বৃহস্পতিবার, ৮ জুন, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ২৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
সোনার দেশ ডেস্ক
নতুন নির্বাচন কমিশন কীভাবে গঠিত হবে, সেই কমিশনের অধীনে কীভাবে আগামী নির্বাচন হবে- সে বিষয়ে বিএনপির ১৩ দফা প্রস্তাব তুলে ধরেছেন দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
তিনি বলেছেন, এই কমিশন হতে হবে ‘সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল, অথবা স্বাধীনতার পর প্রথম জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছে এমন সকল রাজনৈতিক দলের’ মতৈক্যের ভিত্তিতে।
১৩ দফা প্রস্তাবে নির্বাচন কমিশন নিয়োগে বাছাই কমিটি গঠনের একটি রূপরেখা, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের যোগ্যতা এবং ‘সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের কয়েকটি ধারা সংশোধনের কথা বলেছেন খালেদা জিয়া।
বিএনপির ভাষায় ‘সরকারের আজ্ঞাবহ’ কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের মেয়াদপূর্তি সামনে রেখে শুক্রবার গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলে সংবাদ সম্মেলন করে খালেদা এসব প্রস্তাব উপস্থাপন করেন।
নির্দলীয় সরকারের অধীনে ভোটের দাবিতে দশম জাতীয় নির্বাচন বর্জন করে সংসদের বাইরে থাকা বিএনপিনেত্রী পৌনে এক ঘণ্টার বক্তৃতায় ‘তত্ত্বাবধায়ক’ শব্দটি উচ্চারণ করেননি। তার বদলে তিনি একটি ‘নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের’ অধীনে একাদশ জাতীয় নির্বাচন চেয়েছেন এবং ‘যথাসময়ে’ সেই সরকারের রূপরেখা প্রস্তাব করবেন বলে জানিয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে খালেদা বলেন, গত দুটি জাতীয় নির্বাচন এবং গত কয়েক বছরে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের ‘প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা ও পক্ষপাতমূলক আচরণ’ জনগণকে ‘হতাশ, আস্থাহীন ও ক্ষুব্ধ’ করে তুলেছে। তার ভাষায়, জনগণ ‘অবাধ, সষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক’ এমন একটি নির্বাচন চায়, যেখানে তারা ‘নির্বিঘেœ’ ভোট দিতে পারবেন এবং তার ফলাফল ‘কেউ বদলে দিতে পারবে না’।
“বর্তমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একটি স্থায়ী ব্যবস্থা প্রণয়ন বাঞ্ছনীয়,” বলেন খালেদা।
২০১২ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ‘সার্চ কমিটির’ মাধ্যমে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠন করে দিয়েছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান।
আগামী ফেব্রুয়ারিতে বর্তমান কমিশনের মেয়াদ শেষে নতুন যে ইসি দায়িত্ব নেবে, তার অধীনেই ২০১৯ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচন হবে।
আগেরবারের মত এবারও ‘সার্চ কমিটি’ করে রাষ্ট্রপতি নতুন কমিশন নিয়োগ দেবেন বলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ইতোমধ্যে জানিয়েছেন।
কাজী রকিব নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশনের অধীনে অধিকাংশ নির্বাচনেই অংশ নেয়নি বিএনপি। দলটি সব রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে নতুন ইসি গঠনের দাবি জানিয়ে আসছে।
সংবাদ সম্মেলনেও খালেদা জিয়া বলেন, “অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একটি নিরপেক্ষ, সৎ, সাহসী, দক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করার কোনো বিকল্প নেই।… সকল রাজনৈতিক দলের ঐক্যমত্য নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে।”
রাষ্ট্রপতির নির্বাচন কমিশন ‘গঠন প্রক্রিয়ায় এবং পদ্ধতি নিরূপণে’ সব রাজনৈতিক দলকে চেয়েছেন নিবন্ধন হারানো জামায়াতে ইসলামীর জোটসঙ্গী বিএনপি চেয়ারপারসন।
তিনি বার বার জোর দিয়েছেন, ‘সকল নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল অথবা স্বাধীনতার পর প্রথম জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছে এমন সকল রাজনৈতিক দলকে’ ইসি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে হবে।
>> বিএনপির প্রস্তাব, ইসি নিয়োগ প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি’ ঠিক করতে সব দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি আলাদাভাবে বসবেন।
>> দেশের ‘প্রধান দুই রাজনৈতিক জোট’ বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের পক্ষ থেকে একজন করে মূল প্রতিনিধি এবং তাকে সহায়তা করতে আরও দুজন করে প্রতিনিধি ওই বৈঠকে থাকতে পারবেন।
>> রাষ্ট্রপতি নাগরিক সমাজের মধ্য থেকে ‘সৎ, যোগ্য ও দল নিরপেক্ষ প্রতিনিধিদের’ আলোচনায় যুক্ত করতে পারবেন।
>> প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য নির্বাচন কমিশনারদের যোগ্যতা-অযোগ্যতা ও মনোনয়নের প্রশ্নে ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত এই আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে।
>> এসব বৈঠকের কার্যবিবরণী ও সিদ্ধান্ত দলগুলোর প্রতিনিধিদের সইসহ জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে।
>> রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকে সব দল পাঁচ সদস্েযর বাছাই কমিটি গঠনের জন্য প্রতি পদের বিপরীতে দুই জনের নাম প্রস্তাব করবে। সেখান থেকে ‘সর্বজন শ্রদ্ধেয়, সৎ, নিরপেক্ষ, অভিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ এবং নৈতিকতা ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন’ ব্যক্তিদের নিয়ে সব দলের মতৈক্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি পাঁচ সদস্েযর বাছাই কমিটি গঠন করবেন।
>> এর প্রধান হবেন একজন অবসরপ্রাপ্ত সাবেক প্রধান বিচারপতি। সদস্য থাকবেন আপিল বিভাগের একজন সাবেক বিচারক, একজন সাবেক সচিব, একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এবং একজন নারী। তাদের সবাইকে ‘দল নিরপেক্ষ’ হতে হবে, বিতর্ক থাকলে চলবে না, অবসরের পর সরকারের লাভজনক পদে দায়িত্ব পালন করেছেন এমন ব্যক্তিদেরও নেয়া যাবে না।
>> পাঁচ সদস্েযর নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য প্রত্যেক দল প্রতি পদের বিপরীতে দুই জনের নাম প্রস্তাব করবে। বাছাই কমিটি সেখান থেকে সিইসি পদের জন দুটি এবং চারটি কমিশনার পদের জন্য আটটি নাম বাছাই করবে।
>> বাছাই কমিটির তালিকা থেকে রাষ্ট্রপতি পাঁচজনকে নিয়ে নতুন কমিশন গঠন করবেন। চূড়ান্তভাবে মনোনীতদের জীবনবৃত্তান্ত ও সম্পদের বিবরণী জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে।
নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে খালেদা জিয়া গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের পাঁচটি ধারা সংশোধনের প্রস্তাব করেছেন। এর মধ্যে ভোটের নিরাপত্তায় প্রতিরক্ষা বাহিনীকেও যুক্ত করার দাবি রয়েছে, যাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা থাকবে।
এছাড়া বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব সচিবালয় গঠন, কমিশনের নিরপেক্ষতা ও আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, ‘রাজনৈতিক মতাবলম্বী’ কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে দূরে রাখা, নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণার পর থেকে নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ পর্য়ন্ত সরকারের স্বরাষ্ট্র, অর্থ, তথ্য, জনপ্রশাসন, স্থানীয় সরকার, শিক্ষা, প্রাথমিক শিক্ষা, পররাষ্ট্র, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় নির্বাচন কমিশনের অধীনে রাখা, নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণে ব্যবস্থা করার সুপারিশ এসেছে খালেদার প্রস্তাবে।
খালেদার ১৩ দফায় ভোটকেন্দ্রের পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে কয়েকটি প্রস্তাব রয়েছে। পাশাপাশি ভোটার তালিকা হালনাগাদে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, কারাবন্দি ও নানা মামলায় যুক্ত ব্যক্তিদের ভোটার করা, নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনঃনির্ধারণ এবং দেশ-বিদেশি পর্যবেক্ষক নিয়োগের বিষয়েও কিছু সুপারিশ এসেছে।
সংবাদ সম্মেলনে শেষ পর্যায়ে তিনি বলেন, “নির্বাচন কমিশন যাতে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন জাতিকে উপহার দিতে পারে, সেই উদ্দেশ্েযই একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের প্রয়োজন। আমরা নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা ভবিষ্যতে যথাসময়ে জাতির সমীপে উপস্থাপন করব।”
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, শ্রীলঙ্কাসহ কয়েকটি দেশের কূটনীতিকরা সংবাদ সম্মেলনে অতিথির আসনে উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনের শেষে সাংবাদিকদের জন্য কোনো প্রশ্ন-উত্তর পর্ব ছিল না।
বিএনপির মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর, খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মওদুদ আহমদ, জমিরউদ্দিন সরকার, তরিকুল ইসলাম, মাহবুবুর রহমান, রফিকুল ইসলাম মিয়া, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আবদুল্লাহ আল নোমান, খন্দকার মাহবুব হোসেন, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, আবদুল মান্নান, শামসুজ্জামান দুদু, গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী, অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন, নিতাই রায় চৌধুরী, মাহমুদুল হাসান, খন্দকার মাহবুব হোসেন, জয়নাল আবেদীন, মীর নাসির, রিয়াজ রহমান, সাবিহউদ্দিন আহমেদ, আমানউল্লাহ আমান, মিজানুর রহমান মিনু, গোলাম আকবর খন্দকার, মসিউর রহমান, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, আবদুল হালিম, ইসমাইল জবিউল্লাহ, আবদুল কাইয়ুম, অধ্যাপিকা সাহিদা রফিক, অ্যাডভোকেট আবদুর রেজ্জাক খান, এ জে মোহাম্মদ আলী, হাবিবুর রহমান, আতাউর রহমান ঢালী, নাজমুল হক নান্নু, অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া, আনহ আখতার হোসেন, মাহবুবউদ্দিন খোকন, মজিবুর রহমান সারোয়ার, খায়রুল কবির খোকন, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, শামা ওবায়েদ, রুমিন ফারহানা, বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান, বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, চেয়ারপারসনের প্রেস উইংয়ের সদস্য শামসুদ্দিন দিদার ও শায়রুল কবির খান সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
২০ দলীয় জোটের শরিক নেতাদের মধ্েয অলি আহমেদ, টিআই ফজলে রাব্বী চৌধুরী, আন্দালিব রহমান পার্থ, এম এ রকীব, শফিউল আলম প্রধান, খন্দকার গোলাম মূর্তজা, ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, এএইচএম কামরুজ্জামান খাঁন, মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, জেবেল রহমান গানি, আজহারুল ইসলাম, মহিউদ্দিন ইকরাম, সাঈদ আহমেদ, গরীবে নেওয়াজ, সাইফুদ্দিন আহমেদ মনি ছিলেন সংবাদ সম্মেলনে।
এছাড়া ছিলেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরী, অধ্যাপিকা এজেডএন তাহমিদা বেগম, অধ্যাপক খন্দকার মুস্তাহিদুর রহমান, অধ্যাপিকা দিলারা চৌধুরী, সাংবাদিক মাহবুবউল্লাহ, অ্যাডভোকেট এলিনা খান ও নির্বাচন কমিশনের সাবেক সচিব আবদুর রশীদ।- বিডিনিউজ