতে হাজির করা হয়। সংশ্লিষ্ট আদালত তাকে কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ দেন।
এদিকে চুরি হয়ে যাওয়া নবজাতকটির ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড (ডিএনএ) পরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ। বাবা-মায়ের ‘নির্ভুল’ পরিচয় নিশ্চিত হতে পুলিশ এই উদ্যোগ নিয়েছে। ডিএনএ পরীক্ষা করতে বুধবার দুপুরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিভাগীয় স্ক্রিনিং ল্যাবরেটরিতে ১৪ দিন বয়সি ওই বাচ্চাটিসহ তার মা-বাবা মুক্তি খাতুন (১৮) ও নাসির উদ্দিনের (২২) রক্তের নমুনা ও আঙ্গুলের ছাপ সংগ্রহ করা হয়েছে। হাসপাতালের চিকিৎসক আমেনা খাতুন তাদের এই নমুনা সংগ্রহ করেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মতিয়ার রহমান জানান, জিজ্ঞাসাবাদে শুভ্রা বাচ্চাটিকে চুরির কথা স্বীকার করেছেন। এও চুরির সঙ্গে মাতৃসদনের কর্মচারী তহুরার কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলেও জানিয়েছেন তিনি। তাই মামলার অভিযোগপত্র থেকে তহুরাকে বাদ দেয়া হবে। আর আদালতের আদেশ অনুযায়ী শুভ্রাকে আবার আদালতে তোলা হবে। তখন তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেবেন।
তিনি বলেন, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের সময় শুভ্রা প্রথমে দাবি করছিলেন-মুক্তির পরিবারের কাছ থেকে বাচ্চাটি তিনি কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশের তদন্তে তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এরপর ব্যাপক জেরার মুখে শুভ্রা জানিয়েছেন, তার পাঁচ বছরের একটি মেয়ে আছে। কিন্তু ছেলে সন্তানের জন্য স্বামীর পক্ষ থেকে প্রচ- চাপ ছিল। গত কয়েক বছরে শুভ্রা বেশ কয়েকবার গর্ভধারণ করেছিলেন। কিন্তু প্রতিবারই আল্ট্রাসনো করে দেখা যায়, শুভ্রার গর্ভে মেয়ে সন্তান। এ নিয়ে স্বামীর সঙ্গে তার দাম্পত্য কলহ দেখা দেয়। ফলে প্রতিবারই গর্ভপাত করেন শুভ্রা।
শুভ্রা পুলিশকে জানান, সর্বশেষ যখন তিনি গর্ভধারণ করেছিলেন তখনও আল্ট্রাসনো করে গর্ভে মেয়ে সন্তানের খবর জানতে পারেন। ফলে স্বামীর সঙ্গে তার দাম্পত্য কলহ চরমে পৌঁছে। এ কারণে গত আট মাস ধরে তার স্বামী বাড়িতে আসতেন না। তাই তিন মাস আগে তিনি আবার গর্ভপাত ঘটান। কিন্তু স্বামীর কাছে তিনি বিষয়টি গোপন রাখেন। এরপর তিনি একটি ছেলে সন্তান চুরির পরিকল্পনা করেন। দীর্ঘ প্রস্তুতির পর মুক্তির বাচ্চা চুরির পর শুভ্রা তার স্বামীকে জানিয়েছিলেন, তিনি একটি ছেলে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। এভাবে তিনি তার সংসার রক্ষার চেষ্টা করেছিলেন।
অপরদিকে ডিএনএ পরীক্ষা করতে গতকাল দুপুরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিভাগীয় স্ক্রিনিং ল্যাবরেটরিতে ১৪ দিন বয়সি ওই বাচ্চাটিসহ তার মা-বাবা মুক্তি খাতুন (১৮) ও নাসির উদ্দিনের (২২) রক্তের নমুনা ও আঙ্গুলের ছাপ সংগ্রহ করা হয়েছে। হাসপাতালের চিকিৎসক আমেনা খাতুন তাদের এই নমুনা সংগ্রহ করেন।
হাসপাতালে তাদের সঙ্গে মুক্তির বাবা মুক্তার আলী, মামা শহিদুল ইসলাম ও বাচ্চা চুরির ওই মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মতিয়ার রহমানও এসেছিলেন। ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে এসআই মতিয়ার বলেন, ‘আমরা প্রায় নিশ্চিত হয়েছি-বাচ্চাটি মুক্তি খাতুনেরই। তারপরেও কোনো ধরনের বিতর্ক যেন না থাকে সে জন্য ডিএনএ পরীক্ষা করা হচ্ছে।’
তিনি জানান, রামেক হাসপাতালের এই ল্যাবরেটরি থেকে নমুনা ঢাকার মালিবাগে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রধান ডিএনএ পরীক্ষাগারে পাঠানো হবে। সেখান থেকেই প্রতিবেদন আসবে।
প্রসঙ্গত, গত ১৯ জানুয়ারি নওদাপাড়া এলাকার নগর মাতৃসদনে পবা উপজেলার চর শ্যামপুর এলাকার দিনমজুর নাসির উদ্দিনের স্ত্রী মুক্তি খাতুন একটি ছেলে সন্তানের জন্ম দেন। জন্মের ছয় ঘণ্টা পর নবজাতকটি চুরি হয়ে যায়। এ ঘটনায় মুক্তির মা রোজিনা বেগম থানায় একটি মামলা করেন।
মামলার পর পুলিশ নগরীর ডাশমারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মাঠকর্মী তহুরা বেগমকে (৩০) গ্রেফতার  করে। পরে তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু বাচ্চা উদ্ধারের কোনো কিনারা করতে পারছিল না পুলিশ। এরপর গত ২৭ জানুয়ারি নগরীর টিকাপাড়া বাসার রোড এলাকার একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে ডিবি পুলিশ নবজাতকটিকে উদ্ধার করে।
এ সময় শাহিন আক্তার ওরফে সুভ্রা (৩২) নামে এক নারীকে গ্রেফতার করা হয়। শুভ্রা জেলার বাগমারা উপজেলার মান্দিয়াল গ্রামের এরশাদ আলীর মেয়ে। তার স্বামী ডা. আক্তারুজ্জামান রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে কর্মরত। আর শুভ্রা নর্থবেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির নগরীর আলুপট্টি ক্যাম্পাসের সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ছিলেন। বাচ্চা চুরির অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়ার পরদিন কর্তৃপক্ষ তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে।
ভুক্তভোগি পরিবারটির বক্তব্য, গর্ভকালীন সময় মুক্তি মাঠকর্মী তহুরার কাছ থেকে বিভিন্ন পরামর্শ নিতেন। তহুরার সঙ্গে এই শুভ্রা তাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন। শুভ্রা তাদের বলেছিলেন, তিনি এনজিওর কর্মী। গর্ভবতী মায়েদের তিনি সহায়তা করে থাকেন। গত ১৯ জানুয়ারি মুক্তিকে শুভ্রা ও তহুরাই মাতৃসদনে ভর্তি করেছিলেন। কিন্তু জন্মের পর রাতে বাচ্চাটিকে কৌশলে চুরি করে নিয়ে যান সুভ্রা।
এদিকে রক্তের নমুনা দিয়ে ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে মুক্তি খাতুন জানিয়েছেন, ডিএনএ পরীক্ষায় প্রমাণিত হবে বাচ্চাটি নিজের-এ ব্যাপারে তিনি শতভাগ আশাবাদী। বাচ্চাটির এখনও কোনো নাম রাখা হয়নি। তাই রক্তের নমুনা রাখার টেস্টটিউবের গায়ে লিখে রাখা হলো ‘বাবু’।
মুক্তি বলেন, ‘এটি কোনো নাম নয়। পুলিশ ও আপনারা সাংবাদিকদের সহযোগিতায় বাচ্চাটি উদ্ধার হয়েছে। আপনাদের ছাড়া নাম রাখি কী করে! কয়েকদিন পর আকিকা দিব। আমার গরিবের সংসারে দুটো ডাল-ভাতেরও ব্যবস্থা করবো। ওই দিন সবাইকে নিয়েই আমার বুকের ধনের নাম রাখবো।’