নিজস্ব প্রতিবেদক:রাজশাহী জেলার চারঘাট উপজেলার এক তরুণ মনের ক্ষোভে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে গালাগাল করেছিলেন। কিন্তু এটি ছিল অন্যের জন্য অপবাদজনক, মানহানিকর। তার বিরুদ্ধে মামলাও করা হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। অভিযুক্ত তরুণ খুব ভয়ে ছিলেন, তার ক্যারিয়ার হয়তো এখনই শেষ। কিন্তু মামলার রায়ে সাইবার ট্রাইব্যুনাল রাজশাহীর বিচারক মো. জিয়াউর রহমান এই তরুণকে শাস্তি না দিয়ে প্রবেশন দেন। এই তরুণও প্রবেশনের শর্ত অনুযায়ী সাইবার সচেতনতা বিষয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন।
সাইবার এই তরুণ বলেন, আদালত আদেশে বলেছেন প্রবেশন শেষ হলে এ মামলা আমার কোনো চাকরি পেতে বাধা হবে না। এটিই আমার জন্য বড় পাওয়া। আমি সাইবার সচেতনতায় কাজ করে যাচ্ছি। মানুষের মাঝে সাইবার সচেতনা পৌঁছে দিচ্ছি।
নাটোরের চাকরিপ্রার্থী এক তরুণ ভুল করে একটি সাইবার অপরাধ করে ফেলেছিলেন। পরে অনুতপ্তও হন। কিন্তু মামলা চলে যায় রাজশাহী সাইবার ট্রাইব্যুনালে। সাক্ষ্য-প্রমাণে অপরাধ প্রমাণিতও হয়। তবে আদালত তাকে শাস্তি না দিয়ে এক বছরের প্রবেশনে বাড়িতেই থাকার সুযোগ দেন। প্রবেশনের বেশ কিছু শর্তের মধ্যে একটি ছিল- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পেজ খুলে অনলাইনে সাইবার অপরাধ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। নাটোরের এই তরুণ সাইবার সচেতনতা নামে ফেসবুকে পেজ খুলে ডিফেন্ডিংয়ের কাজ করেছেন। আদালত তার কার্যক্রমে খুশি হয়েছেন। প্রবেশনের এক বছর শেষে এই যুবক এখন মুক্ত। তারপরও সাইবার সচেতনতায় প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন।
তিনি বলেন, আমি আদালতের প্রতি কৃতজ্ঞ। জেল হলে আমার জীবনটা অন্যরকম হয়ে যেত। আমি নিজেকে সংশোধনের সুযোগ কাজে লাগিয়েছি। আর ভালো লাগছে যে অন্যরা যেন সাইবার অপরাধে না জড়ায়, সে জন্য কিঞ্চিৎ হলেও অবদান রাখতে পারছি। আমার মতো ভুল যেন আর কেউ না করেন।
এদের মতো সাইবার অপরাধে জড়িয়ে পড়া আরও এক ডজন তরুণ প্রবেশনে গিয়ে সাইবার সচেতনতা নিয়ে কাজ করছেন। এখন তারা বলছেন, আর কোনো সাইবার অপরাধে জড়াবেন না। বরং সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করবেন। একসময়ের এই সাইবার অপরাধীরা এখন সাইবার ডিফেন্ডার হয়ে অবদান রাখছেন।
২০২১ সালের ৪ এপ্রিল সাইবার ট্রাইব্যুনাল রাজশাহী গঠিত হয়। তিন বছরে জেলা ও দায়রা জজ পদমর্যাদার একজন বিচারক ট্রাইব্যুনালটির রাজশাহী বিভাগের আট জেলার সাইবার অপরাধের মামলা নিষ্পত্তি করে আসছেন। তার দেওয়া প্রবেশন নিয়ে এমন অনেক উদ্দীপক ঘটনা আছে। প্রবেশনে থেকে শাস্তি এড়ানো চাঁপাইনবাবগঞ্জের একজন ইমাম বলছিলেন, প্রবেশনে গিয়ে তিনি আদালতের শর্ত অনুযায়ী বই পড়েছেন, গাছ লাগিয়েছেন, অনলাইনে সাইবার সচেতনতা নিয়ে কাজ করছেন। এখন তিনি মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানেন।
সাইবার অপরাধের জন্য নাটোরের আরেক তরুণ ঠিকাদারকেও আদালত শাস্তি না দিয়ে প্রবেশন দিয়েছিলেন। সাইবার সচেতনতায় প্রচারণা চালানোর পাশাপাশি আদালত তাকে পাঁচটি বনজ ও পাঁচটি ফলদ গাছ লাগাতে আদেশ দিয়েছিলেন। তিনি নাটোরে সড়কের দুপাশে কয়েক হাজার বৃক্ষরোপণ করেছেন। তিনি বলছিলেন, গাছগুলো ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। গাছগুলোর দিকে তাকালে তাঁর অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করে। মানসিক শান্তি পান।
সাইবার ট্রাইব্যুনাল রাজশাহীর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ইসমত আরা বলেন, আমাদের ট্রাইব্যুনালে আমরা যেকোনো সাইবার অপরাধের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করি। আমাদের কোর্টে প্রচুর সাক্ষী আসেন। আমরা ডাক মারফত প্রসেস পাঠানোর পাশাপাশি অনলাইনে বা ই-মেইলেও সাক্ষীদের সঙ্গে যোগাযোগ করি।’ তিনি বলেন, ২০২১ সালের ৪ এপ্রিল এই আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এরপর প্রায় তিন হাজার সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। নিষ্পত্তি হয়েছে ৭০০ মামলা।
আইনজীবী ইসমত আরা দাবি করেন, এখানে গড়ে একটি মামলা মাত্র তিন মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে। বর্তমানে মাত্র ২৫ থেকে ৩০টি মামলা বিচার ফাইলে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এই সংখ্যা দেশের সবগুলো সাইবার ট্রাইব্যুনালের মধ্যে সর্বনিম্ন।
রাজশাহী সাইবার ট্রাইব্যুনালে নিয়মিত মামলা পরিচালনা করেন আইনজীবী মাহমুদুর রহমান রূমন। তিনি বলেন, দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি ও প্রতিকার পাওয়ায় বিচারপ্রার্থীদের খরচ কমছে। আদালত ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ছে। প্রবেশনের মাধ্যমে সাইবার অপরাধীকেই সংশোধনের সুযোগ দিয়ে তাকেই সাইবার ডিফেন্ডার হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ ভালো।
রাজশাহী বার সমিতির সভাপতি ইব্রাহিম হোসেন বলেন, অপরাধীকে সংশোধনের সুযোগ দিয়ে তাদের দিয়েই সাইবার অপরাধ ঠেকানোর যে প্রচেষ্টা, তা নিশ্চয়ই অভিনব। এটি বিচারব্যবস্থার একটা সুন্দর প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে অপরাধীরা অপরাধ না করে সবাইকে সচেতন করে।