বৃহস্পতিবার, ৮ জুন, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ২৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
অধ্যক্ষ মজিবর রহমান
‘পুরাকালে স্বর্গ থাকিয়া নামিয়া আসিয়া প্রভু জনৈক রাজা, প্রধান সেনাপতি এবং একটি রাখাল বালকের বিবাদ রফা করিবেন। কথাটি রাষ্ট্র হইলে প্রাচীর বেষ্ঠিত ময়দানের (স্টেডিয়াম) গ্যালারিগুলো দর্শকে দর্শকে ভরিয়া গেল। যথারীতি প্রভু নামিয়া আসিলেন এবং রাজা, সেনাপতি ও রাখাল বালকের উদ্দেশ্যে দৈব বাণিতে কহিলেন, তোমরা প্রত্যেকে আমার নিকট বর প্রার্থনা কর। রাজা হস্তজোড় করিয়া কহিলেন, প্রভু, আমার প্রধান সেনাপতিকে ধ্বংস করুন। নইলে সে আমাকে রাজ্য হইতে বিতাড়িত করিবে। সেনাপতি কহিলেন, প্রভু, তুমি কখনও অঙ্গীকার ভঙ্গ কর না। আমার একমাত্র প্রার্থনা, তোমার শাপে এই রাজা ধ্বংস হউক। এইবার প্রভুর আজ্ঞা হইল, হে রাখাল বালক তুমি কী যাঞ্চা করিবে ? বালক কাঁদিয়া ফেলিল এবং অতীব বিনীত কণ্ঠে কহিল, হে পরম করুনাময় আমি আপনার নিকট কোন গুজবে কান দিয়া আসি নাই, আসিয়াছি শ্রদ্ধাভরে। আমি কোন বর প্রত্যাশা করিব না। অনুগ্রহ পূর্বক রাজা এবং সেনাপতির প্রার্থনা মঞ্জুর করুন।’
একটি কলেজের অফিস সহকারীর শূন্য পদে লোক নিয়োগের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিটি কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এবং তা কত তারিখের। এখবরটি জানার জন্য অধ্যক্ষের নিকট একের পর এক ফোন আসতে থাকে। ফোনগুলোর মধ্যে সমাজের বিশিষ্ট জনেরও রয়েছে। অধ্যক্ষের ভাষ্য, খবরটি সম্পর্কে তাঁর নিকট কোন খরব নেই কিংবা তিনি খবরটির কিছুই জানেন না। তাহলে খবরটি কোত্থেকে আসল, কে রটাল কিংবা কীভাবে রটল? প্রশ্নটি কিন্তু করাই যায়। মওলানা ভাসানী নৌকা না পেলে যমুনা নদীর উপর দিয়ে হেঁটে এপার থেকে ওপারে যেতে পারতেন। কথাটিকেও বিশ্বাস করার মত লোকের অভাব হয়নি তখন। কিন্তু কথাটি আসলে বিশ্বাস করার মত কি !
গুজব নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁরা প্রথমেই গবেষণা ফিল্ডের জনগোষ্ঠির সমাজতাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিকে মননিবেশ করেন। কোন কোন সমাজের মানুষ গুজব তৈরি করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন এবং গুজব তৈরি করে প্রচারে আরও বেশি আনন্দ পান। গুজবের ডালপালা গজায়, আবার তা ছোঁয়াচেও বটে। তাহলে কোন সে সমাজ ! শিক্ষিত, অশিক্ষিত, মূর্খ, সাধুসন্ত, পীর-ফকির, দরবেশ নাকি আউলিয়াদের সমাজ। আদালতের বিচারে রাজাকার ও একটি রাজনৈতিক দলের একজন লোকের মৃত্যুদ- ঘোষিত হবার পরেই তার মুখখানা দেখা গেল চাঁদে! খবরটি প্রথমে একটি বৃহত্তর জেলায় রটলো এবং পরে তা গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ল। ছড়িয়ে পড়ল মুঠো ফোনে ভোর রাতের মধ্যেই। বলা হলো খবরটি একজন আরেক জনকে জানালে ঢেড় ছোওয়াব হাছিল হবে। চাঁদ মামা সত্যিই কী তার কপালে টিপ দিয়েছিল ? ৭০ টি বছর ধরে চাঁদমামা বাচ্চাটির কপালে টিপ দিল না অথচ তার ফাঁসির হুকুম হলেই টিপ এঁটে দিল! ধন্যবাদ চাঁদমামা! কপালে টিপ পরানোটি তোমার যথা সময়েই হয়েছে। নইলে টিপ পরাতে তোমার কষ্টই হতো। আসলে চাঁদমামাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। দোষ যদি দিতেই হয় তাহলে তার ডিএনএ-কে দিতে হয়। কারণ গুজজের সঙ্গে ডিএনএ-এর গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
গর্ডন অলপোর্ট ও লিও পোস্টম্যানের বই ‘দ্য সাইকোলজি অব রিউমার’ এবং মুলেন গোয়েথাল্স ও জর্জ গোর্য়েথাল্স এর বই ‘থিওরিজ অব গ্রুপ বিহেভিয়ার’ বই থেকে জানা যায়, গুজবের জন্য গুজবপসারিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। গুজবের জন্য ডিএনএ-ই দায়ী। পৃথিবীর সব জনগোিষ্ঠ একই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী নন। যেমন- মার্কিনরা, ব্রিটিশরা, ফরাসিরা, বাঙালিরা একই ধরনের ডিএনএ-এর অধিকারী নন। অর্থাৎ জাতিভেদে সকল মানুষের মধ্যেই কিছু অভিন্ন বৈশিষ্ট্য থাকে। তিনি হতে পারেন কৃষক, কেরানি, ব্যবসায়ী, বেপারি, পুলিশ, পোশাক কারখানার মালিক, রাজনীতিক, রঙের মিস্ত্রি, সাংবাদিক, সাংসদ, আমলা, আমের আড়ৎদার, কামার, কলামলেখক সবার মধ্যে বাইরে যত পার্থক্যই থাকুক না কেন একটি মৌলিক জায়গায় তাঁরা এক। তাদের চেন্তা-চেতনা, ধর্ম-কর্ম, স্বভাব-চরিত্রে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। কোন সমাজে সবচেয়ে মেধাবী মানুষটি এবং সবচেয়ে নির্বোধ মানুষটির মধ্যেও কোন এক জায়গায় মিল থাকা বিচিত্র কিছু নয়। তাই গুজব কোন সমাজে অতি সহজেই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে।
এক সময় গুজব উঠেছিল (যদিও এটি অতিরঞ্জন) বাংলার জনপ্রিয় ও বড়নেতা শের-ই-বাংলা এ.কে ফজলুল হক একসঙ্গে ৮০ টি ফজলি আম খেতে পারতেন। ৮০ টি ফজলি আমের ওজন নিদেনপক্ষে ৫০ কেজির কম নয়। তাহলে শের-ই-বাংলার এতবড় পাকস্থলি কী ছিল ? তা আমরা ভেবে দেখিনি, বিশ্বাস করেছি। একবার এক ক্ষুধা পীড়িত অঞ্চলের উপর দিয়ে হেলিকপ্টার উড়ে যেতে দেখে সবাই ভাবল আমাদের জন্য খাদ্য আনা হচ্ছে। কিন্তু হেলিকপ্টারটি ল্যান্ড না করে চলে গেলে ক্ষুধার্থ জনগণ আরও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এটি বাস্তবতা এবং এটি সমাজের মনোজগতের চিত্র। অতিরঞ্জন এবং গুজব দুই জ্ঞাতি ভাই। এক ভাইয়ের কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারে অথবা নাও পারে, কিন্তু গুজব কোন না কোন উদ্দেশ্য প্রণোদিত। গুজবের একটি পটভূমি থাকে। সে পটভূমিকর গা বেয়ে বেয়ে গুজব হেঁটে চলে এবং একসময় ক্লান্ত হয়ে নুয়ে পড়ে সে। এগুলো সবই ঘটে মানুষের সমাজ মনোস্তত্ত্বের মধ্যে। যে সমাজে সত্য অনুপস্থিত এবং মিথ্যার প্রাধান্য বেশি অথবা সত্য গোপনকরার প্রবণতা বেশি সে সমাজে গুজব রটার সম্ভাবনাও বেশি।
ঢাকার শাপলা চত্ত্বরে হেফাজতের সমাবেশে পুলিশ, র্যাব এবং বিজিবির অপারেশনে মধ্যরাতের অন্ধকারে কতজন লোক নিহত হয়েছে, তার সঠিক সংখ্যা সরকার দিতে পারেনি। এমনকি হেফাজতও মৃতের নাম-ধাম সহ তালিকা প্রকাশ করতে পারেনি। সুতরাং এক ধাক্কায় সংখ্যাটা আড়াই হাজারে পৌঁছানো কোন কঠিন কাজ ছিল না। তাই অনেকের পক্ষে তা বিশ্বাস করাটা অযৌক্তিকও ছিল না। ঘটনাটি রংপুর কিংবা রাজেন্দ্রপুর হলে গুজবের হাত-পা সীমিত থাকত। সেদিনের মধ্যরাতে ‘অপারেশন সিকিউরড শাপলা’ (পুলিশ), ‘অপারেশন ফ্লাশ আউট’ (র্যাব), এবং ‘অপারেশন ক্যাপচার শাপলা’ (বিজিবি)-তে ৭ হাজার ৫৮৮ জন আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য অংশ নেন এবং দেড় লাখের বেশি গোলাবারুদ ব্যবহৃত হয়। তাই সেখানে নিহত-আহতের সংখ্যায় গুজব রটাটা অতি
সহজ ছিল।
গুজব তৈরি হয় সামাজিক, পারিপার্শ্বিক ও মনোস্তাত্ত্বিক কারণে। তাই যে সমাজে সাধুসন্ত ও পীর-ফকিরের প্রাধান্য বেশি সে সমাজে গুজব সৃষ্টির মাত্রাও বেশি। বাংলাদেশের মানুষ চরম বিশ্বাসী। তাই গুজব রটলেই তাঁরা তাকে বিশ্বাস করতে চায়। ভেজাল খাদ্যকে রংচং লাগিয়ে পরিবেশন করলে আমরা বিশ্বাসে তাকে সাগ্রহে গ্রহণ করি। ভেবে দেখি না এর মধ্যে ভেজালত্ব আছে কি-না। এই ভেজাল খাদ্য যারা খাওয়াচ্ছে, গুজব যারা রটাচ্ছে, ছড়াচ্ছে সমাজে আজ তাদেরই প্রাধান্য। তাই তাদের প্রতিভার প্রশংসা করতে হয়। কী মোক্ষম অস্ত্র ! এক গুজবে ফাঁসির আগেই ৮০ জন শহিদ। বিজ্ঞপ্তি প্রচারের আগেই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির জয়জয়কার।
প্রিয় পাঠক, আর ধৈর্যচ্যূতি নয়, আসুন আমরা সমাজে আজকে উচ্চ-চিন্তা ও গঠনমূলক কাজের প্রাধান্য দেই, প্রশংসা করি। তাহলে সত্যকে মিথ্যা দিয়ে আড়াল করা যাবে না। পশ্চাদপদ চিন্তা ও প্রতিক্রিয়াশীলতা সমাজ থেকে মুছে ফেলুন। যুক্তিবাদিতা ও প্রগতিশীলতার প্রসার ঘটান। দেখবেন, দেশ একদিন উন্নত দেশে পরিণত হয়েছে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক