সমুদ্র দর্শন

আপডেট: জানুয়ারি ২১, ২০২৩, ১২:১৪ পূর্বাহ্ণ

সামসুল ইসলাম টুকু:


টেকনাফ থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত সাড়ে চারশো কিলো মিটারের কম হবেনা সমুদ্র উপকূল। সেই সমুদ্রের বিশালত্ব দেখে মনে হয় যদি প্রকৃতি রুষ্ট হয়ে ওঠে তবে ক্ষুদ্র বাংলাদেশটাকে সমুদ্র তার লবণাক্ত পানিতে নিমজ্জিত করতে পারে যে কোনো মুহূর্তে। সেই ভয়ঙ্কর সমুদ্র দেখার সাধ থাকলেও ছেলে বেলায় বাড়ির পাশে মহানন্দা নদীতে ডুবে যাবার দুঃসহ স্মৃতি আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এছাড়া ১৯৯৮ সালে বন্যাউপদ্রুত এলাকা পাঁকা নারায়ণপুর দেখতে স্পিডবোটে ঝড়ের মধ্যে এবং ঢাকা থেকে খুলনা যাওয়ার সময় আরিচা-দৌলতিয়া লঞ্চে পার হওয়ার সময় ঝড়ের মধ্যে ভীতিকর অভিজ্ঞতা আছে। তাই অথৈ জলরাশিতে নিজের অসহায়ত্ব মনের মধ্যে ভেসে উঠে বার বার। আমার অসহায়ত্বে কারো কিছু আসে যায়না। কারণ হাজার হাজার সমুদ্র বিজয়ী সকল ভয়কে তুচ্ছ করে নতুন নতুন অজানা দেশ আবিষ্কার করেছে। এ অভিযান আজও অব্যাহত আছে এবং থাকবে যতদিন পৃথিবী আছে। শুধু নতুন দেশ নয়, সমুদ্রের অতল তলে অজানা কত রহস্য আছে তা আবিষ্কারের নেশায় মত্ত রয়েছে সমুদ্র বিজয়ী ডুবুরিরা। সোনার হরিণ চাকরির নিশ্চয়তা না থাকা সত্ত্বেও উন্নয়নশীল দেশের যুবকরা ট্রলারে চড়ে অনিশ্চিত সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছে ইউরোপের দেশগুলিতে যাবার জন্য। এসব অভিযাত্রিদের পরিণতি কত ভয়াবহ ও উদ্বেগজনক তা জাতিসঙ্ঘের রিপোর্ট প্রমাণ করে ।
২০২০ সালে করোনার কারণে বিদেশ ভ্রমণ নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও ওই বছর মরক্কো উপকূলে অবাস্থিত দ্বীপগুলোতে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছে ৮৬ হাজার ৪৪৮ জন। এর মধ্যে ২ হাজার ২৭৬ জন ডুবে মারা গেছে এবং ৫২ হাজার ৩৭ জনকে সমুদ্রপথে রওয়ানা হবার সময় কর্তৃপক্ষ বাধা দিয়েছেন। ২০১৪ সাল থেকে স্থল ও সমুদ্রপথে ইউরোপ যাবার সময় মৃতের সংখ্যা ২২ হাজারের বেশি। আমাদের দেশেই সমুদ্র সৈকতে স্নান করতে গিয়ে, ট্রলারে মাছ ধরতে গিয়ে- প্রতি বছর নদীতে বিশেষ করে প্রমত্ত পদ্মায় লঞ্চ ডুবিতে, হাওর অঞ্চলে নৌকা ডুবিতে মৃতের সংখ্যা কম নয়। তাই বলে সমুদ্রস্নান মাছ ধরা লঞ্চ ভ্রমণ বন্ধ হয়নি এবং হবেও না। আমার মনে হয় ট্রেন বা বাস দুর্ঘটনা প্রাকৃতিক কারণে হয়না। হয় মূলত চালকের কারণে। কিন্তু ট্রলার লঞ্চ দুর্ঘটনা হয় প্রাকৃতিক কারণেই। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানুষ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা। সেখানে মানুষ অসহায়। উত্তাল জলরাশির ভাল বর্ননা আমি দিতে পারছিনা। তার কাব্যিক বর্ণনা শুনুন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “দেবতার গ্রাস” কবিতায়। এক স্থানে বলেছেন, মসৃণ চিকন কৃষ্ণ কুটিল নিষ্ঠূও লোলুপ লেলিহ জিহবা সর্পসম ক্রুর /গলজল ছলভরা তুলি লক্ষফনা / ফুঁসিছে গর্জিছে নিত্য করিছে কামনা। এই কবিতাটির আরেক অংশে বলেছেন, লুব্দধ ক্ষুব্দধ হিংশ্র জলরাশি /প্রশান্ত সুর্যাস্তপানে উঠিছে উচ্ছাসি/উদ্ধত বিদ্রোহভবে নাহি মানে হাল / ঘুরে টলমল তরী অশান্ত মাতাল মুঢ়সম।
সেই মুঢ়সম সমুদ্র দর্শনের দিনক্ষণ স্থির করে ছেলে মেয়েরা জানালো, যেতে হবে সপরিবারে। আমার বড় ছেলে ও বউমা অস্ট্রেলিয়ায় থাকায় নাতনী ও পুতিনসহ সদস্য হলো ১১ জন। মনে পড়ে গেল ‘ওরা ১১ জন’- এর কথা। ওদের পরিকল্পনা, চট্টগ্রাম কক্সবাজার কুতুবদিয়া মহেশখালী সহ সব দর্শনীয় স্থানে ঘুরবে। প্রার্থিত যাত্রা শুরু হলো ১৭ মার্চ রাত সাড়ে ১১টায় ঢাকা থেকে তুর্না এক্সপ্রেসে চট্টগ্রাম। একটি এসি বগিতে রাতটা ভাল কাটলো। সকাল ৮ টায় পৌঁছলাম চট্টগ্রামে। রাতে গুগলে দেখলাম ‘সংবাদ- এ আমার লেখা ‘বীরগাঁথা হোক প্রকৃত বীরের কন্ঠে’ শীর্ষক প্রবন্ধটি উপ সম্পাদকীয় কলামে প্রকাশ হয়েছে। মনটা ভালোই ছিল। চট্টগ্রাম রেল স্টেশন থেকে মাত্র ৫০ গজ দূরেই পর্যটন কর্পোরেশনের হোটেল সৈকতে আমরা ৪টি রুম নিলাম।
সকালের নাস্তা খেয়ে পুরোদিনের চুক্তিতে একটি বড় মাইক্রোবাসে করে প্রথম গেলাম প্রায় ৩০/৩৫ কিমি. দূরে মহামায়া লেক ও ঝর্ণায়। সবুজ পানি বিশিষ্ট এই প্রাকৃতিক লেকের প্রায় ১০/১২ কি.মি. পথ যেতে হলো যন্ত্রচালিত নৌকায়। সত্যিই কী অপূর্ব আকর্ষণীয় এই প্রাকৃতিক শোভা যা না দেখলে বর্ণনা করে বোঝানো যায়না। প্রত্যেকেই খুব খুশি হলো। আমার ছোট ছোট নাতনি-পুতিনরাও উপভোগ করলো। প্রায় দুঘণ্টার এই মনোমুগ্ধকর অভিজ্ঞতা। এবার আমরা গেলাম চন্দ্রনাথ পাহাড়ের উপরে দুটি মন্দির দেখার জন্য। প্রায় ১১৫২ ফুট উপরে খাড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হবে। যা আমার পক্ষে মোটেও সম্ভব নয়। আমার সাথে থেকে গেল মেজো ছেলে বৌমা পুতিন ও ছোট নাতিনি। আমার স্ত্রী মেয়ে ও বর নাতনি পাহাড়ে ওঠার জন্য গেলেও অল্প দূরে গিয়ে থেমে গেল। তবে আমার জামাই ছোট ছেলে ও ছোট বৌমা প্রত্যেকে ৩০ টাকা দামের ৩ খানা বাঁশের লাঠির উপরে ভর করে মন্দির দুটো দেখে এলো প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা পরে। এটা ছিল একটি কষ্টকর যাত্রা। তারা যে ভীষণ ক্লান্ত তা বোঝা গেল। এত উঁচু খাড়া পাহাড়েও কিছু মানুষ তাদের জীবন-জীবিকার জন্য মাটির বোঝা ডাব মাথায় করে পাহাড়ে যায় এবং পর্যটকদের ডাবের পনি খাইয়ে সেবা করে। তাদের জন্য যে প্রশংসা করা হোকনা কেন তা কম হবে। বিকেল ৫টায় আমরা চন্দ্রনাথ পাহাড়ের অদূরে বোটানিক্যাল গার্ডেনে গেলাম। চলমান মাইক্রোতে বসেই আমরা ১৫/২০ ব.কি.কি. বিশিষ্ট গার্ডেন ঘুরলাম। খুব ভাল লাগলো সরকার সংরক্ষিত এই গার্ডেন। আরো ভাল লাগতো যদি সুপ্তধারা ও সহস্রধারা ঝর্ণা দুটি সজীব থাকতো। সেখানে কিছু সময় কাটানো যেত। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমের কারণে তা দৃষ্টিগোচর হলোনা। সেখান থেকে আমরা রওয়ানা হলাম বাঁশবাড়িয়া সমুদ্র সৈকত অভিমুখে। সেখানে পৌঁছলাম সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়। আলো আঁধারিতে যা দেখলাম সেটাও ভাল লাগলো। এখানে পর্যটকেরা তেমন আসেনা। তাছাড়া এটি সরকার কর্তৃক অনুমোদিত নয়। সেখান থেকে পতেঙ্গা পৌঁছলাম রাত ৮টায়। রাতে ভাল দেখা গেলনা। তবে বোঝা গেল অনেক উন্নতি হয়েছে। সমুদ্র পাড়ে দীর্ঘ বাঁধ দেওয়া হয়েছে, চার লেনের রাস্তা হয়েছে, বন্দরের কার্যক্রম গতি পেয়েছে কয়েকগুন, ১৯৬২ সালের স্মৃতি মনে পড়ে গেল। তখন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। বাবার সাথে পতেঙ্গা দেখেছিলাম। দিনের আলোতে আবার পতেঙ্গা দেখার বাসনা নিয়ে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম রাত ৯টায়।
পরদিন সকালে গোসল সেরে হোটেল সৈকতের নিচে ডাইনিঙে নাস্তা করতে গেলাম। এ হোটেলে এক রাত যাপন করলে পরদিন ফ্রি নাস্তা দেওয়া হয়। ফ্রি হলেও মেনু খুব ভাল ছিল। পেপেরজুস, কলা , পরাটা, ডাল, তরকারি, হালুয়া, ডিম এবং দুধচা। এত খাবার আমি খেতে পারলাম না। আশে পাশে চালান করে দিলাম। কিছুক্ষণ পর আমরা মালপত্রসহ হোটেল ত্যাগ করলাম। অন্য একটি মাইক্রোতে করে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। পথিমধ্যে কুতুবদিয়া যাওয়ার জন্য বাঁশখালীর মধ্যে দিয়ে পেকুয়া ঘাটের দিকে যেতে থাকলাম। পথে বাঁশখালী রোডে একটি থেমে থাকা অটোকে আমাদের মাইক্রোটি শুধুমাত্র স্পর্শ করার জন্য লিকলিকে ওই অটো ড্রাইভার নেমে এসে আমাদের ড্রাইভারকে গালাগালি সহ একটা ঘুঁষি মেরে দিল এবং মুহূর্তের মধ্যে ওই এলাকার পরিবহন শ্রমিকদের নিয়ে মাইক্রো আটকে দিল। মাইক্রোটি একজন পুলিশ অফিসারের। তাকে ফেনে বিষয়টি অবহিত করলে পুলিশ অফিসার মোবাইলে অনেক বাক-বিত-ার পর ছেড়ে দিল। অন্যথায় আমাদের ভীষণ বিড়ম্বনার শিকার হতে হতো। আমরা পেকুয়া ঘাটে পৌঁছলাম দুপুর পৌনে দুটায়। সেখানে পরিবারের সকলেই কুতুবদিয়া চললো। শুধু আমি আর ড্রাইভার মাইক্রোতে থেকে গেলাম। যতক্ষণ ওই ট্রলারটি দৃষ্টিগোচর হলো ততক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম। এরপর মোবাইলে তাদের খোঁজখবর নিতে থাকলাম। দীর্ঘ ৪ ঘণ্টা পরে ওরা ফিরে এলে আমরা কক্সবাজারের পথ ধরলাম। রাস্তাটি নির্মাণাধিন ছিল তাই এবড়ো থেবড়ো পথে পুরো দুই ঘণ্টা প্রচ- ঝাঁকুনি সহ্য করে ভাল রাস্তায় উঠলাম এবং রাত ৯টায় কক্সবাজার পৌঁছলাম। হোটেল বে-অয়ান্ডারার এ ৩টি রুম ভাড়া নিলাম।
পরদিন সকালে শিউলী স্মৃতি স্বাক্ষর আঁখী ও আকরাম মহেশখালি গেল এবং আমি সজল এনী আদৃতা উৎস এবং আয়েশা কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে গেলাম। ওরা সমুদ্রের পানিতে খুব খেলা করলো, ছবি তুললো। প্রায় একইসাথে আমরা ও শিউলীরা হোটেলে ফিরে এলাম, সমুদ্র স্নান করলাম। এরপরে ইনানী ও হিমছড়ি যাবার কথা থাকলেও যাওয়া হলোনা। অবশ্য আমি ও শিউলী ইনানী হিমছড়ি টেকনাফ সেন্টমার্টিন ছেড়াদ্বীপ দেখেছি। বিকেলে শুধু কেনাকাটা হলো বার্মিজ মার্কেটে।
পরদিন সকালে ১০টায় হোটেল ত্যাগ করে মালপত্র সহ অন্য একটি মাইক্রোতে পালকির চর দেখার উদ্দেশ্যে বের হলাম। প্রায় ১৩০ কিমি. আঁকাবাঁকা সরু পথে স্বাক্ষের নির্দেশিত রাস্তায় সাড়ে ৪ ঘণ্টা পরে পালকির চরে পৌঁছলাম। রাস্তার অবস্থা দেখে মনে হলো আমরাই বোধহয় একমাত্র পাগল, কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলাম আরো ৪/৫ মাইক্রো ভর্তি পাগল সেখানে উপস্থিত। সেখানে ৩/৪ টি হোটেল ও একটি ছোট বাজার গড়ে উঠেছে ঝাউ বনের মধ্যে এছাড়া একটি পাকা গণশৌচাগার দেখলাম। এটি একটি দর্শনীয় সমুদ্র সৈকত হতে পারে। তবে এখনো সরকারি অনুমোদন পায়নি। সেখানে দেখলাম একটি বিশাল ট্রলার সদৃশ্য জাহাজ সমুদ্র কিনারে আটকে আছে। স্থানীয় লোকজন বললো প্রায় ৪/৫ বছর আগে এক টর্নেঙোয় নোঙ্গর ছিঁড়ে এখানে এসে আটকে গেছে। সেই অবধি এটাকে উদ্ধারের জন্য কেউ আসেনি। সেখান থেকে পতেঙ্গা পৌঁছলাম সন্ধ্যা ৬টায়। দেখলাম গভীর সমুদ্রে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল বিশাল বিদেশি মালবাহী জাহাজ এবং আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ছোট ছোট মালবাহী কার্গোগুলি। লোকে লোকারণ্য এই বিখ্যাত সমুদ্র সৈকতে দেড় ঘণ্টা থাকলাম, কাঁকড়া আর চিংড়ির বারবিকিউ (ভাজা) খেলাম। রাত ১০টায় চট্টগ্রাম হোটেল সৈকতে পৌঁছে, ফ্রেশ হয়ে, রাতের খাবার খেয়ে সাড়ে ১১টায় তূর্না এক্সপ্রেস ধরে ঢাকা ফিরলাম। কক্সবাজার, ইনানী, হিমছড়ি, সেন্টমার্টিন, ছেড়া দ্বীপ, কুয়াকাটা ছাড়াও কুতুবদিয়া, মহেশখ্লাী, বাঁশবাড়িয়া, পালকিরচর, গুলিয়াখালী, নিঝুমদ্বীপ কুকরি মুকরি সহ ছোট ছোট বহু সমুদ্র সৈকত আছে যেগুলো পর্যটন কেন্দ্র হতে পারে ।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট