শনিবার, ১০ জুন, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ২৭ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
বাংলা নববর্ষ বাঙালির এক মহান উৎসব। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে এক হয় উৎসব-আয়োজনে। রঙে-আনন্দে উচ্ছ্বলতায়, আবেগাপ্লুতায়, চিন্তা ও ভাষায় উদ্ভাসিত হয় আলো, চলার গতিপথ। বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হয়, বিশ্ব মানুষে ঘোষিত হয়- শান্তি, ঐক্য, প্রেম-ভালবাসা, পরম ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ। পহেলা বৈশাখ বিশ্ব মানবতার সমর্থনে শপথেরও দিন। বিশ্বের অন্য নববর্ষের চেয়ে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের এখানেই পার্থক্য, চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা।
তারই স্বীকৃতি দিল জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেস্কো। পৃথিবীর বাংলা ভাষাভাষি সকল মানুষের জন্যই এটা গর্বের। বাঙালির সংস্কৃতির ঐতিহ্যের মধ্যেই যে মানবতার জয়গান যা বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়া যায় মানুষের ঐক্যে-কল্যাণে, আনন্দ-অভিলাষে, স্পর্ধিত সাহসেÑ এ স্বীকৃতি তারই প্রমাণ।
বাংলাদেশে বাংলা বর্ষবরণের অন্যতম অনুসঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। বুধবার ইউনেস্কোর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়।
এতে বলা হয়, ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবায় বিশ্বের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় আন্তঃদেশীয় কমিটির একাদশ বৈঠকে ‘রিপ্রেজেন্টেটিভ লিস্ট অফ ইনট্যানজিয়েবল কালচারাল হেরিটেজ অফ হিউমিনিটি’র তালিকায় বাংলাদেশের মঙ্গল শোভাযাত্রা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দৈনিক সোনার দেশ দেশের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
গত শতকের ৮০ এর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু হয়। তারপর থেকে প্রতিবছরই বর্ষবরণে মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এতে উৎসাহিত হয়ে ঢাকার বাইরেও একই ধরনের শোভাযাত্রা বের হচ্ছে পহেলা বৈশাখে।
চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু উৎসবের অনুসঙ্গই নয়, এর মধ্য দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতিকে মেলে ধরার পাশাপাশি সমাজে অবক্ষয় থেকে মুক্তি, পেছনের দিকে হাঁটা প্রতিরোধের আহ্বানও জানানো হয়।
বাংলা নববর্ষের অসাম্প্রদায়িক চেতনা বাঙালির রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেরও পথনির্দেশক। সেই শপথের ইস্পাত কঠিন ঐক্য থেকেই মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের স্পর্ধিত অভ্যুদয়। বাংলা নববর্ষের ভেতরের শক্তিকে তাই ভয় পায়- বিবরবাসী সাম্প্রদায়িক শক্তি। তাদের কাছে অত্যন্ত অপছন্দের ব্যাপার এটি। তারা আনন্দ-আলো, জ্ঞান গরিমা, সত্য ও সুন্দরকে ভয় পায়, নারীকে ভয় পায়, সর্বোপরি মানুষের মিলন-ঐক্যকে ভয় পায়। ওদের ভঙ্গুর- বিপর্যস্ত, কালিমালিপ্ত হীন মন ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে পবিত্রকে, ধর্মকে। ফতোয়া দিয়ে বাতিল করতে চায় পহেলা বৈশাখকে। তবুও আবহমানকাল ধরে চলে আসা মানুষের এই মহামিলনের উৎসব চলছেই, চলতেই থাকবে চিরকাল।
পহেলা বৈশাখে বাঙালি সংস্কৃতির এ চর্চা বাঙালি জাতিসত্ত্বাকে বিকশিত করে চলেছে। সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার শক্তি যোগায়, যোগাবে বাংলা নববর্ষ যুগ যুগ শতযুগ ধরে। সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তি একাত্তরে বাঙালি জাতিসত্ত্বাকে মিটিয়ে দিতে চেয়েছিল। ভয়ঙ্কর-বিভৎস নৃশংসতায় মানবতার শত্রুরা নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর হামলে পড়েছিল। নির্বিচারে হত্যা-গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করেছিল। ‘পোড়া মাটি নীতি’ নিয়ে বাঙালি জাতিকে নিঃশেষ করতে চেয়েছিল। কিন্তু বাঙালি পরাভব মানেনি সেদিন। স্বাধীনতার শত্রুরাই সেদিন হেরেছিল।
বাংলা নববর্ষ উৎসব- মঙ্গলশোভাযাত্রা এক অবিনাশী চেতনার প্রদীপ্ত অগ্নিশিখা। একে নেভান যাবে না, যায়নি, যাবে না কোনো দিন। যারা এই আগুনকে নেভাতে চায়, তারাই বার বার পুড়ে মরেছে। আবহমানকাল ধরে এই অগ্নিধারায় ¯œান করে যে বাঙলি জাতি শুচি-শুভ্র হয়েছে সে তো আগুনেরই সন্তান। সে জাতির ললাটে কলঙ্কটিকা আঁকে কার সাধ্য!