নিজস্ব প্রতিবেদক:
কাঠের আসবাবপত্র ও পিতল বার্নিশ, স্বর্ণালংকার ছাড়াও ওষুধের ক্যাপসুলের কোটিংয়ের কাজে ব্যবহার হয় লাক্ষা।
সেই লাক্ষা শিল্প এখন ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। ফলে হারাতে বসেছে এই অর্থকরি লাক্ষার শিল্প-সম্ভাবনা। একসময় রাজশাহীর গোদাগাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর, শিবগঞ্জ, নাচোল ও রহনপুরের বিশাল এলাকাজুড়ে চাষ হতো লাক্ষার। দাম না পাওয়া সহ বিভিন্ন কারণে ওই সব এলাকা থেকে লাক্ষার অস্তিত্ব বিলীন হয়েছে- শুধু মাত্র রহনপুরের কিছু এলাকায় এর চাষ হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের লাক্ষা গবেষণা কেন্দ্রে সূত্রে জানা গেছে, দেশে প্রতিবছর লাক্ষার চাহিদা ১০ হাজার টন। কিন্তু উৎপাদন হয় প্রায় ১৫০ টন। এমন অবস্থায় দেশের বাজার নির্ভরশীল ভারতীয় লাক্ষার উপরে। তার উপরে যে লাক্ষা উৎপাদন হয় তাতে দাম না পাওয়ায় কৃষক আগ্রহ হারাচ্ছে।
বিশে^ দুই ধারনের লাক্ষার চাষ হয়। একটি কুসুমি ও অপরটি রঙ্গিনী। বাংলাদেশে রঙ্গিনী লাক্ষার চাষ হয়। আর প্রতিবেশি দেশ ভারতে কুসুমি লাক্ষার। তবে তুলনামূলক দেশি লাক্ষার মান ভালো। বিশে^ মোট চারটি দেশে এই লাক্ষার চাষ হয়। এরমধ্যে ভারতে সবেচেয়ে বেশি, ৭৫ শতাংশ। ভারতের উৎপাদিত লাক্ষা সারাবিশে^ চলে। লাক্ষা উৎপাদনে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে থাইল্যান্ড। এই দেশে মাত্র ১০ শতাংশ লাক্ষা উৎপাদন হয়। তৃতীয়তে রয়েছে বাংলাদেশ ও চীন। তবে সারাবিশে^র লাক্ষার বাজার নিয়ন্ত্রণ করে ভারত।
তবে চাষি ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, চাহিদার কথা মাথায় রেখে লাক্ষার চাষে সরকারিভাবে সহায়তা চান তারা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই অর্থকরি ফসলের চাষে ঝুঁকবে চাষিরা। দেশে লাক্ষার দাম পায় না তারা। এছাড়া ভারতীয় লাক্ষার প্রভাব রয়েছে দেশের বাজারে। দেশি লাক্ষার গুণগত মান ভালো হলেও দামের কাছে পাত্তা পাচ্ছে না দেশের লাক্ষা।
লাক্ষা গবেষকরা বলছেন, দেশে যে পরিমাণ বরই গাছ আছে, তা পরিকল্পনা করে লাক্ষা চাষের আওতায় আনা গেলে স্বনির্ভর হয়ে বিদেশে রপ্তানিও করা সম্ভব। লাক্ষা এক ধরনের ক্ষুদ্র পোকা। এ পোকার ত্বকের নিচে সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা এক প্রকার গ্রন্থি থেকে আঠালো রস নিঃসৃত হয়, যা ক্রমশ শক্ত ও পুরু হয়ে পোষক গাছের ডালকে আচ্ছাদিত করে ফেলে। পোষক (গাছের উপরের আবরণ বা বাকল) গাছের ডালের এই আবরণই লাক্ষা বা লাহা নামে পরিচিত। পরবর্তীতে ডালের ওই শক্ত আবরণ ছাড়িয়ে ও শোধিত করে তা বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়। দুই ধরনের লাক্ষাপোকা থেকে লাক্ষা উৎপাদন করা যায়। মূলত বরই, পলাশ, বাবলা- এ ধরনের পোষক গাছ থেকে লাক্ষা উৎপাদন করা সম্ভব।
লাক্ষা যে কাজে লাগে
লাক্ষা প্রক্রিয়াজাত করে চাঁচ, টিকিয়া ও গালা তৈরি করা হয় এবং প্রায় একশো কেজি ছাড়ানো লাক্ষা থেকে ৫০ থেকে ৬০ কেজি চাঁচ বা গালা পাওয়া সম্ভব। এগুলো রাজশাহীর ভদ্রা, নাদের হাজির মোড় ও মুরশইল এলাকা ছাড়াও বগুড়ায় একটি চাঁচ কারখানায় লাক্ষা সরবরাহ করেন চাষিরা। প্রসেস ছাড়া দিলে ৪ থেকে ৫শো টাকা কেজি আর প্রসেস করে দিলে ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকা কেজি। প্রসেসিঙের পরে লাক্ষা কাজে লাগে কাঠের আসবাবপত্র ও পিতল বার্নিশ করতে, স্বর্ণালংকারের ফাঁপা অংশ পূরণ করতে, ওষুধের ক্যাপসুলের কোটিং, চকলেট ও চুইংগামের কোটিং, ডাকঘরের চিঠি বা পার্সেল সিলমোহরের কাজে, লবণাক্ত পানি থেকে জাহাজের তলদেশ রক্ষা বা লবণাক্ততায় নষ্ট হওয়া লৌহ ঠিক করার কাজে, অস্ত্র ও রেল কারখানার কাজে, পুতুল, খেলনা ও টিস্যু পেপার তৈরির কাজে।
নাচোলের লাক্ষা চাষি মেরাজ আলী বলেন, লাক্ষা সাধারণত বৈশাখ ও কার্তিক মাসে তারা চাষের প্রক্রিয়া শুরু করেন। এই লাক্ষাগুলো বগুড়ায় সরবরাহ করা হয়। তিনি নিজে বগুড়ায় চাঁচ তৈরির কারখানা এবং বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানিতে লাক্ষা সরবরাহ করেন। পোকার জন্য নির্ধারিত সময়ে গাছ ছাঁটাই করেন কৃষকরা। পরে গাছের ডালে লাক্ষা পোকাসহ খণ্ড খণ্ড পোষক গাছের ডাল, ছাঁটাই হওয়া গাছের সঙ্গে আটকে দেয়া হয়। রোদ পেলে কয়েকদিনের মধ্যেই পোকা ডালে বসে যেতে পারে এবং এর প্রায় চার সপ্তাহ পর ডালগুলো সাদা তুলার মতো আবরণে ঢেকে যায়। পরে ঝাঁক বেধে পোকা বের হতে দেখা যায়।
তিনি আরো বলেন, লাক্ষা চাষে কোনো খরচ নেই। শুধু বৈশাখ মাসে লাক্ষায় একবার পানি দিতে হয়। এর বাইরে কোনো খরচ নেই। লাক্ষা পোকা রস খায় আর শরীর থেকে রস বের করে। তার পুরো শরীর রসে আবৃত হয়। এরপর বাতাসের সংস্পর্শ পেয়ে শক্ত আবরণ তৈরি হয়। ওই প্রাকৃতিক আবরণের মধ্যেই পোকাটা থাকে। এই পোকার আকৃতি অনেকটা উকুনের মতো এবং এগুলো খুব ঘন ঘন হয়ে বসে।
নাচোলের কন্যানগর এলাকার লাক্ষা ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন বলেন, বর্তমানে লাক্ষা প্রতিমণ ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা। এই লাক্ষা আবার সাড়ে ৪১ কেজিতে মণ। লাক্ষা থেকে তৈরি হওয়া চাঁচ ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা কেজি। তবে বাংলাদেশের লাক্ষা থেকে তৈরি করা গালা ও চাঁচের মান ভারতের থেকে কম। তবে ২ বছর থেকে ভারত থেকে লাক্ষার আমদানি বন্ধ রয়েছে। তাই বাজারে লাক্ষা থেকে তৈরি পণ্যের দাম ভালো। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে সুদিন ফিরবে লাক্ষায় ।
রাজশাহী নগরীর সাহেববাজার এলাকায় কাঠের বার্নিশ মিস্ত্রির কাজ করেন হৃদয় হোসেন। তিনি বলেন, তাদের দোকানে প্রতি মাসে আড়াই থেকে তিন কেজি চাঁচ লাগে। দেড় মাস আগে তুলনামূলক অনেক দাম ছিল। এখন কিছুটা কম। বাজারে ভারতীয় চাঁচ পাওয়া যায়। তবে তার দাম বেশি। সেই তুলনায় বাংলাদেশি চাঁচের দাম কম। আমাদের দোকানে দেশের চাঁচ ব্যবহার করি।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মোজদার হোসেন জানান, ‘লাক্ষার সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে গেছে। বরই, বাবলা ও কড়াই গাছ কমেছে। ফলে লাক্ষার চাষ কমে গেছে। লাক্ষা নিয়ে শুধু গবেষণা হয়, কোনো আউটপুট নেই।’ রাজশাহী গোদাগাড়ী উপজেলায় লাক্ষা চাষ প্রকল্পের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জের লাক্ষা গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. মোখলেসুর রহমান জানান, শুধু নাচোলের কাজলাগ্রামে এই লাক্ষা চাষ হয়। এই অঞ্চলে ১ লাখ বরই গাছ লাক্ষা চাষের উপযোগী। এতে ৫০০ মেট্রিটক টনের বেশি লাক্ষা উৎপাদন করা সম্ভব। দিনে দিনে লাক্ষার চাষী কমে যাচ্ছে। এখন আমবাগান অনেক বেশি। তারা কীটনাশক স্প্রে করে। অনেকে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ডোজ দেয়। এগুলো এভাবে স্প্রে করার কারণে আশে পাশের গাছেও লাক্ষা পোকা টিকতে পারে না। তবে এটি সম্ভাবনাময় ফসল। আমরাও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি চাষ বৃদ্ধিতে।