মাহাবুল ইসলাম
বছরে পদ্মার যৌবন ধরা দেয় প্রায় তিন মাস। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে সে সময়েও ভাটা পড়তে শুরু করেছে। জেগে উঠছে পলিমাটির উর্বর চর। যাকে ঘিরে নতুন সম্ভাবনার দেখা দিয়েছে। শুধুমাত্র উর্বর চরকে কেন্দ্র করেই একটা নতুন অর্থনৈতিক সমীকরণ তৈরি হয়েছে।
কৃষি বিভাগও লুফে নিয়েছে সে সুযোগ। কৃষি অর্থনীতিকে গতিশীল করতে চর কেন্দ্রীক নানা কর্মসূচিও বাস্তবায়ন হচেছ। এতে বাণিজ্যিক আবাদের ছোঁয়াও লেগেছে চরে। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো- উৎপাদন বাড়াতে কৃষক ও কৃষি বিভাগের তৎপরতা বাড়লেও নদীর জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও নিধনের মতো অপরাধ দমনে অনেকটাই নির্ভার পরিবেশ অধিদপ্তরসহ স্থানীয় প্রশাসন! যা নিয়ে উষ্মা ও ক্ষোভ প্রকাশ করছেন পরিবেশ কর্মীরা।
কৃষি বিভাগ ও স্থানীয় সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ৫-৬ বছর আগেও পদ্মার জেগে ওঠা চরে বড়জোর ধৈঞ্চার বীজ ছিটিয়ে রাখা হতো। পরে ওই গাছ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করতেন। এছাড়া বিভিন্ন বণ্যপ্রজাতির উদ্ভিদ এসব চরে গজিয়ে উঠতো। যেগুলো পদ্মার জীববৈচিত্র্যেও জন্য ছিলো নিরাপদ আশ্রয়স্থল। কিন্তু এখন সেই চরে চাষ হচ্ছে ১৬ রকমের ফসল।
টমেটো, কপি, পেঁয়াজ, সূর্যমুখী, লাউ, পটোল, গম, মরিচ, খেসারি, কলা, মুলা, ভুট্টা ও শসার মতো অর্থকারি ফসল চাষ হচ্ছে। পলি মাটির উর্বর চরও এখন বিঘাপ্রতি ৭ থেকে ১০ হাজার টাকায় লিজ দেয়া হচেছ। মাটি উর্বর হলেও ভালো ফলনের আশায় ইচ্ছেমতো কিটনাশক, রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হচ্ছে। পাখি তাড়াতে নানা ফাঁদ ব্যবহার করা হচ্ছে। বণ্যপ্রাণিসহ পাখিও অবাধে নিধনের ঘটনা ঘটছে অহরহই। কিন্তু এ নিয়ে কিছু স্থানে ‘বিল বোর্ড’ টাঙানো ছাড়া কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেই পরিবেশ অধিদপ্তর কিংবা স্থানীয় প্রশাসনের। অথচ এই নদীকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর মোটা অঙ্কের রাজস্ব সংগ্রহ করা হচ্ছে। কিন্তু নদীর জীববৈচিত্র্য রক্ষায় তারা নির্ভার!
সম্প্রতি পদ্মার তীরে চাষবাদের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে ও সরজমিনে দেখা যায়, অন্য জমির মতোই চাষাবাদের সবকিছুই করছেন এই জমিতেও। কেউ কেউ জৈব্য সার ব্যবহার করলেও অধিকাংশ কৃষকই কিটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করছেন বলে জানা গেছে। পাখি তাঁড়াতে কাঁকতাড়ুয়া বানানো হয়েছে। পুরো খেত জুড়ে অনেকেই প্লাস্টিক ঝুঁলিয়ে রেখেছেন পাখি তাড়াতে।
গোদাগাড়ীর বিদিরপুর এলাকার চাষী জামাল হোসেন বলেন, আমরা তিনজন মিলে প্রায় ৭ বিঘামতো জমি লিজ নিয়েছি। ভুট্টা, শাকসহ সরিষাও রোপন করেছি। অন্য জমিতে যেভাবে কিটনাশক দেয়, এখানেও তেমননি দিচ্ছি। আর পাখির উৎপাত বেশি, একারণে প্লাস্টিকের ব্যাগ ঝুঁলিয়েছি। যাতে করে পাখি ভয় পায়। আর খেতে না বসে।
ফুলতলা ঘাট এলাকার একটি গ্রামের মোড়ল নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বলেন, আগে যেসব জমিগুলো পুরোটাই ধু ধু মরুভূমি হয়ে পড়ে থাকতো, সেখানে এখন ফসল হচেছ। স্থানীয় প্রভাবশালীরা তাদের ইচ্ছেমতো দখলও করছেন। অনেক এলাকায় সমাঝোতার ভিত্তিতেও ভাগ করে নেয়া হচেছ। এখানে চাষাবাদে আলাদা কোন নিয়ম নেই। তেমন নজরদারিও দেখি নি। যেহেতু পাখি ফসল নষ্ট করে। একারণে রাতের আঁধানে পাখি কেউ বিষ দিয়ে মারে। কেউ পলিথিন টাঙায়ে ভয় দেখায়।
সম্প্রতি রাজশাহীর পদ্মার চরে অবাধে পরিযায়ী পাখি শিকারের ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় পরিবেশকর্মীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজশাহী শহর সংলগ্ন পদ্মার চরগুলোর বেশ কিছু জায়গায় বিষটোপ দিয়ে পাখি হত্যা করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারি) সকালেও বেশকিছু পাখি মরে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। সকালে টি-বাঁধ এলাকার চরে পাখি পড়ে থাকতে দেখেন স্থানীয়রা। এসময় তারা অন্তত ১০টি পাখি মৃত অবস্থায় উদ্ধার করেন। স্থানীয়দের আসতে দেখে পালিয়ে যান পাখি শিকারিরা।
টি-বাঁধ এলাকার বাসিন্দা নিয়ামত আলী জানান, ভোরের দিকে কিছু মানুষ চরে গিয়ে বিষ দেয়া মাছ রেখে আসেন। সকালে পাখিরা এগুলো খেয়ে মরে পড়ে থাকলে তারা সেগুলো কুড়িয়ে নিয়ে জবাই করে বিক্রি করেন। তার ভাষ্যমতে, প্রতিদিন অন্তত ৫০-৬০টি পাখি শিকারিরা মেরে নিয়ে যান।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, নগরীর পদ্মাপাড় সংলগ্ন চরে বেশকিছু শিকারি নিয়মিতই পরিযায়ী পাখি শিকার করছে। তারা বিষ মাছের সঙ্গে মিশিয়ে রাতের আঁধারে রেখে আসেন। পরে সেই খাবার খেয়ে পাখি অসুস্থ হয়ে পড়লে সেগুলো তারা ধরে জবাই করে বিক্রি করছেন। যা আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা দরে বিক্রিও হচ্ছে।
রাজশাহীর পরিবেশ গবেষক ও লেখক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, চাষাবাদের কাজে ব্যবহৃত কিটনাশক ও রাসায়নিক উপাদান বর্ষকালে নদীর পানিতে মিশছে। এতে জলজ প্রাণি যে বিচরণ সেটা কমে আসছে। এক সময় এই নদীতে যে পরিমাণ পাণিসহ জলজ ও পরিযায়ী পাখি দেখা যেতো সেগুলোও আর আগের মতো নেই। নদীর জেগে ওঠা চরে চাষাবাদের ক্ষেত্রে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার পাশাপাশি প্রশাসনিক ও সামাজিক উদ্যোগ জরুরি। চরে পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যক্রম বন্ধে নিজ নিজ জায়গা থেকে সোচ্চার হতে হবে। তবে একটা বাস্তব চিত্র হলো-রাজশাহীর স্থানীয় প্রশাসন একে অপরের উপর দোষারোপ করলেও কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেন না। আর পরিবেশ অধিদপ্তর তো জনবান্ধব হতেই পারে নি।
এ বিষয়ে রাজশাহী বিভাগীর বন্যপ্রাণী পরিদর্শক জাহাঙ্গীর কবির বলেন, পরিযায়ী পাখি হত্যার শাস্তি বর্তমানে সর্বোচ্চ ১ বছরের কারাদণ্ড অথবা ১ লাখ টাকা জরিমানা এবং একই অপরাধ আবার করলে সর্বোচ্চ ২ বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান আছে। পদ্মার চরে পাখি শিকারের বিষয়টি আমরা অবগত হয়েছি। আমাদের নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমরা আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছি। তবে এবিষয়ে সামাজিক সচেতনতার কোন বিকল্প নেই।
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর রাজশাহীর উপ-পরিচালক মাহমুদা পরভীনের সঙ্গে মুঠোফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হলে ফোন রিসিভ না করায় কোন বক্তব্য পাওয়া যায় নি।
এ বিষয়ে রাজশাহী জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. মহিনুল হাসান বলেন, এ বিষয়টির সঙ্গে কৃষি বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তর, বণ্যপ্রাণি সংরক্ষণ অধিদপ্তরও জড়িত আছে। এটা আমাদেরও নজরেও এসেছে। বিষয়টি নিয়ে সমন্বিতভাবে একটি উদ্যোগ প্রয়োজন। আমরা এটি নিয়ে কাজ করবো।