সাধারণ মানুষগুলো নীতি নির্ধারণের উঁচু দালান আর রাজনীতির ঘেরাটোপের মধ্যে কখনো থাকে না

আপডেট: আগস্ট ২০, ২০১৭, ১২:৩৪ পূর্বাহ্ণ

জাসটিন ট্রুডো


আমাদের সেই প্রস্তাবে আমরা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছিলাম, আমাদের রাজনীতিবিদদের উচিৎ কানাডার যুব সমাজ যা চায় বা যে সব বিষয়ে তাদের আগ্রহ আছে, সেই সব দিকে তাদের যুক্ত করা। এই বিষয়গুলোর কথা উল্লেখ করতে হলে প্রথমেই চলে আসে শিক্ষা, পরিবেশ, বৈদিশিক নীতি আর ব্যক্তি অধিকার সংরক্ষণ করা। আমরা এটাও প্রস্তাব দিয়েছিলাম, যুব স্বেচ্ছাসেবিদের প্রতি রাষ্ট্রের যে প্রতিশ্রুতি আছে সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে এমন পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন যাতে আগামীতে বর্তমানের যুব সমাজ দায়িত্ববান নাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠতে পারে। সেই সাথে আমরা কানাডার নির্বাচন কমিশনকে এই প্রস্তাবও দিয়েছিলাম, কানাডার নতুন প্রজন্মকে নির্বাচন বিষয়ে সচেতন করে তোলার জন্য ফেডারেল নির্বাচনের সময় ইলেকশনস কানাডা হাই-স্কুল বোর্ডের সাথে মিলে সেই দিনটিতে স্কুলে স্কুলে মক-ইলেকশনস এর আয়োজন করতে পারে।
এখনকার মত আমি তখনো ভাবতাম আমাদের দেশে আমরা যে ধরনের সমস্যার সম্মুখিন হই তা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হচ্ছে এই সব কাজে যতটুকু সম্ভব নাগরিকদের সম্পৃক্ত করা। আমরা বিভিন্ন সময়ে বড় বড় বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হই এবং এসব ক্ষেত্রে বার বারই আমার মনে হয় আমরা যদি সত্যিকারের গণতন্ত্রের চর্চা করতে না পারি তাহলে আমরা এসব সমস্যার কোনো গ্রহণযোগ্য ও যথার্থ সমাধান খুঁজে পাবো না। আমি মনে করি, আধুনিক গণতন্ত্রে কোনো বিষয়ে পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়নের জন্য শুধু জনগণের পরোক্ষ মত বা ভোটই যথেষ্ট নয় বরং সেই পরিকল্পনা বা স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার জন্য প্রয়োজন জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ এবং এ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় কাজ করার জন্য তাদের এই বাস্তব অংশগ্রহণের পথটা সুগম করে দেয়া। যখন গণতন্ত্রের সংস্কারের কথা উঠে, তখন এই বিষয়টাকে সবচেয়ে গুরুত্বের সাথে প্রাধান্য দিতে হবে। আমাদের রাজনীতিতে প্রায়ই এই সংস্কারের বিষয়টা ভাবা হয়। আবার এমনও ধারণা করা হয়, এই বিষয়টা কিছু রাজনীতিবিদ বা অটোয়ার বিশেষ ভবনে আসা-যাওয়া কিছু ব্যক্তির নিজেদের ব্যাপার। ব্যাপারটা এমন যে, সবকিছুর জন্য বা এ বিষয়ের মূল সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য ওই ব্যক্তিরাই যথেষ্ট। তবে সত্যি বলতে কী, ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। যে মানুষগুলো উপলব্ধি করে, আমাদের গণতন্ত্রের ব্যর্থতা আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনে কি ধরনের ভয়াবহ এক পরিস্থিতি আর ফলাফল বয়ে আনতে পারে, তারা সাধারণত অটোয়ার থেকে অনেক দূরে থাকে। বাহ্যিক আর রূপক যে অর্থেই ভাবো না কেনো, এই সাধারণ মানুষগুলো নীতি নির্ধারণের উঁচু দালান আর রাজনীতির ঘেরাটোপের মধ্যে কখনো থাকে না।
২০০৬ সালের শরতে আমাদের প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হবার পর থেকেই আমি এই বিষয়ের গুরুত্বটা প্রবলভাবে অনুধাবন করতে শুরু করি। আমি নেতৃত্বের দৌড়ে মাঠে নামা কয়েকজনের সাথে আমাদের সুপারিশগুলো নিয়ে কথা বলি। মূলত আমি চাচ্ছিলাম, যুব সমাজ নিয়ে বর্তমান সময়ে আমাদের দল যে সমস্যার সম্মুখিন হয়েছে সেটা তাঁরা কীভাবে দেখছেন আর আমাদের এই প্রতিবেদনটা তাঁরা কীভাবে আমলে নিচ্ছেন। আমি এটাও জানার চেষ্টা করছিলাম, নির্বাচনে হারার পর একটা দলকে আবার বলিষ্ঠভাবে দাঁড় করানোর জন্য কী কী ধরনের নতুন সব পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন এবং পূর্বের ভুল থেকে কীভাবে শিক্ষা নিয়ে নতুন পথে আরো আধুনিকভাবে সামনে এগুনো যায়। মাঝে মাঝেই দলের নেতারা এবং সাংবাদিকরা দলের নেতৃত্ব নিয়ে আমাকে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করতেন এবং আমি সব সময়ই বলতাম, আমার কোনো মতামত দেবার আগে নেতৃত্বের এই ময়দান সম্পর্কে আমার আরো বেশি জ্ঞান নিতে হবে। ওই সময় আমার মধ্যে যে বিশ্বাস আর ভাবনাটা কাজ করছিলো তা হচ্ছে, অতি সাম্প্রতিক অতীতে দল যে ভুলগুলো করেছে বা দলকে যে নেতিবাচক দিকে চালিত করা হয়েছে, সেখান থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য দলকে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে একটু সরে আসা প্রয়োজন এবং লিবারেল পার্টির সদস্যদের মধ্যে যে ভাবনা কাজ করে, কানাডার শাসন ক্ষমতায় থাকার জন্য লিবারেলই হচ্ছে একমাত্র রাজনৈতিক দল, এই ভাবনা আর অহমিকা থেকে দল ও দলের সদস্যদের দূরে থাকতে হবে।
শেষ পর্যন্ত আমি অন্টারিও’র শিক্ষামন্ত্রী জেরাড কেনেডি’কে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নিলাম। সরকারি কাজের বাইরেও জেরাড কেনেডি দীর্ঘদিন ধরে যেভাবে মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজ করে এসেছেন সেটা আমাকে সত্যিই ভীষণভাবে মুগ্ধ করেছিলো। আমি হলফ করে বলতে পারি, যে সব রাজনীতিবিদরা রাজনীতিকে তাদের জীবনের ধ্যান-জ্ঞান আর জনগণকে সেবার করার ব্রত নিয়েছেন, তারা অনেকেই জেরাড কেনেডি’র মত কাজের সামান্যতম করেন নি। আমি এখানে একটা উদাহরণ দিতে পারি, প্রায় এক দশক ধরে টরন্টো’তে ডেইলি ব্রেড ফুড ব্যাংক চালাতে গিয়ে তিনি খুব ভালোভাবেই দারিদ্র্য, উপার্জনের অসামঞ্জস্যতা আর বেকারত্বের মত বিষয়গুলো হাড়ে হাড়ে বুঝেছেন, আর আমিও সব সময়ই আমার রাজনৈতিক চিন্তায় এই বিষয়গুলোকেই সব সময় প্রাধান্য দিয়ে এসেছি। আমি তাঁর কাজের ধারা আর বিশ্বাসের প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলাম, সেইসাথে তাঁর নীতি এবং তৃণমূল পর্যায়ের উন্নয়নের জন্য সব পদক্ষেপকে মনে প্রাণে ধারণ করেছিলাম। সেই সময় আমার এটাও মনে হয়েছিলো সবাই যা ভাবছে তার চেয়ে এক গভীর ক্ষত রয়েছে লিবারেল পার্টির মধ্যে। এই অদৃশ্য ক্ষত দূর করার জন্য একটা অন্যতম উপায় হচ্ছে, নতুন প্রজন্ম থেকে একজন নেতাকে বের করে নিয়ে আসা। আর এই নতুন প্রজন্মের নেতা অবশ্যই পুরাতন নেতৃত্ব আর ফেডারেল পার্টির বাইরে থেকে হবে হবে। তখন আমি এও বিশ্বাস করছিলাম, এমন এক নেতৃত্ব’ই পারবে দলকে আবার সুন্দর পথে চালিত করতে।
লিবারেল পার্টির নেতৃত্বকে নতুনভাবে সাজানোর জন্য ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে মন্ট্রিয়লে দলের নেতাদের যে সমাবেশ হয় সেটা নিঃসন্দেহে ছিলো এক ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী এক ঘটনা। সেই সমাবেশে কোনো একজন নেতাকে মনোনীত না করে বা পার্টির সব ঝানু ঝানু নেতাদের দ্বদ্বের কোনো পরিবেশ তৈরি না করে চারজন নেতার নাম সবার সামনে চলে আসে। এই চারজনের দলে ছিলেন, মাইকেল ইগনাতিয়েফ, বব রে, স্টিফেন ডিওন এবং জেরাড কেনেডি। আর অন্য যাদের নাম নেতৃত্বের সামনে আসার জন্য সব সময় উচ্চারিত হতো সেই কেন ড্রাইডেন, স্কট ব্রাইসন, জো ভোলপে এবং মার্থা হল ফিন্ডলে সেই সমাবেশকে সর্বতোভাবে সফল করার জন্য অন্যদের গঠনমূলকভাবে সমর্থন করেছিলেন।
আমি যদি চোখ বন্ধ করে আমার রাজনীতিতে আসার পথটার দিকে খেয়াল করি, তাহলে দেখি আমার রাজনৈতিক জীবনে মন্ট্রিয়লের সেই কয়েকটি দিনের প্রভাব ছিলো সবচেয়ে বেশি। ওই দিনের আগ পর্যন্ত যদিও আমি মাঝে মাঝে লিবারেল পার্টির সামান্য কিছু কর্মকা-ের সাথে পরোক্ষভাবে কাজ করেছি, কিন্তু তখন পর্যন্ত আমি ভাবিনি, রাজনীতির কাছে আমার জীবনকে আমি সপে দিবো। আমি সেই ছোটবেলা থেকে ধ্যানধারণা, মূল্যবোধ আর নীতি নির্মাণের কাজ করে আনন্দ পেতাম, কিন্তু আমার মা বারবারই আমাকে সতর্ক করে দিতেন। একজন রাজনীতিবিদকে তার জীবনে কি ভয়ংকর ধরনের মূল্য দিতে হয়, মা প্রায়ই তার নিজের জীবন থেকে কিছু উদাহরণ টেনে আমাকে এই বিষয়ে সতর্ক করে দিতেন। সেই সাথে রমা আমাকে এটাও মনে করিয়ে দিতেন, ফেডারেল রাজনীতিতে নামলে আরেকটা বিষয় আমার সামনে এসে উপস্থিত হবে, আমি আমার বাবার পদাংক অনুসরণ করে রাজনীতিতে এসেছি। সেখানে আমার নিজের যোগ্যতা কোনো বিষয় নয়, বরং আমি পিয়েরে ইলিয়ট ট্রুডোর ছেলে হিসেবে আমি রাজনীতিতে আমার পথ পরিষ্কার করে নিচ্ছি আর ওই পরিচয় ছাড়া আসলে আমার নিজের কোনো যোগ্যতায় নেই একাকী সামনে এগুনোর।
(চলবে)