সতীর্থ’৭৪ কে যেমন দেখেছি

আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১৭, ১২:৪৪ পূর্বাহ্ণ

কানিজ ফাতেমা মিতু


পৃথিবীর প্রায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন ছাত্র/ছাত্রীরা অনেকটা নিজেদের আত্মিক টানে অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন কিংবা প্রাক্তন ছাত্র/ছাত্রী সমিতি গঠন করে থাকেন। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। বিশেষতঃ প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের সংগঠন বা সমিতির দিক থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (ইটঊঞ) এর শ্রেণি বা বছর ভিত্তিক সংগঠন গড়ে উঠেছে। কেউ কেউ বা আবার তাদের সংগঠনকে সমিতি না বলে ঈষঁন বলে থাকে। সাধারণতঃ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এটি বেশি ঘটে থাকলেও স্কুল ভিত্তিক শক্তিশালী সংগঠন তৈরি বা কার্যক্রম তেমন চোখে পড়ে না। অবশ্য এদিক দিয়ে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ এর প্রাক্তন ছাত্র সমিতির নাম ঙজঈঅ যা বাংলাদেশের গ-ি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মহলেও খ্যাতি অর্জন করতে সমর্থ লাভ করেছে।
তবে কোন একটা স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রদের মধ্যে কেবল মাত্র একটি ব্যাচ যে সুশৃঙ্খল ও সাংগঠনিকভাবে সামাজিক ও মানবিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে সেটা ‘সতীর্থ৭৪’ এর কর্মকা- না দেখলে বোঝা যাবে না। বাংলাদেশের সর্বপ্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল। এই স্কুলটি বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরাতন বিদ্যালয় যার শুরু হয়েছিলো সেই ব্রিটিশ আমলে ১৮২৮ সালে। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পদ্মানদীর ধার ঘেঁষে যে স্কুলটি আজ থেকে ১৮৯ বছর আগে যাত্রা শুরু করেছিলো। তা একদিকে ঐতিহাসিক অন্যদিকে ঐতিহ্যম-িত। এই স্কুলের ১৯৭৪ এসএসসি ব্যাচের প্রাক্তন ছাত্ররা তাদের প্রাণের তাগিদে “আয় আরেকটি বার আয়রে সখা প্রাণের মাঝে আয়” চেতনায় উদ্বদ্ধু হয়ে একটি সংগঠনে সমবেত হয়েছেন। পাঠকবৃন্দ হয়তো খটকা লাগতে পারে আমিতো কখনো ওই স্কুলের ছাত্র ছিলাম না। প্রকৃতিগত কারণে আমি ছাত্রী (নারী) হবার ফলে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র হবার কোন সুযোগ ছিলো না বা নেই।
সতীর্থ’৭৪ এর প্রতিষ্ঠাতা বা বতর্মান সভাপতি প্রকৌশলী একেএম খাদেমুল ইসলাম ফিকসন এর সাথে সুদীর্ঘ ৩০ বছর ধরে সংসার করার সুবাদে আমিও আত্মিকভাবে এই সতীর্থ’৭৪ এর একজন গুণগ্রাহী ও শুভাকাক্সক্ষী হিসেবে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে সম্পৃক্ত করতে পেরেছি বলেই এই সংগঠনকে নিয়ে দু’টি কথার অবতারণা করছি। বিবাহের সূত্র ধরেই আমার স্বামীর সহপাঠীদের অনেক আগে থেকেই চিনতাম। বিশেষতঃ আখতার আজীম ফারুকী, স্বপন ভাই ও এনামুল হক রবু কে ঢাকায় বসবাসের সুবাদে চেনা জানা ছিলো। এর পরে ২০০৩ সাল থেকে যখন স্থায়ীভাবে রাজশাহীতে বসবাস শুরু করলাম তখন অনেক বন্ধুকেই চেনা ও জানার সুযোগ ঘটেছিলো। বিশেষতঃ সাদেকুল ইসলাম মিঠু ভাই ও আমিনুল ভাইকে একই এলাকায় অবস্থানের কারণে চেনার সুযোগ ঘটেছিলো। আরো পরে পারিবারিকভাবে কাছ থেকে চেনা ও জানার সুযোগ হয়েছিলো জগলু ভাইকে। নিয়মিত ভাবেই জগলু ভায়ের সাথে সাহেববাজার গণকপাড়ায় দেখা হতো। যারা এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
খুব বেশিদিনের কথা নয়, ২০১২ সালের ১৩ এপ্রিল রাজশাহী উপশহরে ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন মিলনায়তনে সতীর্থ’৭৪ এর এক বিস্ময়কর ও স্মৃতিময় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। ওই অনুষ্ঠানের পর আমার স্বামীর খুব কাছের বন্ধু মনিরুল ইসলাম নাজমুল (সাবেক উপসচিব) এবং বোরহান উদ্দিন বুড়ন ভাই আকস্মিকভাবে চলে গেলেন। আরো চলে গেছেন ইনজারুল মজিদ ভাই, চৌধুরী হাসান আলী সন্টু ভাই।
রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের ১৯৭৪ ব্যাচের ছাত্ররা ২০১৪ সালে তাদের এসএসসি পাশের ৪ দশক বা ৪০ বছর পূর্তি উৎসব পালন করেছে। একই সাথে বন্ধুদের মধ্যে যাদের সন্তান-সন্ততিরা বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে তাদের সংবর্ধনা প্রদান করেছে।
সতীর্থ’৭৪ এর শুরুটা ছিলো প্রয়াত বন্ধু সাদেকুল ইসলাম মিঠুর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। আমার স্বামী ছাড়াও স্বপন ভায়ের খুব কাছের ছিলো এই মিঠু ভাই। তিনি যখন মারা গেলেন তখন দুটি নাবালক পুত্র ও স্ত্রী অকুল পাথারে পড়ে গেলো। আর প্রয়াত মিঠুর পরিবারকে ঠিক কিভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে তাদের সংসারকে বাঁচানো যায় এমন ভাবনাই ছিলো স্বপন ভায়ের। আর তাঁর সাথে আরো ক’জন এগিয়ে এসেছিল।
এর পর পর যখন আমিনুল ভাই হঠাৎ করেই মারা গেলেন সত্যি কথা বলতে কি তখন থেকেই ১৯৭৪ ব্যাচকে সাংগঠনিকভাবে রূপ দেবার প্রচেষ্টা শুরু হয়। আর পুরো প্রক্রিয়াটাই হয়েছিলো আমাদের বাড়ির ড্রইং রুমে। একারণেই অনেকটা শুরু থেকেই আমিও সতীর্থ৭৪ এর সকল মানবিক ও সামাজিক কর্মকা-ের সাথে জড়িত থেকেছি।
সতীর্থ’৭৪ এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো “সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকের তরে প্রত্যেকে” জাতীয় এক মানবিক দৃষ্টি ভঙ্গি। শুরু থেকেই দেখেছি একজনের বিপদ-আপদ হলে সকলেই ঐকান্তিকভাবে সেই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে ঝাঁপিয়ে পড়া। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এধরনের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের সমিতি বা সংগঠন আছে কিন্তু একমাত্র পুনর্মিলনী কিংবা বার্ষিক বনভোজন জাতীয় কর্মকা-ের মধ্যেই সেটা সীমিত থাকে। সতীর্থ’৭৪ এর প্রাক্তন সম্পাদক মির্জা পটুর অসুস্থতার সময় সকল প্রকার সাহায্য ও সহযোগিতা করা হয়েছে। এমনকি ব্যবসায় উন্নতি কিংবা ব্যবসায় প্রসার ঘটানোর জন্য সতীর্থ’৭৪ এর সদস্যদের মাঝে বিনা সুদে অর্থ প্রদান করা হয়। এটি সামাজিক মূল্যবোধ থেকেই তৈরি হয়েছে। আবার সতীর্থ’৭৪ এর এক সদস্যের কন্যার থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত হওয়ায় প্রতিমাসে তার চিকিৎসা সেবার ব্যয়ভার বহন করছে এই সংগঠনটি। শুধু তাই নয়, ওই কন্যার অপারেশন এর যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করেছে সতীর্থ’৭৪।
খুব বেশি দিনের কথা নয় আবার সময়টাও একেবারে কম নয়। দেখতে দেখতে সতীর্থ’৭৪ প্রায় ৮ বছর অতিক্রান্ত করেছে। এই সংগঠনের অন্যতম দিক হলো সতীর্থ বন্ধুদের সাথে সহযোগিতা আর আন্তরিকতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিমাসে একবার সবাই মিলে মাসিক সভায় মিলিত হতে তাদের নিজেদের ভেতরে সুখ সুঃখ কিংবা অভাব অভিযোগ নিয়ে আলাপ আলোচনা করে থাকেÑ আর সে সভাটি হয়ে থাকে প্রতিমাসের শেষ শুক্রবার বিকেলে তাঁদের প্রাণপ্রিয় বিদ্যাঙ্গন রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল চত্ত্বরে। এ বিষয়টি যেহেতু সকলের জানা থাকে তাই নতুন করে কাউকে নোটিশ দিতে হয় না। সবাই মনের টানে পুরানো বন্ধুদের সাথে সাক্ষাত করার অনেকটা লোভে একে একে জড়ো হয়। এ ছাড়াও বিভিন্ন জাতীয় দিবসগুলো একত্রে পালন করে এসেছে এই সংগঠনটি। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস (২১ ফেব্রুয়ারি) মহান বিজয় ও স্বাধীনতা দিবস সহ নববর্ষ ১লা বৈশাখ। পাশাপাশি প্রতি বছরের শুরুতে একটা বনভোজন বা ফ্যামিলি ডে আয়োজন করা হয়।
নানাবিধ সামাজিক ও মানবিক কর্মকা- করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে যে সংগঠন টি ২০০৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করেছিলো সময়ের বিবর্তনে, আজ তা ৮ বছর অতিক্রম করছে। বাংলাদেশে অথবা বিদেশে অবস্থানকারী পুরানো বন্ধুদের নিয়ে একটি সংগঠন করে তা দীর্ঘ সময় ধরে টিকে থাকার ঘটনাটি সত্যি বিরল।
যদিও একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর এই সংগঠনটির অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যাবে না প্রাকৃতিক নিয়মে। তবুও সতীর্থ’৭৪ এর সকল কর্মকা- ইতিহাসে একটু ঠাই করে নিতে পেরেছে বলে আমার ধারণা। আমার মনে হয় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অষষঁসহধর অংংড়পরধঃরড়হ এর পাশাপশি ব্যাচভিত্তিক এরকম সংগঠন গঠন করা উচিত যাতে করে দীর্ঘ সময়ের সহযাত্রী ও সহপাঠীদের কেউ ভুলে না যায়। স্মৃতির আড়ালে হারিয়ে না যায়। হোক না সে দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কোন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব কিংবা হোক সে ফুটপাথের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কিন্তু যখন সকলের পরিচয় একটাই যে সে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের ১৯৭৪ ব্যাচের প্রাক্তন ছাত্র তখন আর কোন ভেদাভেদ থাকে না। আর এখানেই সতীর্থ’৭৪ সৃষ্টির সফলতা।
পুনশ্চঃ হৃদয় বিদারক
গত কোরবানী ঈদের তিনদিন পর হঠাৎ করে চলে গেলো এই সংগঠনের সবচেয়ে প্রানবন্ত আর উচ্ছ্বল হাসিখুশির মানুষটি বন্ধুরা কেউ টেরই পেল না তাদের খুব কাছের আমিনুল হক আমিন চলে যাবে। মৃত্যুর সময় তাঁর আপনজন স্ত্রী পুত্র কন্যারা কেউ কাছে ছিল না। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ ওয়ার্ডে উপস্থিত ছিলো কেবল সতীর্থ বন্ধুরা। অনেক চেষ্টা করেও আমিন ভাইকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। আমিন ভাবীর কাছ থেকে শোনা- তিনি (আমিন) নাকি সবসময় বলতেন ‘আমি মারা গেলে আমার সতীর্থ’৭৪ এর বন্ধুরাই সর্বাগ্রে এগিয়ে আসবে, ওরাই আমার কাছে থাকবে’- সেটাই অমোঘ সত্য হলো কিন্তু ততদিনে আমিন ভাই চলে গেছে… যেখান থেকে কেউ আর ফিরে আসেনা…
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগ, রাজশাহী মহানগর।