মঙ্গলবার, ১৩ মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৩০ বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ ।
মিথুশিলাক মুরমু
সাঁওতাল বিদ্রোহের চেতনাকে উজ্জীবিত ও উদীপ্ত করতে যে দু’একটি জায়গায় বিদ্রোহের নায়ক সিধু-কানু’র ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে, এটির মধ্যে বোচাগঞ্জ উপজেলার হাটরামপুর আদিবাসী পাড়া অন্যতম। নিজস্ব অর্থায়নে স্বাধীনতার শহিদদের আবক্ষমূর্তি খেলার মাঠের সম্মুখে উন্মুক্ত করা হয়েছে। যোদ্ধাবেশে সিধু-কানু’র হাতে রয়েছে আদিবাসীদের আদিমতম অস্ত্র তীর-ধনুক। মূলতঃ এটিই আদিবাসীদের আত্মরক্ষার সর্বশ্রেষ্ঠ অস্ত্র। বৃটিশ সরকারের অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রের সম্মুখে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলো তীরন্দাজ বাহিনীই।
আদিবাসীরা শত্রুদের ঘায়েল করতে তীরের ফলায় বিষাক্ত পদার্থ ব্যবহার করে থাকে কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত অসম যুদ্ধে সেটি ব্যবহার থেকে বিরত থেকেছিলো। ইতোপূর্বে ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ২২ সেপ্টেম্বর দিনাজপুর জেলার কাহারোল উপজেলার ঐতিহাসিক কান্তনগর মন্দির প্রবেশ সড়ক দ্বীপে নির্মিত স্মারক ভাস্কর্যের উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী। ঐতিহাসিক স্মারক ভাস্কর্যে সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়ক সিধু-কানুসহ তেভাগা আন্দোলনের নেতা কৃষক নেত্রী কমরেড ইলা মিত্র, গুরুদাস তালুকদার, হাজী মোহাম্মদ দানেশ ও খোকা বাইশের প্রতিকৃতি রয়েছে। সেদিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলেছিলেন, ‘১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহ না হলে আমাদের স্বাধীনতা আসত না।
সাঁওতাল বিদ্রোহই পাকিস্তানিদের বুঝিয়ে দিয়েছিল যে, আমাদের তীর-ধনুকের কাছে তোমাদের কামানের গুলি তুচ্ছ।’ সাঁওতালসহ অত্র এলাকার আদিবাসীদের উদ্দেশ্যে তিনি আরো বলেছিলেন, ‘সাঁওতাল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের দুঃখ-দুর্দশার কথা চিন্তা করে আমরা আপনাদের জন্য দুটি জিনিস আশ্বাস আপনাদের হয়ে আমি প্রধানমন্ত্রীকে জানাব। একটি হচ্ছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ভূমি কমিশন গঠন ও অপরটি মনোরঞ্জনশীল গোপাল এমপির উত্থাপিত কাহারোল উপজেলায় ইপিজেড স্থাপন।’ একই জেলা ও উপজেলার মহেশপুর গ্রামে সাঁওতাল বিদ্রোহের স্মৃতি ভাস্কর্য ‘সিধু-কানু’ ২রা মে, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে উদ্বোধন করেছেন নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।
এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে মহেশপুর আদিবাসী উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ফলক উন্মোচনের মাধ্যমে মাননীয় মন্ত্রী উল্লেখ করেছিলেন, ‘এই অঞ্চলে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে যত আন্দোলন হয়েছে, আমাদের সেই আন্দোলনের প্রকৃত বিজয় অর্জন হয়েছে ১৯৭১ সালে মহান বিজয়ের মধ্য দিয়ে।…এই ভূখ-কে মুক্ত করার জন্য ইংরেজ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, তিতুমীর, সিধু-কানুসহ সকলের চেতনা ধারণ করেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই বাংলাকে মুক্ত করেছিলেন। এই চেতনা ধরে রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।’
সহজ-সরল আদিবাসী সাঁওতালরা দামিন-ই-কো অঞ্চলের গভীর অরণ্যকে পরিষ্কার করেছিলো। অতঃপর ১৮২৩ খ্রি. কোম্পানীর কর্তারা এই অঞ্চলের জমিকে নিজস্ব সম্পত্তি বলে ঘোষণা করে। এবার আদিবাসী সাঁওতালদের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের জঙ্গল পরিষ্কারের লক্ষ্যে নিয়োগ দেওয়া হয়। কোম্পানীরাজরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল- প্রথম তিন বছর খাজনা দিতে হবে না, পরে খাজনা দিতে হলেও তা খুবই সীমিত হারে ধার্য করা হবে।
কোম্পানীর লোভী কর্তারা প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করে ক্রমেই খাজনার উর্ধ্বগতির ধারা বজায় রেখেছিল। ভয়ঙ্কর হিংস্র জীবজন্তুদের সাথে লড়াই করে বসবাস উপযোগী করে তুললে সাঁওতালদের বসতি স্থাপনে অনুমতি দেয়। সাঁওতালদের চারপাশে গড়ে উঠে গঞ্জ, সরকারি দপ্তরখানা, থানা ও আদালত প্রভৃতি। ঊনিশ শতকে সাঁওতাল বিদ্রোহ বার বার ঘটেছিল। ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পর সাঁওতাল পরগণা জমিদারি এলাকায় অন্তর্ভূক্ত হয়। সাঁওতালদের কাছ থেকে বর্ধিত হারে জমির খাজনা আদায় করা হয়।
পূর্বের বাসস্থান থেকে উৎখাত হয়ে তারা দামিন-ই-কো (বর্তমান রাজমহল পাহাড়তলী) এলাকায় আশ্রয় গ্রহণ করে। এই অঞ্চল ছিল তখনকার ভাগলপুর, বীরভূম ও মুর্শিদাবাদ জেলার অর্ন্তগত। সাঁওতালরা আশা করছিল নতুনভাবে এখানে তাদের পক্ষে জীবন গড়ে তোলা সম্ভব হবে কিন্তু জমিদার, মহাজন, সরকারি আমলা এবং বেপারীদের শোষণের হাত এখানেও বিস্তৃত হয়। ১৮১১, ১৮২০, ১৮৩১ এবং ১৮৫৫-৫৬ খ্রিষ্টাব্দে সাঁওতাল বিদ্রোহের দামামা বেজে ওঠে।
সাঁওতাল বিদ্রোহের অমর নায়ক সিধু মুরমু জন্মেছিলেন ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে ভগনাডিহি গ্রামে, আর কানু সিধু থেকে ৫ বছর ছোট অর্থাৎ ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে ভগনাডিহি সিধু-কানু, চাঁদ-ভৈরব, ফুলো-জানোদের নাড়িপোতা গ্রামে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো। পাহাড়ি এলাকায় বসবাসকারী আদিবাসী সাঁওতালদের অবস্থা ও অবস্থান সামান্যই পরিবর্তন হয়েছে। ভারত উপমহাদেশের অন্যতম স্বাধীনতাকামী বীরযোদ্ধাদের উত্তসূরীদের সাথে স্বল্প সময় কাটানোর প্রাক্কালে জানার চেষ্টা করেছি, আন্দোলনের চেতনার বিচ্ছুরণ ঘটলেও তারা কেন সেই তিমিরেই রয়ে গেছেন! রাষ্ট্র, সরকার কিংবা উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলো কেউ-ই তাদের উত্তরসূরীদের স্বচ্ছল জীবনের স্বপ্ন দেখাতে পারেনি।
বাতির নিচেই অন্ধকার, এ সত্যকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। সাঁওতাল পরগণার সর্বত্রই সিধু-কানু স্কুল, কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়; রাজপথ, পার্ক-উদ্যানের নামকরণ, ডাকটিকেট অবমুক্তকরণ এবং তাদের স্মৃতি ভাস্কর্য শহর-নগর-গ্রামে অসংখ্য নির্মিত হচ্ছে। ন্যায্য দাবি আদায়ের চেতনাকে ধারণ করে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় করি কিন্তু উত্তরসূরী প্রজন্মদের বিষয়ে যেন বিবেক অসাড় হয়ে যায়। ভাগ্যের নিমর্মতায় সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়কেরা ইংরেজদের জালে ধরা পড়েন। ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারি ভগনাডিহির নিকট পাঁচকাঠিয়া বটবৃক্ষে বেলা পৌনে ২টা নাগাদ ফাঁসির মঞ্চে তোলা হয় কানু মুুরমুুকে। ফাঁসির মঞ্চ থেকে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমি আবার আসব, আবার সারা দেশে বিদ্রোহের আগুন জ¦ালিয়ে তুলব।’ ৪৫ মিনিট তাঁর দেহটি ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে রাখার পর সেটিকে নামিয়ে এনে পুড়িয়ে ফেলা হয়।
বর্বর ইংরেজ সরকার কানুর মৃতদেহটি তাঁর আত্মীয়দের হাতে তুলে দেবার সৌজন্য পর্যন্ত বোধ করেনি। বিশ্বাসঘাতকদের সফলতায় বড়ভাই সিধু ধরা পড়েন ১ দিন আগে ২৪ ফেব্রুয়ারি এবং গুলি করে হত্যা করা হয়। বোধকরি, ইংরেজরা আন্দোলনের আলোকধারাকে নিভিয়ে দিতে সিধুর মৃতদেহকেও পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছিল।
সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিলো চেতনার লড়াই, একপক্ষের রয়েছে- অর্থ, বিত্ত, অস্ত্র, বিদ্যা এবং ইংরেজ সরকারের সমর্থন। আর আদিবাসী সাঁওতালরা হৃদয়ে ধারণ করেছিল ন্যায্যতা, সত্য এবং অদম্য সাহস। অহিংসা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সূচনা হলেও সেই ধারা বজায় রাখা সম্ভবপর হয়নি। তবে সমগ্র সাঁওতাল বিদ্রোহের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে, ইংরেজ সাহেবদের প্রতি সাঁওতালদের সম্মানবোধ, সৌজন্যতা এবং গভীর ভালোবাসাও ফুটে ওঠেছে। তবে রাষ্ট্রনীতির কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিলো। হাজারিবাগে বিদ্রোহের এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য এই যে, ওই অঞ্চলের সাঁওতাল আদিবাসীরা বিদ্রোহী সিপাইদের সাথে হাত মিলিয়েছিল।
সাঁওতাল ও সিপাইদের সম্মিলিত আন্দোলন ইংরেজদের পক্ষে এমনই গুরুতর অবস্থার সৃষ্টি করে যে, ডালটন স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন, সিপাই-আদিবাসী ঐক্য ইংরেজদের পক্ষে বিশেষভাবে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল। ইংরেজদের কূটকৌশলের কাছে পরাজিত হতে হয়েছে, শিখ বাহিনীর সাহায্যে ইংরেজরা বিদ্রোহী সাঁওতালদের দমন করতে সক্ষম হয়।
সাঁওতাল বিদ্রোহ বাংলার ভূখন্ডের তেভাগা আন্দোলনকেও উদ্বেলিত করেছে। ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে শুরু হয়ে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সরব ছিলো আন্দোলন। বর্গা বা ভাগ চাষীরা এতে অংশ নেয়। মোট উৎপন্ন ফসলের তিন ভাগের দুইভাগ পাবে চাষী, একভাগ জমির মালিক এই দাবি থেকেই তেভাগা আন্দোলনের সূত্রপাত। এর আগে বর্গা প্রথায় জমির সমস্ত ফসল মালিকের গোলায় উঠত এবং ভূমিহীন কৃষক বা ভাগ চাষীর জন্য উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক বা আরো কম বরাদ্দ থাকত। যদিও ফসল ফলানোর জন্য বীজ ও শ্রম দুটোই কৃষক দিতো।
তৎকালীন পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিমবঙ্গে এই আন্দোলন সংগটিত হয়। তবে দিনাজপুর ও রংপুর জেলায় এই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করেছিল। তেভাগা আন্দোলনের প্রথম শহীদ হিসেবে স্মরণীয় রয়েছেন দিনাজপুর চিরিরবন্দর উপজেলার তালপুকুর গ্রামের সমির উদ্দিন ও শিবরাম হাঁসদা। উল্লেখ্য যে, সাঁওতাল বিদ্রোহের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ২০ ফেব্রুয়ারি বালুরঘাট খাঁপুর গ্রামে পুলিশের প্রতিরোধ করলে সংঘর্ষে শহীদ হন ২২ জন; এদের মধ্যে সাঁওতাল কমরেড হোপন মার্ডী, মাঝি সরেন, থোতো হেমব্রম, নারায়ণ মুরমু উল্লেখযোগ্য।
বাংলার ভূখন্ডের সাঁওতালরা আজো নির্যাতিত, অত্যাচারিত, নিপীড়িত; বিদ্রোহের চেতনা টনটন থাকলেও শরীর নিস্তেজ, আত্মা দূর্বল। একাবিংশ শতাব্দীতেও রাষ্ট্র, সরকার আদিবাসীদের অব্যক্ত কথাগুলো উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে। দেশের আনাচে-কানাচে ৩০ জুন সাঁওতাল বিদ্রোহ স্মরণার্থে আয়োজিত আলোচনা ও স্মরণ সভা থেকে সেই অবর্ণনীয় অভিব্যক্তিগুলোই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। সাঁওতাল কবি লিখেছেন-
“হুল’ মানে তেজ; আনা চেতনার
‘হুল’ মানে ভীত ভাঙা পরাধীনতার।
‘হুল’ মানে জাগরণ দেশপ্রেম গড়ার
‘হুল’ মানে আগামীর স্বপ্ন, স্বাধীনতার।
লেখক: গণমাধ্যম কর্মি